একটা অমাবস্যার গল্প
আমি তোমার ছায়া দেখে চমকে উঠি না আর।
শুধু এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ভাবি… তুমি কি আবারও ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে?
সেদিন, শেষবার, তুমি আমার হাত ছুঁয়ে দিতে চেয়েছিলে।
তোমার চোখে ছিল একরাশ কথার ভিড়,
আমার চোখে ছিল অদ্ভুত এক শীতলতা..
কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তোমার দিকে,
জানি না কেন, শুধু মনে হয়েছিল,
ছোঁয়াটা সবকিছু আরও বেশি সত্যি করে দেবে
আর আমি ভীষণ ভয় পেতাম সত্যকে।
তোমার সাথে দেখা না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না
কিন্তু তবুও হয়নি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।
আমরা মিলিয়ে গেলাম ভিন্ন ভিন্ন ছায়ার ভেতর,
একটিবারও না ছুঁয়ে, না ছুঁইয়ে।
অতঃপর কেটে গেছে ছয়টি মাস।
এই ছয়টি মাসে আমি ভোরের সূর্যের সাথে কথা বলেছি,
কলাগাছের সবুজে সারিতে সাজানো পথে তাকিয়ে থেকেছি,
হঠাৎ তোমার চলে আসার অপেক্ষায়।
কতবার ভেবেছি, আজ বুঝি তুমি এসে বলবে,
‘তুমি তো আমার ছায়াকেও ভয় পেতে শিখলে!’
কিন্তু তুমি এলে না।
হঠাৎ জানলাম,
তুমি আর নেই।
তুমি চলে গেছো এক অচেনা রাস্তায়,
নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে সবকিছু।
সেদিনের সেই মুহূর্ত..
যেদিন আমি তোমার ছোঁয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম,
সেটাই হয়ে রইল তোমার জীবনের শেষ সন্ধ্যা,
আমার জীবনের শুরু হওয়া এক নিঃশেষ বিকেল।
পুরো পৃথিবীটাই যেন অমাবস্যায় ঢেকে গেল।
তোমার স্পর্শহীন হাত আজও আমার স্মৃতিতে হাহাকার তোলে।
কখনও কখনও রাতের নিঃশব্দে ভাবি..
সেদিন যদি আমি তোমার হাতটা ধরে রাখতাম…
তবে কি তুমি আজও বেঁচে থাকতে?
তবে কি আমার পৃথিবীটা আজও পূর্ণিমার আলোয় ভরপুর হতো?
তুমি নেই,
তোমার ছায়াও নেই।
শুধু আমি আছি..
একটা শেষ না হওয়া ছোঁয়ার অপেক্ষায়,
একটা অনন্ত অমাবস্যায়।
শেষ পৃষ্ঠার ঘাট
নদী আছে,বয়ে চলে আপন খেয়ালে, বুকের মধ্যে হাজার বছরের কাদা আর জল।
নৌকা আছে,ঘাটে বাঁধা, কাঠে কাঠে জমেছে সূর্যাস্তের ধুলোর ছায়া।
আছে শুধু আমার মন, কিন্তু সে তো কোথাও নেই,
না ঘাটে, না জলে, না হাওয়ায়।
ও নদী, তুই চলিস তো চল, কিন্তু আমার ভেতরের সে জলকণা,
সে তো আটকে আছে এক গভীর ডুবের ভিতর।
তোর ঢেউ আসে, ছুঁয়ে যায় পায়ের পাতায়, আবার সরে যায়,
কিন্তু মন,সে তো ঘাটের পাশে বসে শুধু দেখে যায়।
এক সময় বেলা ছিল,
এক সময় আকাশে ছিল আমার চেনা রোদ্দুর,
তখন মনে হতো,এই বুঝি পাড়ি দিই, এই বুঝি যাই ভেসে।
কিন্তু বেলা গেল, ছায়া নেমে এল,
আর তোর ওই নৌকাটা,সে যেন আমারই নাম ধরে ডাকে,
তবুও আমি উঠতে পারি না,
তবুও আমার মন দাঁড়িয়ে থাকে শুধু তোরই দিকে চেয়ে।
নদী তুই তো জানিস,
আমি তো কেবলই অপেক্ষা, আমি তো কেবলই থেমে থাকা এক বেলাভূমি,
যেখানে নৌকা আসে, যায়, কিন্তু মন কোথাও ভাসে না।
মন রয়ে যায়,ঘাটের শেষ পাথরটায়,
যেখানে বসে থাকে বিস্মৃত কোনো দিনলিপির শেষ পৃষ্ঠা।
ও নদী রে,
আজ তুই চলে যা,
নৌকাটাকে নিয়ে দূর কোনো ডাকে।
আমি আর ডাকবো না,
আমার মন,সে আজ শান্ত এক ঘাট,
যেখানে আর কেউ আসে না।