বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন ও প্রশাসনে ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন এখন শুধু সম্মানের নয়, বরং ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবে গেঁথে গেছে। অথচ এ দুটি শব্দের শিকড় খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে ঔপনিবেশিক ইতিহাসে।
ঐতিহাসিক পটভূমি
‘স্যার’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় ইংল্যান্ডে ১২৯৭ সালের দিকে। এটি মূলত ফরাসি শব্দ Sire থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘প্রভু’ বা ‘কর্তা’। মধ্যযুগে নাইট উপাধি পাওয়া ব্যক্তিদের সম্মান জানানোর জন্য ‘স্যার’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। তবে ঐ শব্দটি কেবল শ্রদ্ধার নয়, বরং আনুগত্য ও কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
বিপরীতে, ‘ম্যাডাম’ শব্দটি এসেছে ফরাসি ‘মাদাম’ থেকে, যার অর্থ ভদ্রমহিলা। ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে ইউরোপীয় নারীদের সম্বোধনের জন্য ব্যবহৃত হতো ‘মেম’ বা ‘মেমসাহেব’, যা ছিল শ্রেণিভেদ ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।
ভারতীয় লেখক উদয়লাল পাই তার বই Are We Still Slaves-এ উল্লেখ করেছেন, “SIR” শব্দটির অর্থ ছিল Servant I Remain, অর্থাৎ “আমি দাসই রইলাম”। এতে বোঝা যায় এই সম্বোধনের অন্তর্নিহিত অর্থ কেবল সম্মান নয়, একরকম আত্মবশ্যতা।
বাংলার উপনিবেশিক বাস্তবতা
ব্রিটিশরা যখন ১৭শ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করে, তখন থেকেই প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থায় এই শব্দগুলোর প্রচলন শুরু হয়। একদিকে সাদা চামড়ার শাসকদের ‘স্যার’, অন্যদিকে তাদের স্ত্রীদের ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকতো উপমহাদেশের মানুষ, যা ছিল প্রভুত্ব মেনে নেওয়ার প্রতীক।
ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন তার বই ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন-এ লেখেন, ব্রিটিশরা উচ্চবর্ণের বাঙালিদের ‘বাবু’ বলে ডাকলেও, প্রশাসনে তারা ‘স্যার’ এবং ‘ম্যাডাম’ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছিল। শিক্ষকদের ‘মাস্টারমশাই’ বা ‘পণ্ডিতমশাই’ বলে ডাকার চর্চা একসময় হারিয়ে যায় এই নতুন সংস্কৃতির আড়ালে।
প্রশাসন ও শিক্ষায় আধিপত্যের ভাষা
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে, বিশেষ করে ১৬তম গ্রেডের ওপরে থাকা কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন এখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় পরিণত হয়েছে, যদিও এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
১৯৯০ সালের ১১ ডিসেম্বর সংস্থাপন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে জানায়, সরকারি চিঠিপত্রে ‘স্যার’ নয়, বরং ‘জনাব’ ও ‘মহোদয়/মহোদয়া’ সম্বোধন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এই প্রথা বিলুপ্ত হয়নি, বরং আরও গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে।
সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ২০২১ সালে বলেন, “জনগণকে সেবা দিতে আসা কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন বাধ্যতামূলক নয়।” কিন্তু অফিস-আদালতের বাস্তবতায় ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে সেবা গ্রহণ করতে আসা মানুষকে ‘স্যার’ না বললে দুর্ব্যবহার বা হয়রানির শিকার হতে হয়।
বিচারালয়েও ঔপনিবেশিক ধারা
বাংলাদেশের নিম্ন আদালতে বিচারকদের ‘স্যার’ বা ‘ইওর অনার’ এবং উচ্চ আদালতে ‘মাই লর্ড’ বা ‘মি লর্ড’ বলে ডাকা হয়। অথচ দেশের কোনো আইনেই এই সম্বোধনের বাধ্যবাধকতা নেই। ১৯৭২ সালের ‘বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অর্ডার’ কিংবা হাইকোর্টের ‘রুলস অব কোর্ট’-এ সম্মানজনক সম্বোধনের কথা বলা হলেও, ‘স্যার’ বলার নির্দেশ নেই।

‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ শব্দের সামাজিক রূপান্তর
বর্তমানে শিক্ষক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকা একটি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত রীতি। যদিও এটি আইন বা নীতিমালায় বাধ্যতামূলক নয়, তবুও শৃঙ্খলা ও কৌশলগত সম্মান প্রদর্শনের অংশ হিসেবে এই শব্দদ্বয়ের ব্যবহার বহাল রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৩ ও ১৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তারা আসলে ‘জনগণের সেবক’। কিন্তু তাদের অনেকেই নিজেদের ‘কর্তা’ হিসেবে জাহির করতে এই সম্বোধনের ওপর নির্ভর করেন।
সাম্প্রতিক পরিবর্তন
২০২৫ সালের ১১ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকারের এক নির্দেশনায় প্রধানমন্ত্রীসহ সিনিয়র নারী কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধনের রেওয়াজ বাতিল করা হয়। এ সম্বোধনকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি একটি বড় দৃষ্টান্ত, যা ‘স্যার-ম্যাডাম’ সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলছে।
বাংলাদেশে ‘স্যার’ ও ‘ম্যাডাম’ সম্বোধনের প্রচলন কোনো নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নয়। এটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের একটি উত্তরাধিকার, যা শ্রেণিভেদ, ক্ষমতা ও আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছিল। আইনগত ভিত্তি না থাকলেও সামাজিকভাবে এই চর্চা এখনো ব্যাপক। তবে সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার—সম্মান কি শুধু শব্দে প্রকাশ পায়, না কি আচরণে?