স্বাস্থ্য ডেস্ক
একসময় কলোরেক্টাল ক্যানসারকে শুধু বয়স্কদের রোগ হিসেবেই ধরা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিত্র পাল্টে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মিলেনিয়াল (যারা ১৯৮১–১৯৯৬ সালের মধ্যে জন্মেছেন) ও জেনারেশন জি (১৯৯৭–২০১২) প্রজন্মের তরুণদের মধ্যেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কোলন ও রেক্টাল ক্যানসার।
১৮ বছর বয়সেই ক্যানসার!
ইয়েল মেডিসিনের গবেষণায় দেখা গেছে, এখন এমনকি ১৮ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যেও কলোরেক্টাল ক্যানসারের অস্তিত্ব ধরা পড়ছে। অথচ একসময় এ বয়সে এই রোগ ছিল প্রায় অজানা। ২০১৯ সালে দেখা গেছে, কলোরেক্টাল ক্যানসার আক্রান্তদের ২০ শতাংশের বয়স ছিল ৫৫ বছরের নিচে। অথচ ১৯৯৫ সালে এ হার ছিল প্রায় অর্ধেক।
২০২৩ সালের শেষ নাগাদ আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির প্রতিবেদন বলছে, ৫০ বছরের কম বয়সী পুরুষদের মধ্যে এটি ক্যানসারজনিত মৃত্যুর শীর্ষ কারণ, আর নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
তরুণদের মধ্যে কেন বাড়ছে ক্যানসার?
চিকিৎসকরা এখনো নিশ্চিত নন, ঠিক কোন কারণে এই ক্যানসার বাড়ছে। তবে সম্ভাব্য কিছু কারণ চিহ্নিত করা গেছে—
জীবনযাপনের ধরন
১. অধিকাংশ সময় বসে থাকা
২. অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা
৩. ধূমপান ও অ্যালকোহল
৪. কম আঁশযুক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবার
৫. প্রক্রিয়াজাত ও মাংসজাত খাবারের আধিক্য
পারিবারিক ইতিহাস
পরিবারের কারও কোলন বা রেক্টাল ক্যানসার থাকলে ঝুঁকি বেড়ে যায়
অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ
ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজিজ (IBD), ক্রোনস ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস ইত্যাদি
বংশগত কারণ
Lynch syndrome-এর মতো জেনেটিক সিনড্রোম
তবে অধিকাংশ তরুণের ক্যানসার স্পোরাডিক বা আকস্মিকভাবে ঘটছে—অর্থাৎ কোনো পারিবারিক ইতিহাস ছাড়াই।
কী কী উপসর্গ উপেক্ষা করা বিপজ্জনক?
* মলত্যাগের অভ্যাসে হঠাৎ পরিবর্তন
* পায়ুপথে রক্তপাত
* পাতলা, ফিতার মতো মল
* দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া (২ সপ্তাহের বেশি)
* অতিরিক্ত ক্লান্তি বা ওজন হ্রাস
বিশেষজ্ঞ পরামর্শ:
ইয়েল মেডিসিনের কলোরেক্টাল সার্জন ডা. বিক্রম রেড্ডি বলেন, “অনেকে পায়ুপথে রক্তপাতকে হেমোরয়েড ভেবে অবহেলা করেন। কিন্তু যদি এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে অবশ্যই কোলোনোস্কোপি করাতে হবে।”
স্ক্রিনিং কখন শুরু করবেন?
আগে ৫০ বছর বয়স থেকে কলোরেক্টাল ক্যানসার স্ক্রিনিং শুরু করার সুপারিশ থাকলেও এখন ৪৫ বছরেই শুরু করার পরামর্শ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস প্রিভেনটিভ সার্ভিস টাস্ক ফোর্স।
তবে যাঁদের পরিবারে কলোরেক্টাল ক্যানসারের ইতিহাস আছে বা উপসর্গ দেখা দিয়েছে, তাঁদের আরও আগেই চিকিৎসকের পরামর্শে স্ক্রিনিং করানো উচিত।
তিনটি খাবার, যা ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে
১. দই ও ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার
সপ্তাহে অন্তত দুইবার দই খাওয়া কোলনের ডান পাশে হওয়া ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। দিনে ৩০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহণে ঝুঁকি কমে প্রায় ১৭%।
সতর্কতা: অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণে প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে—বিশেষ করে পুরুষদের।
২. গোটা শস্য (হোল গ্রেইন)
প্রতিদিন ৯০ গ্রাম গোটা শস্য খেলে ঝুঁকি ১৭% পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এতে থাকা আঁশ, ম্যাগনেসিয়াম, রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ ও প্রোবায়োটিক অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
৩. আঁশযুক্ত খাবার
ফল, সবজি, ডাল ও ছোলায় থাকা আঁশ অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে পুষ্টি জোগায়। প্রতিদিন ১০ গ্রাম আঁশ বেশি খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি ৭% পর্যন্ত কমে।
তরুণদের জন্য করণীয় কী?
* ধূমপান ও ই-সিগারেট পরিহার
* অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ
* নিয়মিত ব্যায়াম
* ওজন নিয়ন্ত্রণ
* প্রতিদিন অন্তত ২৫ গ্রাম আঁশ খাওয়া
* উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ
* প্রয়োজনে দ্বিতীয় মতামত নেওয়া
* পরিবারের ইতিহাস থাকলে সময়মতো স্ক্রিনিং
কলোরেক্টাল ক্যানসার এখন আর শুধু প্রবীণদের রোগ নয়। মিলেনিয়াল ও জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে এর ঝুঁকি বাড়ছে দ্রুত গতিতে। সময়মতো সতর্কতা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ।
সতর্ক থাকুন, সচেতন হোন—নিজেকেও বাঁচান, অন্যকেও জানাতে সাহায্য করুন।
সূত্র: ইয়েল মেডিসিন, আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি, Fortune.com