তানজিলা আমির
আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এখন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। শিশু থেকে শুরু করে প্রৌঢ়, শহর থেকে গ্রাম—প্রায় সবার হাতে এখন স্মার্টফোন, যার মাধ্যমে যেকোনো মুহূর্তে সংযুক্ত হওয়া যায় ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, এক্স, হোয়াটসঅ্যাপ, লিংকডইনের মতো প্ল্যাটফর্মে।
এই মাধ্যমগুলো কেবল যোগাযোগের জন্যই নয়, বরং বিনোদন ও অর্থ উপার্জনের অন্যতম উপায় হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউটিউব ও ফেসবুক কনটেন্ট নির্মাতাদের আয়ের সুযোগ করে দিয়েছে মনিটাইজেশন সুবিধার মাধ্যমে। ফলে অনেকেই এই মাধ্যমগুলোর জন্য ভিডিও তৈরি করে ঘরে বসেই অর্থ উপার্জন করছেন। তবে অর্থ আয়ের জন্য যে কেবল ভিডিও আপলোড করলেই হবে, তা নয়—প্রয়োজন নির্দিষ্টসংখ্যক ফলোয়ার, ভিউ, লাইক ও কমেন্ট।
এ কারণে কনটেন্ট নির্মাতারা বেশি সংখ্যক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন—অনেক সময় না ভেবে-চিনেই। কোনো ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়সসীমা বা প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়াই যে কেউ এখন ভিডিও তৈরি করে তা ভাইরাল করার চেষ্টায় থাকে। আর এখানেই সমস্যার শুরু। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা যখন কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নীতিমালা ছাড়াই এসব প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় হয়, তখন সহজেই তারা ভুল পথে প্রভাবিত হতে পারে।
ভিউ বাড়াতে গিয়ে অনেকে তৈরি করছে কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল ও নেতিবাচক কনটেন্ট। হাস্যরসের নামে এসব কনটেন্টে ব্যবহৃত হচ্ছে অশালীন অঙ্গভঙ্গি, বিকৃত ভাষা ও অপ্রাসঙ্গিক শব্দ। অনেক সময় ছেলেরা মেয়েদের মতো সাজসজ্জায় ভিডিও তৈরি করে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে, যা শিশু-কিশোরদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শুধু তাই নয়, রোস্টিংয়ের নামে দেশের জ্ঞানী-গুণী, শিল্পী, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নিয়ে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও বিকৃত মন্তব্য করা হচ্ছে। ‘মিম’-এর আড়ালে এসব কনটেন্টে বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ ঘটছে—যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর ইঙ্গিত বহন করে।
এ ধরনের কনটেন্টের রিচ ও কমেন্ট অনেক বেশি হওয়ায় অনেকেই সহজেই এই পথে ঝুঁকে পড়ছে। সস্তা জনপ্রিয়তা আর অল্প শ্রমে অর্থ উপার্জনের লোভে বেড়েই চলেছে তথাকথিত কনটেন্ট নির্মাতাদের সংখ্যা। এদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কদের অংশগ্রহণও লক্ষ্যণীয়ভাবে বেশি।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এখনও পর্যন্ত এসব বিষয়ে দেশে কোনো সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। ফলে তরুণ প্রজন্ম অনিয়ন্ত্রিতভাবে এই দিকেই ধাবিত হচ্ছে। এটি একটি জাতির জন্য নিঃসন্দেহে অশুভ বার্তা।
তাই এখনই সময়—সরকারকে কঠোরভাবে এগিয়ে আসার।
কনটেন্ট নির্মাতাদের বয়সসীমা, ভাষা ও বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে।
নোংরা, কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট নির্মাতাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আর্থিক জরিমানা বা আইনি শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশু-কিশোরদের ব্যবহারের বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা—রাষ্ট্র ও সমাজকে সম্মিলিতভাবে নজরদারি বাড়াতে হবে, যাতে তরুণ প্রজন্ম ভুল পথে না যায় এবং সুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। তাহলেই ভবিষ্যতের জন্য আমরা একটি সচেতন, শিক্ষিত এবং মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম উপহার দিতে পারব।
প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি