ইবনে হাকিম
বর্তমান সময়ের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন গণতান্ত্রিক প্রকাশের এক বিশাল ক্ষেত্র তৈরি করেছে, তেমনি তার অপব্যবহারও দিনকে দিন বেড়ে চলেছে উদ্বেগজনক হারে। কনটেন্ট নির্মাতা বা তথাকথিত ‘ইনফ্লুয়েন্সার’-দের একটি অংশ এখন সস্তা জনপ্রিয়তা ও ত্বরিত খ্যাতির মোহে হারিয়ে ফেলছেন ন্যূনতম শালীনতা, নৈতিকতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার অনুভব।
রাস্তাঘাট, জনবহুল স্থান কিংবা গ্রামীণ পরিবেশ—সবখানেই এখন দেখা মিলছে এমনসব ভিডিও নির্মাণের, যা শালীনতার সীমা অতিক্রম করে অশালীনতাকে প্রচার করছে বিনোদনের নামে। কোনো গান বা ডায়লগের সঙ্গে অন্তরঙ্গ অঙ্গভঙ্গি, অশ্লীল পোশাক, এমনকি বিবাহ ও সম্পর্কের মতো পবিত্র বিষয়গুলোকে ঠাট্টা-মশকরার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হচ্ছে। প্রকাশ্য নেশাদ্রব্যের ব্যবহার, সস্তা সংলাপে গালিগালাজ, নারীর অবমাননাকর উপস্থাপন—সব মিলিয়ে এইসব ভিডিও যেন সমাজকে এক ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
এ ধরনের কনটেন্ট শিশু-কিশোরদের হাতে সহজলভ্য হয়ে উঠছে, যা তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শালীনতা, ভদ্রতা, পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ—সবকিছুর ওপর পড়ছে কুপ্রভাব। তরুণ সমাজ ভুল বার্তা পাচ্ছে, ভাবছে জনপ্রিয়তা মানেই সাহসিকতা বা সীমা অতিক্রম করা।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সমাজের দায়িত্বশীল শ্রেণি—যেমন প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, বা স্থানীয় নেতৃত্ব অনেক সময় এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ না গড়ে বরং নিজেদের প্রচারণার স্বার্থে এইসব তথাকথিত কনটেন্ট নির্মাতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাখছেন। কেউ কেউ ছবি তুলছেন, ভিডিও বানাচ্ছেন, লাইভে এসে উৎসাহ দিচ্ছেন, যা পরোক্ষভাবে এই অনাচারকে বৈধতা দিচ্ছে।
অন্যদিকে, কোনো কোনো অঞ্চলে সাধারণ মানুষই এই অশালীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। গ্রামের মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করছেন, স্থানীয়ভাবে কনটেন্ট নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করছেন। এটাই আশার আলো।
এখন সময় এসেছে সারা সমাজকে জাগার, এই অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা দায়িত্বশীলভাবে কনটেন্ট তৈরি করেন, তাঁদের সামনে আসতে হবে উদাহরণ হিসেবে। প্রশাসনের উচিত এইসব অশালীন কনটেন্ট নির্মাতাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা, প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করে জনসমক্ষে অশালীন আচরণ ও অনৈতিক দৃশ্য ধারণ নিষিদ্ধ করা।
আমরা যদি এখনই রুখে না দাঁড়াই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা রেখে যাব এক ভঙ্গুর, বিকৃত এবং বিপদজনক সমাজ। তাই দায়িত্ব আমাদের সবার—সংস্কৃতিকে রক্ষা করা, শালীনতা ও নৈতিকতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া, এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলা। কারণ, একটি জাতি শুধু প্রযুক্তিতে নয়—তার নৈতিক ভিত্তি ও মূল্যবোধে টিকে থাকে।