গোপালগঞ্জে সহিংসতা
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গোপালগঞ্জে আয়োজিত শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা, সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে একাদশ সদস্যের একটি নাগরিক পর্যবেক্ষণ দল। তাঁরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, সেখানে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের যৌক্তিকতা তারা খুঁজে পাননি। একইসঙ্গে তাঁরা এই ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ তদন্তে একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।
ঘটনার পটভূমি : ২০২৫ সালের ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জ শহরে এনসিপির একটি পূর্বঘোষিত সমাবেশকে কেন্দ্র করে চরম উত্তেজনা, সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন এবং বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ২২ জুলাই একটি নাগরিক প্রতিনিধি দল গোপালগঞ্জ সফর করে।
পর্যবেক্ষণ দলে ছিলেন: আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, মোশাহিদা সুলতানা, রুশাদ ফরিদী, আইনজীবী সারা হোসেন ও মানজুর আল মতিন, সাংবাদিক তাসনিম খলিল, শিল্পী বীথি ঘোষ, লেখক ফিরোজ আহমেদ, অধিকারকর্মী নাফিউল আলম এবং একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাংবাদিক।
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ
নাগরিক দলটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে— সমাবেশ পূর্ব উত্তেজনা: আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ও এনসিপি সমর্থকদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজক, হুমকিসূচক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছিল। এনসিপির পক্ষ থেকে এর কোনো মোকাবিলা দেখা যায়নি।
সহিংসতার ইঙ্গিত স্পষ্ট : সমাবেশস্থলে হামলার আগে থেকেই শহরের বিভিন্ন সড়কে গাছ ফেলে বাধা তৈরি করা, মঞ্চ ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
প্রশাসনের প্রস্তুতির ঘাটতি : পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়নি। ফলে সংঘর্ষের সময় কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট শেষ হয়ে গেলে পুলিশ বারবার পিছু হটতে বাধ্য হয়।
প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার : প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী, লঞ্চঘাট এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে তিনজন নিহত হন। সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী নিহত দীপ্ত সাহা গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় নিরস্ত্র ছিলেন। আরও দুইজনের মৃত্যু নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে, যা গভীর তদন্ত দাবি করে।
আগ্নেয়াস্ত্রের অভিযোগ অস্পষ্ট: প্রশাসনের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকার দাবি করা হলেও তার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ মেলেনি। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরাও এমন কিছু দেখেননি।
ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি
ঘটনার পর ১৪৪ ধারা জারি হয়। পুলিশ দাবি করেছে প্রায় ৩০০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন, গণমাধ্যম সূত্রে মামলা হয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের বিরুদ্ধে। শিশু-কিশোরদের পর্যন্ত সন্ত্রাস দমন আইনে আটক করে যশোরের শিশু সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে।
তদন্ত কমিশন নিয়ে উদ্বেগ
সরকার ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন গঠন করলেও এতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি থাকায় পক্ষপাতমূলক তদন্তের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পর্যবেক্ষণকারীরা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি কমিশনের কার্যপরিধিতে নেই, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
নাগরিক পর্যবেক্ষণ দলের সুপারিশ
সহিংসতায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা : আওয়ামী লীগ ও এনসিপির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের নিরপেক্ষভাবে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হন এবং রাজনৈতিক সমাবেশের অধিকার যেন ক্ষুণ্ন না হয়।
বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধ : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য মাধ্যমে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিদ্বেষ ও উসকানিমূলক বক্তব্য রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে। সকল রাজনৈতিক দলের উচিৎ এই ধরনের বক্তব্য পরিহার করা।
আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত : শিশু-কিশোরসহ আটক ব্যক্তিদের আইনগত অধিকার সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে।
প্রশাসনের ব্যর্থতা স্বীকার : সঠিক প্রস্তুতি ও সতর্কতা থাকলে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার এড়ানো সম্ভব হতো। প্রশাসনের অবহেলা ও ব্যর্থতা তদন্ত করে দায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন : অভিযুক্ত বাহিনী ও সংস্থার সদস্যদের বাদ দিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
গুজব ও প্ররোচনার প্রতিরোধ : গোপালগঞ্জকে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল বলা বা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে প্রচার চালানো বন্ধ করতে হবে। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভিত্তিক প্ররোচনা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে।
মানবাধিকার কমিশন পুনর্গঠন : মানবাধিকার রক্ষায় কমিশনকে কার্যকর ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এর কাঠামোগত সংস্কার জরুরি।
শিশুদের অধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত : সকল নাগরিকের আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের প্রতি সহনশীলতা ও মানবিক আচরণ নিশ্চিত করা এবং নিরীহ মানুষদের যেন হয়রানি করা না হয়, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।