শূন্যতা
বাবার প্যান্টের পকেটে থাকতো একটি শূন্যতার চুইঙ্গাম;
আমাকে,
আপেল
আঙুর
বেদানা কিনে দিয়ে
পাত থেকে বারবার মাছ তুলে দিয়ে
বাবা এক জীবন চিবিয়েছেন চুইঙ্গাম;
এখন,
বাবার কবরে মুখ রেখে চিৎকার করে বলি,
গত এক সহস্র বছর ধরে আমিও তোমার ফেলে যাওয়া চুইঙ্গাম চিবুই বাবা।
শুনতে পাচ্ছো?
বাবা সিরিজ
মুষ্টি চালের মতো বাবার দু’টাকার নোট জমিয়ে রাখা;
আমার কৌশলবশত চুরিবিদ্যার অনুশীলনে পরিপক্ব শিশুক্লাস…
দশ টাকায়- কচমচ ফুলের গাছ
বিশ টাকায় গোলাপের চারা
পনেরো টাকায় মল্লিকা
সতেরো টাকায় বেলি
তিন টাকায় সল্ডেজ বিস্কুট
আমার মনে পড়ে যায়,
আমার মনে পড়ে যায়… মৃত্যুর বন্যায় সব ফুল জুঁই, জবা ডুবে গিয়েছিল গোলাপের চারা সমেত আস্ত বাগান, বাবাকে তলিয়ে নিয়ে অতল মৃত্যু বাঁধ ভাঙা ঘোলাটে জলে… থৈ থৈ ভরাট নদী
এখন…
আফসোস হয়, খুব আফসোস হয়,
মাটির ব্যাংক খসানো জাদুর বাঁকানো
ক্লিপ রেখে দিলে বাবাকে খসিয়ে
নিতে পারতাম, নয় কী? যদি
পারতাম..
ইস বোকা মেয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন ফড়িং, সবুজাভ মার্বেলের মতো ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে গেছে কালো ক্লিপ আয়ুর রূপোলি কয়েন…
ইস বাবা… ইস্
বাবা ইস্
২.
ঘুমাবার পূর্বক্ষণে কপালে শিশির জমেছিলো,
বাবা বলেছিলো
তলাচ্ছি,
নবাবী লক্ষণ স্বর্গযাত্রার;
শরীরে নেমেছিল মাঘের শীত
বাবা, বলেছিলো
ঘুমোচ্ছি
ভাঙে না যে ঘুম,
ঘুমোতে ঘুমোতে গোলাপ জল
ঘুমোতে ঘুমোতে চোখে সুরমার ঢল
বাবা চুপিসারে বলেছিল,
পালাচ্ছি,
সেই শেষ দেখা ;
হে ঘুম তুমি সকাল হও
হে ঘুম বাবাকে ফিরিয়ে দাও।
৩.
দোলায় দোলায় মুহূর্ত ভাঙে;
বয়সের নামতায় ভূতুরে অন্ধকার নামে,
বাবাও জানতেন হু?
বাবা আসলে ভিতুর ডিম; আমাকে কখনই শৈশবের দোলনা থেকে তুলতেন না।
শঙ্কায়, ভয়ে, বাবার চোখের ভেতর জাদুর ঝাউবন। ঝাউবনে দোল পূর্ণিমার চাঁদ ঝুলিয়ে রাখতেন বাবা;
চরকা কাটতে কাটতে আমার দুঃখের সুতো দলা পাকিয়ে ফেললে, বাবার চোখের মনি ওমন মেঘ ধূসর হত।
৪.
শৈশবে
সুকৌশলী চোর চুরি করে নিয়ে গেছে; বাবার স্নেহের আতরে মাখা আমার শখের থ্রি-পিস,
কৈশোরে বাবাকেও চুরি করে নিয়ে গেছে ঈশ্বর;
পাল্লায় মেপে দেখি খোঁয়া গেছে দামি যা- তাই সজ্জিত স্বর্গের বাগানবিলাস
আমার বাবা।
৫.
আদরহীনতায় মমি হয়ে যাচ্ছি, সাত লক্ষ আদল ঘুরে বাবাকে না পেয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছি ;
৬.
ক্রমান্ময়ে গত মৃত্যু থেকেও কঠিন নরকে আমাকে সেদ্ধ দিয়ে – বাবা নতুন করে মরে যাচ্ছে ;
পুনঃপুন
মরে যাচ্ছে …
কর্কশ কাক – কাআআআ – কাআআআ – কাআআআ
দূর হ….. হুশ…. হুশ.. হুউশ
কাক ছদ্মবেশী চর ;আরশের।
মাঝরাতে কুকুরের কান্নার ভয় – আমাকে ধর্ম থেকে বিতারিত করে ; আমি খোদার কালিমায়, আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী, আবার বিশ্বাস থেকে সরে আসি অযুতবার ;
আমি শির্ ক সঙ্গমে লিপ্ত হই
তোমার জন্যই বাবা।
ব্রহ্মাণ্ডে যে রাত যে ক্ষ্যাপা দুপুর, যে মেঘ- যে হাওয়া গেছে…. ওদের আত্মাও কি এসেছে ফিরে ?
বন্ধ্যা সময়। পুনরুত্থান নেই
ভেলকিবাজির খেলা। এই আছে অথচ নেই -ফুরুৎ।
সংখ্যাতত্ত্ব – ডাহা মিথ্যা বাবা – গণনায় বিশ্বাস নেই। আমার বিশ্বাস নাই গণনায়…
না জন্মের বার্ষিকী হয়
না মৃত্যুর…
যা গেছে
গেছে যা -জনমের তরে,
তোমার চলে যাওয়ার পর – দিনেরা পুনঃ জন্মায়নি ।
তুমি কি ফিরবে না
উঠোনগুলো মাদুর পেতে রেখেছে, বাবা এলেই গুড় মুড়ি এগিয়ে দেবে। বাঁশবাগানে জোছনায় লকলকে চাঁদ প্রহর গুনছে দীর্ঘদিন সুয়োরানি দুয়োরানির গল্প শুনাবার। বাবার জন্য হাঁড়িতে মোটা চালের ভাত, কুমড়ো ফুলের বড়া সাজিয়ে বসে আছেন মা, ফিরলেই খপ করে ধরে স্নানে নিয়ে যাবেন, স্নান সেরে মুগের ডাল, মাছের পাতুরি, টেঙরার ঝোল, ইলশের ডিম, শুঁটকির ঝাল ঝাল তরকারি আর শীতকালীন সবজি পাতে তুলে দিবেন। শীত এলেই–বাবার চশমার গ্লাসখানা ছানাবড়া হয়ে উঠে বাঁধাকপি শিম আলু পটলে, অথচ–আজ কাঁধে করে বাজার নিয়ে এলেও
রা -নাই,
বাক -নেই,
হৈচৈ -নেই
যেন তপসে মাছের কঙ্কালের মতো শরীর এলিয়ে শুয়ে আছেন, বেশ রাজকার্য তার, ভ্রুক্ষেপ -নেই।
ঘাসের কম্বল টেনে–
বাবা শুয়ে আছেন মসজিদের পেছনটায়
পাঁচবেলা আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে না তার
মাথায় টুপি কাঁধে জায়নামাজ নিয়ে ছুটে না আর। আচ্ছা মা কি কাল পরশু কিম্বা আগামীর সবকটা দিন টেবিলে, চায়ের কাপে, নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো হাতড়ে বেড়াবেন আরেকটি হাত? টেঙরার ঝোল নিয়ে বসে থাকবেন সমস্ত রাত?
হয়তো হ্যাঁ..
তবুও–এই শীতে,
বাবা শুয়ে আছেন
আর অপেক্ষা করছেন কবে বাড়ি ফিরব?