সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে দিন শেষে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমরা যা দেখি, ব্যবহার করি, যার সংস্পর্শে ও মিথস্ক্রিয়ায় আসি তার প্রায় সবকিছুই ভূতত্ত্ব সংশ্লিষ্ট। যেমন দাঁত মাজার টুথপেস্ট (যাতে ফ্লোরাইড আছে) ও মুখ ধোয়ার পানি; বাথরুমের টাইলস্, বাতির সুইচ ও বিদ্যুৎ, বেসিন-সিঙ্ক সব কিছুই কোনো না কোনোভাবে ভূতাত্ত্বিক উপাদানের সাথে জড়িয়ে আছে। এভাবে খাবার সংরক্ষণের ফ্রিজ, সকালের নাশতা তৈরিতে চুলার শক্তি; যোগাযোগে মোবাইল ফোন; কর্মস্থলে যাওয়ার যানবাহন ও রাস্তার নির্মাণসামগ্রী (অ্যাসফল্ট, কংক্রিট, পাথর, স্টিল); বইপত্রের কাগজ; কম্পিউটার, বাসা-কর্মস্থলের অবকাঠামো, সময় পরিমাপে ঘড়ি, বিনোদনে টেলিভিশন, স্বাস্থ্যরক্ষায় খনিজ ও ভিটামিন, অসুস্থতায় ওষুধ এমনি প্রতিটিতেই ভূতত্ত্বের সংশ্লিষ্টতা আছে। এভাবেই প্রতিদিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভূতত্ত্ব (আর্থ সাইন্স যা জিওসাইন্স বা ভূবিজ্ঞান নামেও পরিচিত) জড়িয়ে আছে আমাদের জীবনে, প্রভাব ফেলছে নানাভাবে ও নানামাত্রায়। পৃথিবীর গঠন ও সুদীর্ঘ ইতিহাসে যে প্রক্রিয়াসমূহের দ্বারা গ্রহটি বর্তমান আকৃতি পেয়েছে এবং যা আজও সক্রিয় রয়েছে সেগুলো ভূতত্ত্ব বা ভূবিজ্ঞানের আওতায় পড়ে। উল্লেখ্য যে, ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত আহরণ ও বিশ্লেষণ করেন যারা তারা হলেন ভূতত্ত্ববিদ বা ভূবিজ্ঞানী। প্রাচীনকাল থেকেই মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে ভূতত্ত্ব বিবেচনা করে— প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিরাপদ আবাস, প্রধানত নদীভিত্তিক সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা, সুপেয় পানি ও কৃষির জন্য উর্বর ভূমি, নির্মাণ সামগ্রীর প্রাপ্যতা বিবেচনায়— এগুলোর সবকিছুই ভূতত্ত্ব সংশ্লিষ্ট। ভূতাত্ত্বিক কারণে সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার অনেক নজিরও রয়েছে। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে, প্রযুক্তি অগ্রসর হয়েছে, তার চাহিদার পরিসর সম্প্রসারিত ও পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে মানুষ কাজ করে আসছে সম্পদের যোগান দিতে। তার নির্ভরতা পৃথিবী নামের এ গ্রহের ওপর।
তাই জ্বালানি (কয়লা, তেল, গ্যাস) ও নানান ধাতুর প্রয়োজনে বিভিন্ন খনিজের (তামা, অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, স্বর্ণ, রূপা, প্লাটিনাম, লিথিয়াম, সিলিকন ও রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট যা সতেরোটি ধাতব মৌলের একটি গ্রুপ); অবকাঠামো নির্মাণে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন ও নির্মাণসামগ্রী (বালি, পাথর, কাদামাটি, চুনাপাথর)-র অনুসন্ধান ও আহরণে ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। এছাড়াও কৃষিক্ষেত্রে সেচের পানি সরবরাহে; প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস ও অন্যান্য ভূ-দুর্যোগ) প্রশমন ও ঝুঁকি হ্রাস, ভূমি-ব্যবহার পরিকল্পনা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও নিরাপদ নগরায়ন, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা, জলবায়ুর অভিঘাতে প্রশমন ও অভিযোজনে ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়। ঐতিহ্যবাহী প্রত্নসম্পদকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে রক্ষায় প্রত্নস্থানের ভূপ্রকৌশলগত বৈশিষ্ট্যসমূহ বিবেচনায় রেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়গুলো আসছে।
মানুষসহ সকল প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য পানির ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং পানিকে কেন্দ্র করেই মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে ও সমৃদ্ধি লাভ করেছে। মানব স্বাস্থ্য ও কল্যাণের জন্য নিরাপদ ও মানসম্পন্ন স্বাদু পানির সরবরাহ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর মিঠা পানির ৬৯% সঞ্চিত বরফাঞ্চলে, ৩০% ভূগর্ভস্থ ও অবশিষ্ট ১% ভূ-উপরিস্থ পানিতে রয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির গতিবিধি, পানির আধারের বৈশিষ্ট্য পানির টেকসই ব্যবহারের জন্য ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। প্রধানত ভূতত্ত্ব ও ভূগঠন ভূগর্ভস্থ পানির নানা জিওজেনিক দূষক (আর্সেনিক, ফ্লোরিন) নিয়ন্ত্রণ করলেও পানির প্রবাহপথে জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি ও জলভূরাসায়নিক বিবর্তনও প্রভাব রাখে। কাজেই পানি সরবরাহ সহজলভ্য করতে ও পানি দূষণ নিরসনে ভূতত্ত্ববিদগণ সহায়তা করতে পারেন।
আমরা মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন ও তার নানা অভিঘাত সম্বন্ধে এখন জানি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস তথা সরে আসার ভাবনা হচ্ছে এবং নবায়নযোগ্য তথা ক্লিন ও গ্রিন এনার্জির কথা বলা হচ্ছে, সেখানেও আছে ভূতত্ত্ব। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত জ্বালানির উৎস অনুসন্ধান, আহরণ ও ক্ষতিকর পরমাণু বর্জ্যরে নিরাপদ ভূতাত্ত্বিক নিষ্পত্তিতে ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত ও জ্ঞান দরকার। নবায়নযোগ্য জ্বালানি যেমন বায়ু টারবাইনের, জলবিদ্যুতের জন্য বাঁধের, জিওথার্মাল ও টাইডাল এনার্জি উৎপাদনের জন্য স্থান নির্বাচনে ভূতত্ত্বের মুখ্য ভূমিকা আছে। তদুপরি বায়ু টারবাইনের, হাইব্রিড মোটর, সোলার প্যানেলের জন্য কাঁচামাল যথা রেয়ার আর্থ মিনারেল খুঁজতে এমনকি সমুদ্রের অনেক গভীরের তলদেশ থেকে খনিজ আহরণের নানা দিক নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। তবে পরিবেশ ও ইকোসিস্টেম নিরাপদ রাখাও গুরুত্বপূর্ণ, এজন্যও ভূতাত্ত্বিক গবেষণা ও দক্ষতা প্রয়োজন।
অতীতে পৃথিবীর উষ্ণ-শীতল তাপমাত্রার অনেকগুলো ওঠানামার প্রমাণ পাওয়া গেছে জীবাশ্ম, প্রবাল, সমুদ্র ও হ্রদে সঞ্চিত পাললিক শিলার রেকর্ডে। ভূতত্ত্ববিদগণ নিশ্চিত যে, কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান নিয়ামক। জলবায়ুর এমন পরিবর্তনে প্রাণীকূল বেঁচে গেলেও অনেক সময় প্রাণীর বিলুপ্তিও ঘটেছে এবং ভূতাত্ত্বিক কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনগুলো ঘটেছে। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের দ্রুত বৃদ্ধি ভূতাত্ত্বিক কারণে না ঘটে বরং ঘটছে মানবসৃষ্ট কারণে। ১৭৫০ সাল থেকে বায়ুমণ্ডলে ১৮৫০ বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড যুক্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাসে এবং ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তনসংশ্লিষ্ট সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সমুদ্রের পানির অম্লতা বৃদ্ধি ও অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস, আবহাওয়া রীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ইত্যাদি পরিণতির সাথে খাপ খাওয়ানোতে ভূতত্ত্ববিদগণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখন ভূসম্পদ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি আহরণে ভূতাত্ত্বিক দক্ষতার ব্যাপারে আরো সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভূগর্ভে সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
পরিকল্পিত ও নিরাপদ নগরায়নের জন্য ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, প্রথম পর্যায়ে স্থান নির্বাচনে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্বাচিত স্থানের পলি-শিলার ভূপ্রকৌশলগত বৈশিষ্ট্য জানতে। সঠিক ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় না নিয়ে ও সেমতে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে ভবন নির্মাণ করায় ঢাকা শহরেই ভবন ধসে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। তেমনিভাবে ভূমিকম্প দুর্যোগে ঝুঁকি হ্রাসে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য উৎস চিহ্নিত করা এবং সম্ভাব্য ঝাঁকুনি ও তার প্রভাব বিষয়ে সতর্ক হতে বিল্ডিংকোড প্রণয়ন করা হয়েছে— তা মেনে চলা ও সচেতন হতে ভূতত্ত্ববিদগণ প্রতিনিয়ত পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তারা পাহাড় কাটা এবং নদীবক্ষ ও প্লাবনভূমি হতে যথেচ্ছভাবে বালু উত্তোলন থেকে বিরত হতে, অপরিকল্পিত নগরায়ন না করতে, জলাশয় ও নদী ভরাটের মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা থেকে বিরত থাকতে, পানি-মাটি-বায়ু দূষণের মারাত্মক কুফল সম্বন্ধে সাবধান করে আসছেন। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো আমরা নানা ক্ষেত্রে ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্তের ও জ্ঞানের প্রয়োগ করি না বলে বর্তমানে আমাদের যেমন খেসারত দিতে হচ্ছে ভবিষ্যতেও দিতে হবে হয়তো আরও বড় মাত্রায়।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, সবখানেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূতত্ত্বের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কাজেই আমাদের জ্বালানি চাহিদা পূরণে, খনিজসম্পদ আহরণে, পরিকল্পিত ভূমি-ব্যবহারে, নিরাপদ নগরায়নে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়, অবকাঠামো বিনির্মাণে, পানি ও খাদ্যের নিরাপত্তা বিধানে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে, পরিবেশ রক্ষায়, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রশমন ও মোকাবিলায় ভূতত্ত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এমনকি ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত সংশ্লিষ্ট আদালতে উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয়েছে যে সমুদ্রের এ অঞ্চলে আমাদের দেশের অধিকার রয়েছে এবং সমুদ্রবিজয় সম্ভব হয়েছে। জনসংখ্যা ও সম্পদের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে এবং উচ্চতর ও টেকসই জীবনমানের আকাঙ্ক্ষায় একুশ শতকের বিশ্ব অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, এগুলো নিশ্চিত করতে চাই গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও দক্ষ ভূবিজ্ঞানী।