বদরুলের সঙ্গে পরিচয় ঢাকার রাস্তায়। পেশায় রিকশাচালক। খর্বকায়, কালো। তবে শরীর স্বাস্থ্য ভালো। উত্তরবঙ্গের এক জেলা থেকে এসেছে। থাকেন কামরাঙ্গীরচরের কাছে সেকশন ঢালে। এক রিকশা গ্যারেজেই তার থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। রাস্তাঘাট কিছুটা ফাঁকা। আমি যাব জিগাতলা। ফার্মগেটে রিকশায় উঠে পান্থপথ আসতেই সিগন্যালের ফাঁড়া। বদরুল রিকশাটা সাইড করে। বলে, ‘চাহাজি একটু থামা নাগবে?’
‘কী বিষয়? থামা লাগবে কেন?’
‘পেচ্চাব’
‘মানে কী? রাস্তায় কোথায় বসবে?’
‘সমেস্যা নাই। ফুটপাতে ব্যবস্থা আছে।’
‘আমার একটু তাড়া আছে। না করলে হয় না’— কথা বলেই মনে হলো প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দিয়ে আমি আবার ফ্যাসিস্ট আচরণ করছি না তো?
‘বাহে, ঢাকা শহর। জাগা পাওয়া মুশকিল। তোমরা জুত করি বসি থাকো। মুই যাইম আর আসিম।’
হ্যাঁ, তাইতো। ঢাকার পথে এই যাওয়া আসা ছাড়া জুত করে প্রাকৃতিক কর্ম সারার জায়গা কোথায়? রিকশাওয়ালা আর শ্রমজীবীদের বিপদটা বেশি। তাই পান্থপথ, কারওয়ান বাজার, সায়েন্সল্যাবের ফুটপাতে যান। ঝাঁঝালো গন্ধের চোট।
রিকশায় গাট হয়ে বসে রইলাম। আড়চোখে দেখি রিকশাওয়ালা পানি ভবনের দিকে মুখ করে নির্গত করছে পানি। মাথা নিচু নিচু করে বসে আছে। ফুটপাত ধরে নারী পুরুষরা হাঁটলেও পাশ কেটে যাচ্ছে অনায়াসে। ফুটপাত ঘেঁষে রিকশার গ্যারেজ আর ছোট ছোট টি স্টল। খাবারের দোকান। অনেক রিকশাচালক বসে, দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে। গাল গপ্পোও করছে কেউ কেউ।
কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো রিকশাওয়ালা। সিগন্যাল কিলিয়ার হয়েছে মাত্র।
ধানমন্ডি ৩২ হয়ে রিকশা ছুটছে। ভাষা শুনে মনে হয়েছে দেশি ভাই। তাই রিকশাওয়ালার সঙ্গে খানিকটা বাতচিৎ করতে চাইলাম।
‘তোমার নাম কী?’
‘মোর নাম বদরুল মিয়া’
‘বাড়ি কোথায়?’
‘বাড়িঘর ছাড়ো, গরিব মানুষের ফির ঠিকানা কী! উলিপুরের হাতিয়া। নদীভাঙা মানুষ।
‘ভালো। তা রিকশা নিজের না, ভাড়া?’
‘নিজের ফির কোটে পান। ভাড়া খাটি। জমা ১২০ টাকা ডেইলি।
বদরুলের সঙ্গে গল্প করতে করতে পথ মনে হয় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ধানমন্ডি শংকরের আই হসপিটাল পার হয়ে কিছুদূর যেতেই বদরুল আচমকা গ্যাঞ্জামে জড়িয়ে পড়ল।
এক মোটরসাইকেল চালক রং সাইডে বদরুলের রিকশায় হালকা ধাক্কা দিয়েছে। দেখি, রিকশার চাকার উপরে মার্টঘাট একটু মুখ ব্যাদান করে আছে। আর যায় কোথায়? বদরুল রিকশা সাইড করে এক দৌড়ে গিয়ে মোটরসাইকেল চালকের শার্টের কলার ধরে টানা-হেঁচড়া শুরু করে দিল। এরপর মুহূর্তের মধ্যে ওই চালক দেখি মাটিতে শুয়ে। দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছে। মনে হচ্ছে জব্বারের বলি খেলা।
আমি মোটরসাইকেল চালককে দেখছি না। দেখছি তার নীল রঙের হেলমেটটি। একবার ডানে একবার বামে হেলমেট গড়িয়ে পড়ছে। কাছে পিঠে কোথায় মনে হয় একজন পুলিশ সদস্য ছিল। ছুটে এসে তিনি এই দৃশ্য উপভোগ করছেন। তবে পুলিশ সদস্য কোন জায়গা থেকে শুরু করবেন, বুঝতে পারছেন না মনে হয়। হাতে একটা বাঁশি থাকলে ভালো হতো। সেটাও নেই। পথচারীরা বেশ জমিয়ে এই কুস্তিযুদ্ধ উপভোগ করছে। হাসাহাসি, টিটকারিও চলছে। কেউ ঝগড়া মেটাতে বিশেষ উৎসাহী বলে মনে হলো না।
আমি পড়েছি মহামুসিবতে। না পারছি রিকশা ছেড়ে দিতে, না পারছি বদরুলকে থামাতে। অজান্তে আমিও বদরুলের কা দেখে ফেঁসে গেছি। তবে পাশের এক দোকান মালিক ছুটে এসে সাহস নিয়ে মল্লযুদ্ধে রাশ টানলেন। মোটরসাইকেল চালক বেচারা মনে হয় কোনো অফিসে জব করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বদরুল তখনও রাগে ফুঁসছে। গজর গজর করতে করতে রিকশার প্যাডেলে পা রেখে চালাতে শুরু করল। পেছনে আমার দিকে ফিরেও তাকালো না।
আমি ভিতু মানুষ। বদরুলের বদমেজাজ থেকে থমকে গেছি। একে সাবধানে ডিল করতে হবে। ভাড়া নিয়ে ঝামেলা করা যাবে না। উনিশ বিশ হলে প্যাসেঞ্জারের উপর চড়াও হতে পারে। শেষে নাকে ব্যান্ডেজ নিয়ে সোজা ঢাকা মেডিকেল!
গুটিসুটি মেরে রিকশায় বসে আছি। কথা বলছি না। বদরুল কথা বলতে শুরু করে।
‘চাহাজি। ভয় পাইছেন নাকি বাহে? এইগল্যা মোর ডাইন হাতের মইল্যা। মোর সাতে তেড়িবেড়ি করলে তার খবর আছে?
‘তুুমি কী প্রায়ই এই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ো নাকি।’
বদরুল হাসে। তার পান জর্দা খাওয়া খয়েরি দাঁতগুলো বেরিয়ে আসে কালো মাড়িসুদ্ধ। ব্রহ্মপুত্র নদে বড় জালে বোয়াল মাছ ধরা পড়লে যেমন হাসে চরের মানুষ, বদরুলের চোখে মুখে সেই কিসিমের হাসির দ্যুতি।
‘একটা একের কতা কইছেন চাহাজি। মুই কিন্তুক কাকো ভয় করোং না। কাইল এক চেংরা ভাড়া কম দিয়া যাবার ধরছে। মুই আপত্তি করছোং জন্যে মোক মফিজ কয়া গাইল পাচ্চে। মুইও কয়টা চর থাপড় দিছোং। আশপাশের লোক না আসলে উয়ার টুটিত পারে ধরনুং হয়।’
‘কী সাংঘাতিক! তুমি কী প্রায়ই মারামারি করো নাকি?’
‘সপ্তাহে দুই তিনটা হয়। দুইব্যার জেলোও খাটচোং।’
‘তা একটু রাগ কমালেতো হয়। এটাতো তোমার গ্রাম না?’
‘আরে বাহে মোক মফিজ কইলে মোর মাতা ঠিক থাকে না। দুইটা ডাং না দিলে প্যাটোত দানা দিবার পাং না। সিটের নিচোত দুখনা ছোট নাটি আছে। বাড়ি থাকি বানে আনছোং। নল বাঁশের।’
লাঠির কথা শুনে আরো ঘাবড়ে গেলাম। বদরুল এক দাঙ্গাবাজ ক্যারেক্টর। একে বাগে আনা কঠিন হবে। ভাবছি, রিকশা থেকে দ্রুত নামতে পারলে বাঁচি। বদরুলের চোপায় মনে হয় কথার বান ডেকেছে। বলেই যাচ্ছে।
‘চাহাজি, তোমরাই বিচার করো, হামরা ধান আবাদ না করলে ওমার পেটোত ভাত যায় না। আলু, তরকারি সাপ্লাই না দিলে ওমার হাঁড়ি চরে না। আর সুযোগ পাইলে হামাক রংপুরের মফিজ কয়া গাইল পাড়ে। মোর সহ্য হয় না।’
আমার গন্তব্যের কাছাকাছি এসেছে রিকশা। একটু পর নেমে যাবো। বদরুল জোস পেয়ে বলেই যাচ্ছে মেইল ট্রেনের মতো গতিতে।
‘এক শালার ব্যাটাক খুঁজব্যার নাগছোং চাহাজি। মোক বোকা বানাইছে।’
‘তোমাকে বোকা বানিয়েছে? বলো কী?’
‘আল্লার কিরা কতা সত্য। গত মঙ্গলবারের কতা। ইনভার্সিটির এক ছাত্র একটা মেয়ে নিয়া রিকশায় চড়চে। ঘন্টা চুক্তি। ঘন্টায় দুইশ টাকা। রিকশাত চড়ি ইটিশ পিটিশ আল্লাপ। বুঝনুং ঘটনা আছে। দুপুর দুইটার দিকে চরচে। ধানমন্ডি লেক, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, ইনভার্সিটি ঘুরিয়া রাত আটটার সমায় হাতিরপুলে নামি কয় একটু অপেক্ষা করো, এলাকায় আসপ্যার নাগছি।’
‘তারপর? আমিও গল্পের তালে দোল দিয়ে যাচ্ছি।’
‘আরে বসি বসি শখানেক মশা মারিও কোনো লাভ হয় নাই। বুঝপার পাইছোং, শালা ভাগছে। দশটার পর শালাক গাইল পারতে পারতে গ্যারোজোত গেইছোং। এলা পত্তেক দিন আস্তাত উয়াক খোঁজোং। এই শালা ছাত্র থাকতে এই অবস্থা, চাকরি করলে ওয় দ্যাশ ব্যাচে খাইবে। উয়ার দেখা পাইলে কল্লা নামে নেইম তোমাক কয়া দিনোং।’
বুঝলাম বদরুল তেতে আছে। রগচটা এই লোকটার মেজাজের আগুনে ঘি ঢালা ওই ছাত্রের দেখা পেলে অঘটন ঘটে যেতে পারে।
ভাবনার ঘোর কাটতে না কাটতে পৌঁছে গেছি গন্তব্যে। জিগাতলা পোস্ট অফিসের কাছে নেমে কয়েক কদম হাঁটতেই পেছনে শোরগোল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সিএনজিওয়ালাদের সঙ্গে বদরুলের হাতাহাতি চলছে। ঝামেলায় জরানোর শঙ্কায় পেছনে ফিরতে পারলাম না। দেশি ভাইকে অরক্ষিত রেখে এগিয়ে গেলাম সামনে জোর কদমে।
কুড়িগ্রাম থেকে
4