এশিয়ার দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কের হুমকি বিশ্ব বাণিজ্যে বড়সড় ধাক্কা দিতে চলেছে। বিশেষ করে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিগুলোর জন্য এটি এক নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা ট্রাম্পের ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণাকে ‘গভীরভাবে দুঃখজনক’ বলেছেন। জাপান দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক উত্তেজনা এড়াতে বারবার আলোচনায় বসলেও সেগুলোর কোনো ফল আসেনি। এমনকি চলতি বছরে সাতবার ওয়াশিংটন সফর করেও ট্রাম্প প্রশাসনের মন গলাতে পারেনি টোকিও।
ট্রাম্প সম্প্রতি ২৩টি দেশকে নতুন শুল্ক আরোপের নোটিশ দিয়েছেন, যার মধ্যে ১৪টি দেশই এশিয়ার। এই তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মতো অর্থনীতি, যারা মূলত রপ্তানিনির্ভর উৎপাদন খাতে নির্ভরশীল।
শুল্ক বাড়ানোর হুমকি, সময় সীমিত
ট্রাম্প বলেছেন, আগামী ১ আগস্টের মধ্যে এসব দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে, নইলে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক কার্যকর হবে। এনবিসি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প জানান, “বাকি সব দেশকে এখন থেকে ১৫ বা ২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে—এই হিসাব এখন ঠিক করা হচ্ছে।”
ট্রাম্প আরও স্পষ্ট করে দেন, শুল্ক আর অস্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অর্থনৈতিক কৌশলের অংশ।
জাপানসহ মিত্ররাও ক্ষতিগ্রস্ত
জাপান যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা মিত্র হলেও, ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে তারা এখন আর আলাদা কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। জাপান ইতোমধ্যে চালের বাজার উন্মুক্ত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং মার্কিন সামরিক খাতে অতিরিক্ত ব্যয় বহনের চাহিদাও প্রত্যাখ্যান করেছে।
জুলাই মাসে জাপানের উচ্চকক্ষের নির্বাচন থাকায় আগস্টের মধ্যে কোনো চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবু ট্রাম্পের হুমকির পরপরই জাপান জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তায় শত শত পরামর্শ কেন্দ্র চালু করেছে।
আলোচনার সুযোগ ও বিভ্রান্তি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প যেসব দেশকে শুল্ক হুমকি দিয়েছেন, তাদের অনেকেই এখন আলোচনার জন্য চাপ অনুভব করছে। ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংকের গবেষণা প্রধান সান টেক কিন বলেন, “আশার কথা হলো, সময়সীমার আগেই আলোচনা শুরু হতে পারে।”
তবে ট্রান্সশিপমেন্ট বা চীনের পণ্য অন্য দেশের মাধ্যমে ঘুরিয়ে রপ্তানির ক্ষেত্রেও বাড়তি শুল্ক আরোপের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা আরও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যালেক্স ক্যাপরি বলেন, “শুল্ক আরোপের কাঠামো এত জটিল যে, এটা বাস্তবায়নে বহু সময় লাগবে।”
কে জিতছে, কে হারছে?
বিশ্লেষকদের মতে, এ শুল্ক যুদ্ধ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীনের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। ট্রাম্প সময়সীমা বাড়িয়ে নিজেই নিজের অবস্থান দুর্বল করে ফেলেছেন। চীনের কাছে এটি এখন কৌশলগত সুযোগ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে চীনের বিকল্প খোঁজা সহজ নয় বলেও মনে করছেন অনেকে।
চীন এখন নিজেকে ‘স্থিতিশীল’ ও ‘দায়িত্বশীল’ বানিজ্য অংশীদার হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তাদেরও নানা টানাপোড়েন রয়েছে।
এশিয়া সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত
বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশ ইলেকট্রনিকস, পোশাক, নির্মাণ উপকরণসহ রপ্তানিনির্ভর শিল্পে সাফল্য পেয়েছে, তারা এখন বড় ধরনের ধাক্কার মুখে। এই শুল্কের কারণে এসব দেশের উৎপাদন খরচ বাড়বে, কমবে প্রতিযোগিতাশক্তি।
অধ্যাপক অ্যালেক্স ক্যাপরি বলেন, “এটা কার জয় বা হার, সেই প্রশ্ন নয়—প্রশ্ন হলো কে কতটা টিকে থাকতে পারবে। আর এই বাণিজ্যবিরোধের সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়, বরং কয়েক দশকও লাগতে পারে।”
সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ:
জাপান: মিত্র হলেও ছাড় পায়নি, নির্বাচনী কারণে আপাত সমঝোতা অনিশ্চিত
চীন: চাপের মুখে হলেও কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে
ভিয়েতনাম: দ্রুত চুক্তি করলেও প্রভাব কমানোর সক্ষমতা সীমিত
ভারত: এখনো চিঠি না পেলেও আলোচনায় জড়িত
যুক্তরাষ্ট্র: শুল্ক কৌশলের মাধ্যমে চুক্তির জন্য সময় কিনছে, তবে রাজনৈতিক নাটকও তৈরি হয়েছে