আমেরিকান লোকজন চা-বিস্কুট ঘুষ খেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে, নাকি তাদের হাতে গোপনে গুঁজে দিতে হয়েছে একশ ডলারের নোটখানা— সেটা তাদের ব্যাপার। আবার কমলা হ্যারিসের সঙ্গে কারও ফসলি জমির আইল ঠেলাঠেলির সম্পর্ক ছিল কিনা— সেটাও ওরাই বুঝবে! পরদেশি নির্বাচনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বদেশে পৌঁছালে কেমনটা লাগে গ্রামবাসীর!
রুহিতনপুরের আকাশে বাতাসে জমিনে বর্তমানে একটাই গবেষণা— ট্রাম্প কেন জিতলেন, কমলা কেন হারলেন! জাতীয় রাজনীতি থেকে এরা আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষণে এত দ্রুত হয়তো যেত না; লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত করে দিয়েছে রুহিতনপুর গ্রামের পুরনো এক দম্পতি।
কাবিল হোসেন বরাবরই কোনো কারণ ছাড়াই ট্রাম্পের অন্ধভক্ত। ট্রাম্প নির্বাচনে প্রার্থী হলে কাবিল ফেসবুক স্ট্যাটাসে দিয়ে ভোট চায়। আমেরিকান ভোটারদের সঙ্গে তার দেখা সাক্ষাৎ না হওয়ার কারণে ওই দেশেরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে পাশে থাকে। অন্যদিকে কাবিল-পত্নী জরিনা আক্তার বরাবরই নারীর ক্ষমতায়নকামী। আগেরবার হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন দিয়ে সে নিজের মান-সম্মান নামক জামানত খুইয়েছে, এবারও পরিস্থিতি অনুকূলে এল না! জরিনা চেয়েছিল কমলা জিতে টুকটুকে আপেল হয়ে যাক। কমলা জিতলে তার সঙ্গে পান-সুপারি খেতে খেতে গল্পগুজব করা যেত না সত্য, মনে শান্তি আসত ঠিকই। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের শুরু থেকেই কমলার নিকটতম প্রচার-প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল নিজ স্বামীই। কাবিল কায়মনোবাক্যে চেয়েছিল পাগলা ট্রাম্প জিতুক। গোঁয়ারগোবিন্দ পাগল ছাড়া সংকটকবলিত পৃথিবীকে টেকানো যাবে না। ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পরপরই আনন্দের আতিশয্যে এলাকায় পোস্টারিং করে কাবিল—
বিশাল ব্যবধানের ভোটে বিজয়ী হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ভাইকে উষ্ণ অভিনন্দন!
জরিনা বোঝানোর চেষ্টা করল, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। ঘায়েল করার জন্য এটাও বলল, ‘আমারে শাড়ি-গয়না দিবার পারো না, ঠিকই টেরাম ব্যাডার ছবি দিয়া পোস্টার ছাপাইতে পারো! কারচুপি হইছে, সঠিক ভোট অইলে কমলা আপারই জিতনের কতা!’
মাথা ঠাণ্ডা রেখেই কাবিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে— ‘বেশি বুঝস? কমলায় যেইডা কয় নাই, তুই কস ক্যা?’
‘মুকে কইব ক্যান! বেডি আমার মতো ভালা মানুষ বইলা চুপ মাইরা আছে। অধিক শোকে পাত্থর।’
বউয়ের মনোজ্বালাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিতে কাবিল গুনগুন গান ধরে— ‘তোমরা দেখো গো আসিয়া/ কমলায় কান্না করে থমকিয়া থমকিয়া…’।
‘খাড়াও, তোমার গান বাইর করতাছি।’
কাবিল হাসে— ‘রাগস ক্যান! তোর নামেই আছে ‘না’, জরি-না। কমলার নামের লগে আছে ‘হারিস’। তোরা পারবি ক্যামতে?’
পেরে না উঠে জরিনা সমবেদনা জানিয়ে কমলাকে চিঠি লেখতে বসে—
চরম শ্রদ্ধেয়া কমলা বুবু,
মনে দুঃখ নিয়েন না। জীবনে হার-জিত থাকবই। আমিও কি সংসারে হারছি না? হাড়-মাংসরে কিমা বানাইতেছি। তবুও জামাইয়ের মন পাই না। আপনের জামাইডা কেমন? আপনের লগে ভালা আচরণ করে? রুজি-রোজগার আছে? ভাত-কাপড় ঠিকমতো দিবার পারে তো?
মন খারাপ কইরা লাভ নাই। আমরা এক থাকলে একদিন ঠিকই জিতমু। বেডা মাইনষেরা আমগোরে দিয়া আর কতদিন হান্ডি-পাতিল ঠেলাইব! আপনে কী তরকারি রানতে পছন্দ করেন, জানাইয়েন।
ইতি—
আপনের ছোড বইন
জেরিন ওরফে জরি
জরিনা খাম কিনে আনতে বলায় কাবিল চিঠিটা পড়ে দেখতে চায়। ওর কিংবা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোনো বদনাম লিখেছে কিনা দেখে নেওয়া ভালো! বদনাম নেই তবুও মাথা গরম হয় তার— ‘বাংলায় লেখছস ক্যান, তোর মাল্টা আপায় কি বাংলা-শিক্ষিত?’
বিষয়টা আগে মাথায় আসেনি। জরিনাও ইংরেজি জানে না। এখন উপায়!
মিনমিন করে জরিনা বলে, ‘আইচ্ছা, তাইলে তুমিই লেইখা দাও।’
‘মশকরা করছ তুই আমার লগে! আমি ইংরাজি জানি?’
জরিনা মনে করার চেষ্টা করে, পরিচিতদের মধ্যে কে ভালো ইংরেজি জানে। কাকে দিয়ে চিঠিটা লিখিয়ে নেওয়া যায়। বিরক্ত হয় নিজের প্রতি— কেন সে ছোটবেলায় ইংরেজিটা ভালোমতো শিখল না!
বউয়ের বিপদ মানে নিজেরও বিপদ। মাথা ঠাণ্ডা হলে কাবিল বলে, ‘চিডি অনুবাদ কইরা পাডাইতে অইব। তবারকগঞ্জে কম্পিউটার কম্পোজের দোকান আছে। তারা অনুবাদও কইরা দেয়। আমি ব্যবস্থা করতাছি।’
অনুবাদ করিয়ে আনার পর আরেকটা সমস্যা দেখা গেল। আপার ঠিকানা কেউই জানে না! বিকল্প হিসেবে জরিনা মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী ছোটভাই কুতুবের শরণাপন্ন হতে হলো। সে যেন ছুটির দিনে চিঠিটা আপুর হাতে হাতে দিয়ে আসে। লোক মারফত পাঠানো চলবে না। কুতুব জানায়, তার ছুটি বা ভিসা কোনোটাই নেই।
বউ মুষড়ে পড়লে কাবিল দয়াপরবশ হয়ে বলে, ‘তুই নিজেই আমেরিকার ভিসা নিয়া নে। আপার লগে দেখা কইরা আইলি আর ট্রাম্প ভাইয়ারে আমার সালামও পৌঁছাইয়া দিলি!’
প্রস্তাবটা পছন্দ হয় জরিনার। নিজেই যাবে তবারকগঞ্জের দোকানে। হঠাৎ উপকারি হয়ে ওঠা সংসারবন্ধু কাবিলকে খুশি করার জন্য বলে, ‘দেখ না ট্রাম্প ভাইরে দিয়া তোমার টেইলারের দোকানের কোট-প্যান্টের মডেলিং করাইতে পারো কিনা। তাইলে দেশ-বিদেশের ম্যালা কাস্টমার পাইবা।’
বুদ্ধিটা পছন্দ হয় কাবিলের। ট্রাম্প মডেলিংয়ের অফার গ্রহণ করলে ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠবে দ্রুত। স্যুট-কোটে তো লাল ব্যাটাকে দারুণ স্মার্টই লাগে। সবচেয়ে ভালো লাগে তার একরোখা মনোভাব।
এই প্রথমবারের মতো স্বামীর সঙ্গে জরিনাও ট্রাম্পকে পছন্দ করতে শুরু করে। গ্রামে-গঞ্জে পোস্টারিং করেছে কাবিল, এটা ইউটিউবে ট্রাম্পের চোখে পড়বে না? পড়লে নিশ্চয়ই। কাবিলের ট্রাম্পপ্রীতির খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, কাবিল ও ট্রাম্পের ছবিও ছাপা হয়েছিল পাশাপাশি। প্রস্তাবটা পৌঁছাতে পারলে ট্রাম্প হয়তো আপত্তি করবেন না। মনোবিধানের বাইরে এসে জরিনা প্রস্তাব দেয়— আমেরিকার হোয়াইট হাউসের সঙ্গে মিলিয়ে তারাও সাদা বাড়ি বানাবে। তারপর ট্রাম্প ভাইকে ডাল-ভাতের দাওয়াত দেবে। তিনি এলে সাদা বাড়ি ও মডেল হওয়া দোকানের ফিতা কাটবেন একদিনেই। প্রেসিডেন্টের সময়ের দাম আছে না!
আপন মনে করে ওরা ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের সঙ্গেও বিষয়টা শেয়ার করে। কিন্তু লোকজন বাহ্বা দেওয়ার বদলে উল্টো মুখ লুকিয়ে হাসে। এবার যৌথ তেলে-নুনে না জ্বলে উপায় থাকে না আমেরিকাপ্রেমী দম্পতির। তাদের অভিন্ন বক্তব্য— আমাদের সাদা বাড়িতে যদি ট্রাম্প ভাইয়া বেড়াতে আসে, তোদের সমস্যাটা কী? অতিথির জন্য ভাত তোরা রাঁধবি, নাকি আমরা!
দুই.
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন মানেই যেন ‘ওড়াওড়ি মৌসুম’। বাতাসে প্রতিশ্রুতির বন্যা ভাসে, কচকচে নোট আসে, গরম চা আর সিগারেটের ধোঁয়া হাসতেই থাকে। রুহিতনপুরে নির্বাচনী আমেজে মাইক বাজে, ধুলা ওড়ে বাজারে, ফসলি জমিতে, আর ওড়ে টাকা। এত্তগুলো টাকা কোত্থেকে জড়ো হয়, কীভাবেইবা আসে অজপাড়াগাঁয়ে— বুঝতে পারেন না ময়মুরব্বিরাও। ঈদানন্দ নিয়ে আসে ভোট-আয়োজন। চলন্ত রিকশা-ভ্যানে মাইকে বাজতে থাকে জয়ধ্বনি।
ভোটের গল্পে নতুন ব্যঞ্জনা যুক্ত করে কাবিল হোসেন। যে-ই ভোট চাইতে আসুক, আপ্যায়ন করাবেই। এতে প্রচারকারীদের পাশাপাশি গ্রামবাসীও হকচকিয়ে যায়। অল্প সময়েই আশপাশের চৌদ্দগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে কাবিলের বোকামির সংবাদ। কাবিলের বউ জরিনা আরেক কাঠি সরেস, বাড়তি রান্নাবাড়ায়ও আপত্তি নেই। এই দম্পতির অভিন্ন ভাষ্য— মেহমান হচ্ছে লক্ষ্মী। লক্ষ্মী বারোমাস কারও বাড়িতে আসে না। শুধু ভোটপ্রার্থী কেন, ভিনগাঁয়ের কাউকে আশপাশে দেখলেও ডান হাতের কাজটা সারিয়ে দেয় কাবিল।
অনেকের মনেই চিন্তাটা গোত্তা খায়— কাবিল এত টাকা পেল কোথায়? সেও কি আগামীতে ভোটে দাঁড়াবে! প্রাথমিকভাবে ‘জনসেবা’র নমুনা দেখাচ্ছে। গুঞ্জনের পথ ধরেই কাবিলের খরচাপাতির ভালো বন্দোবস্ত হয়ে যায়। সুনাম ছড়াতে থাকলে তার ‘জরিনা লেডিস অ্যান্ড জেন্টস টেইলার্স’-এ খদ্দেররা ভিড় বাড়ায়। এমনকি যার পর্যাপ্ত পরিধেয় আছে সেও বাড়তি একটা পোশাক বানিয়ে নেয় কাবিলের কাছ থেকে। ব্যবসা বাড়তে থাকলে অতিথি আপ্যায়নে আরও ‘আগ্রাসী’ হয় কাবিল-দম্পতি। ভোট নিয়ে যতই উচ্ছ্বসিত ভাব দেখাক, গোপন একটা দুঃখ বহুবছর মনে খচখচ করে। বৃষ্টি-বাদলার দিনে দোকানে আসতে হয় কাদা-পানি মাড়িয়ে। বাদল চেয়ারম্যান এলাকায় প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ করলেও বঞ্চিত হয়েছে রুহিতনপুর। এখানকার বাসিন্দারা নাকি তাকে ভোট দেয়নি!
সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছেন— এমন সন্দেহ থেকেই এলাকাটাকে রেখেছেন উন্নয়নবঞ্চিত। সব গ্রামের রাস্তা পাকা হলেও এখানে কোনো পাকা রাস্তা নেই। চেয়ারম্যানের ষড়যন্ত্র— শত্রু-এলাকার লোকজনকে আরামে হাঁটতে দেবেন না। উন্নয়ন না করলে কেমন লাগে বুঝুক। যেমনটা বুঝেছিলেন চেয়ারম্যান নিজে— নিরঙ্কুশ ভোট না পেয়ে!
বর্ষাকাল শুধু নয়, রোদ-কালেও তেমন একটা স্বস্তি পায় না কাবিল। কাঁচা রাস্তা থেকে ধুলো ওড়ে। নাকে-মুখে যাওয়ার পাশাপাশি ধুলাবালি নতুন পোশাক-আশাকগুলোর রঙচঙা অবয়বকে ফ্যাকাসে বানিয়ে দেয়। মনের দুঃখটা পুষে রাখে কাবিল। এই গ্রাম থেকে কেউ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে তিনি নিশ্চয়ই রাস্তা সংস্কার করবেন। সব টাকা ঢাকায় বা আমেরিকায় নিয়ে জমাবেন না। এমন আশায় বুক বাঁধে রুহিতনপুরবাসী। এর মধ্যেই আবার এল ভোট। ভোট এলেই গ্রামবাসী জাগে নতুন আনন্দে। কাবিলও জেগে উঠল বিলে নতুন পানি পাওয়া মাছের মতো!
নির্ধারিত দিনেই ভোট সম্পন্ন হয়। একটি মাত্র ভোটে হেরে গেছেন রুহিতনপুরের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আজমল। আঁতিপাঁতি করে অনুসন্ধানে নেমেছেন তিনি— কোনো বেঈমান ভোট দেয়নি তাকে! কেন সর্বনাশটা করল! রাখঢাক না করে একপর্যায়ে সরল স্বীকারোক্তিটা দেয় কাবিল— সবাইকে ভোট দিয়েছে সে। ব্যালট পেপারের কোনো মার্কাই বাকি রাখেনি। যেহেতু সবাইকে কথা দিয়েছিল— চোট দেবে না, ভোট দেবে!
কিন্তু সত্য ভাষণ শুনে হারু চেয়ারম্যান যে কাবিলের ঠোঁট ফাটিয়ে ফেলবেন— রুহিতনপুরবাসীর কল্পনারও অতীত ছিল।