
ছোটবেলায় দেখতাম অনেক ফেরিওয়ালা আসত গ্রামে। আমরা ছোটরা ফেরিওয়ালার অপেক্ষায় থাকতাম। কত ফেরিওয়ালা! নানান সব জিনিসপাতি নিয়ে হাজির হতো। কেউ বাদাম, কেউ বুট, বুন্দিয়া, আইসক্রিম, কটকটি আরও কত কী! তবে সবচেয়ে বেশি যে ফেরিওয়ালার প্রেমে পড়েছিলাম সে বুন্দিয়াওয়ালা। বুড়ো এক বুন্দিয়াওয়ালা। দেখতে লম্বা আর চিকন। আমার নানার দেশের মানুষ। আর এই সুযোগে তিনি প্রায় দিনই আমাদের বাড়িতে আসতেন। লম্বা করে হাঁক দিতেন— এই বুন্দিয়া…। আর কে থাকে বাড়ির কোণায়! দৌড়ে ছুটে যেতাম বুন্দিয়াওয়ালার কাছে। ততক্ষণে আরও কিছু ছেলেমেয়ে বুন্দিয়াওয়ালাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। আমিও ওদের সাথে যোগ দিতাম। তারপর একে একে আমাদের সবার হাতে এক-দুই দানা করে বুন্দিয়া তুলে দিতেন। আমরা পরম সুখ নিয়ে জিহ্বা দিয়ে চেটে নিতাম। যেন অমৃত খেলাম। ফ্রি খাওয়া শেষ। এখন বাড়ি থেকে ধান, চাল অথবা টাকা-পয়সা আনতে হবে। বুড়ো বুন্দিয়াওয়ালার কৌশলটা ছিল অভিনব। আমরা তখন যার যার মতো বাড়ি যেতাম। যে যার মতো যা পেতাম নিয়ে আসতাম। কলার পাতায় তুলে দিতেন অমৃত রসের দানাদার বুন্দিয়া। নানার দেশের মানুষ। তাই আমিও নানা বলে ডাকতাম। বুন্দিয়াওয়ালা নানা আমাকে তাই বাড়তি খাতিরও করতেন। কোনো কোনোদিন ধান বা চাল আনতে পারতাম না। তখন তিনি মাকে ডাকতেন। মায়ের নাম ধরে ডাকতেন। মা বেরিয়ে আসতেন ধান নিয়ে। সেদিন একটু বেশি করেই নেয়া হতো। পরিবারের সবাই মিলে খেতাম। দুপুর ওয়াক্ত হলে মা বুন্দিয়াওয়ালাকে ভাত খেতে দিতেন। নানার বাড়ির খোঁজ নিতেন। কিংবা নানার বাড়িতে কোনো সংবাদ পাঠাতেন। খাওয়া শেষ করে বুন্দিয়াওয়ালা বের হতেন। কাঁধে তার অমৃতরসের বাইক।
গরমের মৌসুমে আসত আইসক্রিমওয়ালা। নানান স্বাদের সব আইসক্রিম। মালাই আইসক্রিম, নারকেলি আইসক্রিম। একেকটার স্বাদ একেক রকম। আইসক্রিম ছিল আমার অন্যতম পছন্দের জিনিস। বাড়ির পাশেই ছিল সড়ক। কাঁচা মাটির ধুলোর সড়ক। সড়কে দাঁড়িয়ে আইসক্রিমের বাক্সে বাড়ি দিতেন আইসক্রিমওয়ালা। সেই শব্দ ছিল আমাদের খুব চেনা। ছোটরা দৌড়ে ছুটে যেতাম। চার আনা দিয়ে কিনে নিতাম পাউরুটিঅলা আইসক্রিম। তারপর কাঠি ধরে চাটতাম। কামড়ে খেতাম না তেমন। যদি শেষ হয়ে যায়, এই ভয়ে! খেলতে খেলতে চলে এসেছি। হাতে ধুলো। কোনো কিছু মনে থাকত না। আইসক্রিম চাটতাম। হাতের ধুলোর আস্তরণ ভিজে যেত আইসক্রিমের রসে। আকাশে ঘন মেঘ। এখনই বৃষ্টি নামবে। আইসক্রিমওয়ালা পড়ে যেত বিপদে। বৃষ্টি হলে আইসক্রিমের তেমন চাহিদা থাকে না। তাছাড়া বৃষ্টিতে বরফ গলে যেতে পারে। এজন্য কম দামে বিক্রি করে দিত সব আইসক্রিম। আমরাও সেই সুযোগে থাকতাম। আকাশে মেঘ করলেই মনে মনে আইসক্রিমওয়ালাকে ভাবতাম। কোনো কোনো দিন এসেও যেত। আমরা তখন জমানো টাকা নিয়ে ছুটে যেতাম। এক টাকায় ছয়-সাতটা আইসক্রিম! দল বেঁধে মজা করে সাধ মিটিয়ে আইসক্রিম খেতাম। আহ, কী তৃপ্তি!
বাইরে দুপুরের কড়কড়া রোদ। শুয়ে আছি মায়ের পাশে। এমন সময় কটকটিওয়ালার ডাক। মনে হতো আমাকেই যেন ডাকছে। চুপিচুপি মায়ের পাশ থেকে উঠে পড়তাম। মা তখন ঘুমে বিভোর। টের পেতেন না। ভাঙা হাঁড়ি-পাতিল, লোহা, টিন কিংবা ছেঁড়া স্যান্ডেল নিয়ে ছুটে যেতাম। কটকটিওয়ালা কটকটির ওপর থেকে কাগজ সরাতেন। বের হতো কটকটি। আহ কী দারুণ তার রং! দেখলেই জিভে পানি চলে আসত। কটকটিওয়ালা আস্তে করে চাকু দিয়ে কটকটি কাটেন। তারপর ধরিয়ে দেন প্রাপকের হাতে। কটকটি হাতে পেলে কী যে ভালো লাগত! হাতে নিয়ে চেটে চেটে খেতাম। মাঝে মাঝে আস্তে করে কামড় দিতাম। কটকট করে চিবাতাম গুড়ের কটকটি।
মাঝে মধ্যে বাড়ির পাশের সরু পথ ধরে চলে আসত কেকওয়ালা। বাড়ির পাশে এলেই ডাক দিতেন— এই মিষ্টি কেক…। এক টাকার দুই কেক। আমরা পিঠেপিঠি দুই ভাইবোন। এক টাকা দিয়ে দুইটা কেক নিতাম। দুই ভাই বোন মজা করে খেতাম। মজা আর মজা। মিষ্টি কেকের স্বাদ এখনও জিহ্বায় লেগে আছে।
সপ্তাহে একদিন বাড়ির পাশে চুড়িওয়ালা আসত। মা-চাচিরা চুড়ি, আয়না, চিরুনি নিতেন। কখনও নিতেন গায়ে মাখা গন্ধ সাবান। বাচ্চাদের জন্য নেয়া হতো ঝুনঝুনি। রঙিন ফুলের ঝালর। আমরাও মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে যেতাম। চুড়িওয়ালার কাছে বিশেষ এক শিশিতে থাকত বুনবুনি। চকোলেটের মতো। মজাদার। সব কেনাকাটা শেষ হলে মা বুনবুনি কিনে দিতেন। এক টাকায় অনেক বুনবুনি। ভাইবোনেরা একসাথে খেতাম। বড় বোনদের জন্য নেয়া হতো ফিতা। চুল বাঁধার ফিতা। লাল, নীল, সবুজ। আমরা নিতাম চশমা। রঙিন প্যালাস্টিকের চশমা। আর নিতাম বাঁশি। প্যালাস্টিকের। ফুঁ দিলে জোরে আওয়াজ করে বাজত। সারাদিন তখন বাঁশি বাজিয়ে পুলিশ পুলিশ খেলতাম। আসামি ধরতাম। জেলে দিতাম। এমনি করে মেতে থাকতাম সারাদিন। ঈদের সময় চুড়িওয়ালারা বিশেষ মর্যাদা পেত। তখনকার দিনে শহরের মার্কেটে তেমন কেনাকাটা করা হতো না। চুড়িওয়ালার কাছ থেকেই প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি কেনা হতো। বিশেষ করে মা-চাচি-বোন-ভাবিদের প্রয়োজনীয় সবকিছু। এই সুযোগে আমরাও নিতাম এটা ওটা। খেলনা বন্দুক, বল, বাঁশি, লুডু আরও কত কী! ঈদের আয়োজন থাকত চুড়িওয়ালাদের ঘিরে। চুড়িওয়ালা আসলেই সবাই ঘিরে ধরতাম। কত জন কত কিছু যে নিত, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
ছোটবেলায় দেখা ফেরিওয়ালাদের আর দেখি না। এখন আর ফেরিওয়ালার যুগ নেই। মানুষ এখন শহরকেন্দ্রিক। প্রয়োজনীয় সবকিছু শহর থেকেই আনছে। শহরও এখন অনেক কাছে। ঘরের সাথেই রাস্তা। রাস্তায় চলে নানান কিসিমের গাড়ি। ভূ-উ-উ করে গেলাম আর এলাম। হয়ে গেল কেনাকাটা। আমাদের সময়ে শহর বলতে ছিল হাট। হাটবারে হাট থেকে বাজার করা হতো। সারা সপ্তাহ আর কোনো বাজার নেই। মেহমান এলে তাড়িয়ে মুরগি ধরা হতো। নইলে পুকুর থেকে ধরা হতো মাছ। এখন আর সেই দিন নেই। দিন বদলেছে। ফেরিওয়ালারা এখন আর ফেরি করে না। অনেকেই দোকান দিয়ে বসেছে। আধুনিক সময়ে আধুনিক সব ব্যবসা নিয়ে উপার্জন করছে। কিন্তু সেই সময়ের ফেরিওয়ালাদের কথা এখনও মনে পড়ে। কত রঙিন ছিল সময়গুলো! কত উন্মাদনা ছিল আমাদের মনে প্রাণে। কম পেয়েও তখন যে আনন্দ পেতাম আজ সব পেয়েও যেন কিছু হলো না’র মতো হাহাকার। খুব বেশিই আবেগী হয়ে যাই। আহা রে দিনগুলো!