
আট বছরের একটি ছোট্ট ছেলে দুখু। মায়ের একমাত্র ছেলে সে। খুব ছোট বয়সে তার বাবা মারা গিয়েছে। তাই তার মা মানুষের বাসায় কাজ করে টাকা উপার্জন করে কোনোমতে সংসার চালান। আর দুখু প্রতিদিন বনে যায় লাকড়ি কুড়াতে।
এমনই একদিন দুখু লাকড়ি কুড়াতে কুড়াতে বনের অনেক গভীরে চলে যায়। যেতে যেতে সে একটা শব্দ শুনতে পেল। শব্দটি কোথা থেকে আসছে সেটা জানার জন্য সে আরও সামনের দিকে এগোতে থাকল এবং দেখলে একটি গাছ থেকে শব্দটি আসছে।
সেটি অনেকটা এমন ছিল— ‘তুমি যদি আমাকে এখান থেকে মুক্ত করে দাও,
বিনিময়ে তুমি আমার কাছ থেকে যা খুশি তা চেয়ে নাও।’
এই ছন্দটি শোনার পর দুখু অনেক ভয় পেল। ফলে সে বাড়ি চলে গেল। বাসায় ফিরে সে শুয়ে শুয়ে তার সাথে ঘটা সকল ঘটনা ভাবতে থাকল, ভাবতে ভাবতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন সকালে দুখু আবার লাকড়ি কুড়াতে গেল। লাকড়ি কুড়াতে কুড়াতে এক সময় সে আবারো গাছের সামনে পৌঁছাল।
গাছ থেকে আবার শব্দ আসতে থাকল— ‘তুমি যদি আমাকে এখান থেকে মুক্ত করে দাও, বিনিময়ে আমার কাছ থেকে যা খুশি তা চেয়ে নাও।’
দুখু এবারও খুব ভয় পেল। এবার দুখুর খুব মন খারাপ হলো, কারণ সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছিল না যে গাছ থেকে কিভাবে আওয়াজ আসছে। দুখুর এভাবে মন খারাপ করতে দেখে তার মা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে বাবা, তোর এত মন খারাপ কেন?’ ‘দুখু বলল, ‘কিছু হয়নি মা এমনি মন খারাপ।’
মা বলল, ‘ঠিক আছে বাবা তাহলে এখন ভাতটা খেয়ে নে।’
দুখু ভাত খেতে খেতে গাছটির কথা মনে পড়ল। পরদিন সকালে দুখু আবার বনে গেল।
এবার সে প্রতিজ্ঞা করল যে, ‘যাই হোক না কেন কেন আমি এবার গাছের সামনে গিয়ে দেখবই কি এই গাছের রহস্য।’
দুখু ছোট ছোট পায়ে গাছের সামনে পৌঁছাল। গাছ থেকে একই শব্দ আসতে থাকল। দুখু দেখল যে গাছটির ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে। গাছটির কোটরের সামনে একটা পাথর। গাছটি থেকে আবারো একই শব্দ বলে উঠলো, দুখু এবার জিজ্ঞেস করল, ‘কে! কে ডাকে আমায়?’
গাছ থেকে শব্দ আসলো, ‘এই যে, এই যে আমি।’
দুখু বলল, কোথায় আমি তো কাউকে কোথাও দেখতে পারছি না। কে! কে কথা বলে?
গাছ থেকে আবার আওয়াজ আসলো, ‘আমি গাছের কোটরে আটকে আছি, আমাকে এখান থেকে বের করো দয়া করে! বের করলেই আমাকে দেখতে পাবে।’
দুখু অনেক চেষ্টা করল গাছের কোটর থেকে পাথরটি বের করার জন্য কিন্তু সে পারল না। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। সে তার শিক্ষকের কাছ থেকে শুনেছে, শক্ত বাঁশ কিংবা কাঠ দিয়ে সহজেই ভারী জিনিস সরানো যায়। তাই সে একটি শক্ত বাঁশ খুঁজে এনে পাথরটিকে সরানোর চেষ্টা করতে থাকল। বারবার চেষ্টা করার পর সে শেষ পর্যন্ত পাথরটি সরাতে সক্ষম হলো। পাথরটি সরানো মাত্রই গাছের কোটর থেকে অনেক আলো বের হতে লাগল। দুখু আলোর ঝলকানিতে তার চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ খোলার পরে সে দেখতে পেল তার সামনে একটি সুন্দর পরি পাখা মেলে বাতাসে ভাসছে। পরিটি দেখতে অনেক সুন্দর। মায়াবী চোখ। দুটো ডানাও আছে। পরিটিকে দেখে দুখু বিস্মিত হলো।
দুখু বলল, ‘ওমা! তুমি কে?’
পরি বলল, ‘আমি হলাম ঝলমলে পরি। আমি প্রায় দুইশত বছর ধরে এখানে আটকে আছি। তোমাকে যে আমি কিভাবে ধন্যবাদ জানাই, অনেক অনেক ধন্যবাদ বন্ধু আমাকে এখান থেকে বের করার জন্য।’
দুখু বলল, ‘দুইশত বছর! তুমি দুইশত বছর কিভাবে এটার মধ্যে ছিলে? তাহলে তো তুমি নিশ্চয়ই আমার বাবাকে দেখেছো।’
পরি বলল, ‘না, আমি তোমার বাবাকে দেখিনি।’
দুখু বলল, ‘তুমি যদি পরিই হতে তাহলে তুমি নিজের জাদু ব্যবহার করে কেন বের হলে না?’
পরি বলল, ‘আমি তো ঝলমলে পরি, তাই আমার জাদু অন্ধকারে কাজ করে না।’
দুখু বলল, ‘তুমি কিভাবে এই কোটরের মধ্যে আটকে গেলে?’
পরি বলল, ‘আমি দুইশত বছর আগে আমার বন্ধুদের সাথে এসেছিলাম এখানে। আমি লুকোচুরি খেলতে খেলতে গাছের কোটরের মধ্যে গিয়ে লুকোই। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো। সকলেই ভয় পেয়ে সেখান থেকে পালাতে লাগল। আর আমি যখনই কোটর থেকে বের হতে নিয়েছিলাম, তখনই কোত্থেকে একটি বড় পাথর এসে কোটরের মুখটি বন্ধ করে দেয় এবং আমি এখানে আটকে যাই।
আর তুমি আজ আমাকে এখান থেকে মুক্তি দিলে, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। এখন বন্ধু বলো আমাকে তুমি এখান থেকে বাঁচিয়েছো এর বিনিময়ে তুমি আমার কাছ থেকে কি চাও?
দুখু বলল, ‘ছোটবেলায় আমার বাবা মারা যায়। তাই আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই।’
পরি বলল, ‘আমি দুঃখিত বন্ধু। আমি মৃত মানুষকে ফিরিয়ে দিতে পারব না। তুমি আমার কাছে অন্য কিছু চাও।’
দুখু বলল, ‘হুমমম… ঠিক আছে। আমি আমার মাকে সবসময় খুশি দেখতে চাই। আমি চাই যে আমার মা যাতে আর কখনো কান্না না করে।’
পরি বলল, ‘তোমার ইচ্ছাপূরণ করা হয়েছে বন্ধু। এখন আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। কখনো যদি আমার সাহায্য প্রয়োজন হয়, তাহলে ঝলমলে পরি বলে তিনবার ডাকবে, তাহলে আমি তোমার কাছে হাজির হব।’
পরির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুখু দৌড়ে গেল নিজের বাড়িতে। বাড়িতে যাওয়ার পর সে দেখতে পেল তার বাড়িটি একটি পাকা দালান হয়ে গেছে। তার মা টেবিলে অনেক খাবার সাজিয়ে বসে আছেন।
মা বলল, ‘দুখু বাবা এগুলো কিভাবে হলো? আমাদের বাড়িতে অনেক টাকা পয়সা এসে গেছে। হঠাৎ করে এসব জিনিসপত্র আর আমার জামাকাপড় পাল্টে গেছে। আমাদের এই কুটিরটি অনেক বড় একটি বাড়ি হয়ে গেছে। এগুলো কিভাবে হলো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
দুখু তার এবং ঝলমলে পরির সম্পর্কে সবকিছু তার মাকে খুলে বলল। তার মা দুখুর কথা বুঝতে পেরে তাকে জড়িয়ে ধরল।
মধুবাগ, ঢাকা থেকে