[সম্প্রতি লেখক বিশ্বজিৎ দাস অভিযোগ করেছেন সুজন বড়ুয়া নামে একজন পরিচালক ‘বান্ধব’ সিনেমার কাহিনী ‘মানুষ‘ গল্প থেকে চুরি করেছেন। যেখানে লেখকের ক্রেডিট দেয়া হয়নি। গল্পটি প্রথম আলোর বন্ধুসভায় ২০০৯ সালে প্রকাশিত এবং বই আকারে ২০১১ সালে প্রকাশ হয়। পাঠকের চাহিদার কথা চিন্তা করে গল্পটি পুনমুর্দ্রণ করা হলো- নির্বাহী সম্পাদক]
এক.
এ রাস্তায় মানুষের চলাচল কম।
বিশেষত রাতে।
ঘরফিরতি মানুষের জন্য এ রাস্তা চেনা। তাদের তেমন অসুবিধা হয় না। কিন্তু রাস্তার এ অংশে অন্ধকার এতই প্রকট যে নতুন কারো গা ছমছম করবে। দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলোও এ অংশের অন্ধকার দূর করতে পারে না।
একটু রাত হলেই রাস্তাটি মানুষশূন্য হয়ে পড়ে। সেদিন বোধহয় জোছনার জন্য অন্ধকার একটু কমই ছিল।
আলো আঁধারের খেলার মাঝে কিসের ক্ষীণ একটা নড়াচড়া লক্ষ করা গেল। মনে হলো কেউ যেন কিছু একটা ফেলে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
তারপর আবার নিস্তব্ধতা।
দুই.
ইমাম সাহেব শহরে গিয়েছিলেন ওয়াজ শুনতে।
পার্টির প্রিয় নেতা ঢাকা থেকে ওয়াজ করতে এসেছেন।
আহ! কী নূরানি চেহারা তার!
কী মিষ্টি গলা!
কী সুন্দর বলার ধরন!
তার যদি অমন বোঝানোর ক্ষমতা থাকত!
নারী জাতির দেশ শাসনে খোদাতালা যে এদেশের ওপর নারাজ কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে পাবলিককে ভালোই বোঝালেন নেতা! মনে মনে হাসলেন ইমাম সাহেব।
পাঁচ বছর আগে নেতা কিন্তু এই কথা বলতেন না।
হঠাৎ থমকে গেলেন তিনি।
বাচ্চার কান্না না! এগিয়ে গিয়ে ঝোপের পাশে উঁকি দিলেন। আঁধো আলোতে যা দেখলেন, গা শিউরে উঠল!
ইয়া খোদা, এ তো জারজ সন্তান!
ভীত চোখে দু’পাশে তাকালেন তিনি।
কেউ নেই!
একবার ইচ্ছা হলো বাচ্চাটাকে কোলে নেন। পরমুহূর্তে গা রিরি করে উঠল।
কার না কার বাচ্চা!
মনে পড়ল, গত বছর মোর্শেদার মা জেনা করে বাচ্চা পয়দা করেছিল। বিচারে তিনি তাকে প্রকাশ্যে একশ একটা দোররা মারার হুকুম দিয়েছিলেন।
গ্রামবাসী তার বিচার মুখ বুজে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু মোর্শেদার মা এ অপমানের জ্বালা সইতে পারেনি। গলায় দড়ি দিয়েছিল।
চমকে উঠলেন ইমাম সাহেব। গলায় হাত উঠে গেল আপনা আপনি। না, না এ বাচ্চাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
গ্রামবাসী বাচ্চার পিতৃত্বের প্রশ্নে তাকেই যদি সন্দেহ করে!
ক্রন্দনরত বাচ্চাকে পেছনে ফেলে হনহন করে তিনি ছুটে চললেন বাড়ির দিকে। যেন কেউ তাকে তাড়া করছে।
তিন.
পণ্ডিতের মন আজ খুব ভালো।
কার যে মুখ দেখে উঠেছিলেন!
পাশের গ্রামে এক বড়লোকের বাড়িতে শ্রাদ্ধের কাজ ছিল আজ। শ্রাদ্ধ করার জন্য যা যা লিস্ট দিয়েছিলেন, সব দিয়েছে ওরা- ধুতি, গামছা, টাকা, ভোগ। সব এখন বাঁধা তার কাঁধের পুঁটলিতে।
খুশি মনে বাড়ি ফিরলেন পণ্ডিত।
বউ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ…।
হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ল তার। মনে হলো বাচ্চার কান্না। উৎস খুঁজতেই পাওয়া গেল।
হে ভগবান! তুমি রক্ষা করো! এ তো এক নবজাতক!
সভয়ে পিছিয়ে এলেন পণ্ডিত। একে নেওয়া তো দূরের কথা, ছোঁয়াও যাবে না। বাপরে! পণ্ডিতানির যা সন্দেহ বাতিক! বাচ্চার বাপ হিসেবে হয়তো তাকেই সন্দেহ করে বসবে।
পণ্ডিতানি তো তার চরিত্র জানে!
আর একটা কথা ভেবেও আতঙ্কিত বোধ করলেন তিনি।
তার বড় মেয়েটা নিচু জাতের একটা ছেলেকে ভালোবেসে পেট পর্যন্ত বাঁধিয়ে বসেছিল। অনেক কষ্টে সে বাচ্চা নষ্ট করে পণ্ডিত তাকে জাতের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন।
সেসব কথা লোকজন তো এখনো ভোলেনি…।
পণ্ডিত তাড়াতাড়ি সে স্থান ত্যাগ করলেন।
চার.
মাল ছাড়া তার একদম চলে না।
সন্ধ্যা নামলেই মাল তার চাইই চাই।
নগদে হোক, বাকিতে হোক মাল সে খাবেই।
রুটে বাস চালায় সে। বাড়ি ফিরতে তার ভালো লাগে না।
কে আছে বাড়িতে তার!
তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত বউ একটা বাচ্চা বিয়োতে পারল না!
মাঝে মাঝে রাগে বউকে মারে সে। বউও মাঝে মাঝে ফুঁসে ওঠে। হাতাহাতি করে তার সঙ্গে। এ হলো রোজ রাতের নাটক।
অবশ্য সকালে বউ ঠিক তাকে নাশতা বানিয়ে দেয়। খেয়ে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে সে। আগের রাতের নাটক নিয়ে কেউ আর কথা তোলে না।
আজ তার মেজাজ এমনিতেই চড়ে আছে।
তিন দিন ধরে বাস বন্ধ।
ধর্মঘট।
টাকার টানাটানি চলছে। টাকা ছাড়া দোকানে মাল দিতে চায় না।
আজও দিতে চাইছিল না। তাই মেজাজ চড়ে আছে তার।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে মালের দোকানদার, বাসের মালিক, দেশের নেত্রীদের মনে মনে গাল পাড়ছিল সে। বাচ্চার কান্নার আওয়াজ কানে যেতেই থমকে দাঁড়াল।
কয়েকবার মাথা ঝাঁকাল। শালা, মালটা আজ বড্ড চড়েছে!
নাহ্, বাচ্চার কান্নাই তো মনে হচ্ছে। খানিকটা এগিয়ে যেতেই বাচ্চার নড়াচড়া চোখে পড়ল তার।
মুহূর্তে নেশা কেটে গেল।
মানুষের বাচ্চা! কোন অমানুষ এখানে ফেলে গেছে!
বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল সে।
সৃষ্টিকর্তাকে মৃদু গালি দিল।
তারপর ছুটে চলল সে বাচ্চা কোলে বাড়ির দিকে।
তার কোলে যে মানুষের বাচ্চা!
মানুষ হয়ে মানুষের ক্ষতি করতে চায় না সে।
মানুষ তো মানুষেরই জন্য!