আসাদের বাবা ম্যানেজার ছিলেন না। বেসরকারি একটা প্রতিষ্ঠানের উচ্চমান সহকারী কাম টাইপিস্ট ছিলেন। কিন্তু বাবাকে আসাদের আজীবন ম্যানেজারই মনে হয়েছে। আসাদ তখন অনেক ছোট। বাচ্চাদের আদর করে অফিসে যাওয়ার আগে বাবা একটা কমন প্রশ্ন করতেন— তোমাদের জন্য আজ কী আনব, বাবা?
আসাদ হাসিমুখে বলত— বাবা, সুজি আর চিনি এনো।
কোনোদিন হয়তো ডিম বা চাল আনার কথা বলত। মায়ের শিখিয়ে দেয়া সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাইরে কখনো চকলেট, চিপস বা আইসক্রিম আনতে বলা হয়নি আসাদ বা তার ছোট বোন আনিকার। বাবা রাত করে এসব নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। আনিকা আর আসাদকে কোলে নিয়ে ব্যাগটা দেখিয়ে বলতেন— এই যে তোমাদের সুজি আর চিনি। আসাদ আনন্দে বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলত— থ্যাংক ইউ বাবা।
বাবা প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফিরতেন। অফিস শেষ করে জিপিও-এর সামনে বসতেন। পার্টটাইম টাইপ রাইটিংয়ের কাজ। এক পৃষ্ঠা টাইপ করলে ১০ টাকা। বাবা পেতেন পাঁচ টাকা আর বাকিটা মেশিন মালিকের। কোনোদিন একটু আয় ভালো হলে নিজ থেকেই চকলেট, চিপস নিয়ে আসতেন। ঘুমন্ত বাচ্চাদের পাশে রেখে দিতেন। সকালে ঘুম ভাঙার পর হাতের কাছে হঠাৎ চকলেট, চিপস পাওয়া কী যে আনন্দের ছিল!
সবচেয়ে বেশি আনন্দের ছিল ঈদ। রোজার ঈদের জন্য সারাবছর অপেক্ষা করত আসাদ। ক্যালেন্ডারে মার্ক করে রাখত। যতই দিন কাছে আসতে থাকত, কেমন ছটফট করত আসাদ, উত্তেজনায় ঘুম আসত না। ঘোর কেটে একসময় সেই ঈদ আসত। বছরে একবার পাওয়া নতুন জামা-জুতোর সে কী আবেদন ছিল, আহা, কী যে আনন্দের ছিল!
একবার ঈদ পড়ল ডিসেম্বরে। আসাদ প্রাইমারি স্কুল শেষ করে হাইস্কুলে যাবে। জানুয়ারিতে ভর্তি। সেশন ফি, বই কেনা, নতুন স্কুল-ইউনিফর্ম কত্ত খরচ! বাবা সেই ঈদেও নতুন জামা দিয়েছিলেন, তবে সেটা ছিল নতুন স্কুলের নতুন ইউনিফর্ম। আসাদ একটুও মন খারাপ করেনি। স্কুল ইউনিফর্ম পরেই বন্ধুদের সাথে ১২ ঘণ্টার একটা বিশেষ দিন পার করে দিয়েছিল, যদিও বাবার মুখটা খুবই বিষণ্ন ছিল সেদিন।
বাবার বিষণ্ন মুখ আবার দেখতে হয়েছিল কোনো একটা কোরবানির ঈদে। সেইবার ৭ ভাগের ১ ভাগ নিয়েও কোরবানি দেয়ার অবস্থা ছিল না আসাদদের। বাবা কোনোভাবেই আর ম্যানেজ করতে পারলেন না। সারাদিন পর সন্ধ্যায় বাবা আসাদকে ডেকে বলেন চল, কোরবানির মাংস নিয়ে আসি।
আসাদ তো অবাক। বাবা কি গোপনে কোরবানি দিয়ে এখন সারপ্রাইজ দিচ্ছেন? বাসাবোর ওয়াহাব কলোনির ভাড়া বাসা থেকে বাবার সাথে হাঁটতে হাঁটতে আসাদ খিলগাঁও রেলগেইট চলে এল। গিয়ে তো অবাক! রেললাইনের পাশের রাস্তায় বিশাল মাংসের বাজার বসেছে। বিক্রেতারা কেউ কসাই নয়। সারি সারি মাংস বিছিয়ে বসে আছে মলিন পোশাক পরা অনেক নারী-পুরুষ। বাবা হাসিমুখে বলেন, বুঝতে পারছিস— বাড়ি বাড়ি গিয়ে এরা অনেক মাংস পায়। বাসায় তো ওদের ফ্রিজ নেই তাই বাড়তিটুকু বিক্রি করে দেয়। কারা কিনে জানিস— রেস্টুরেন্ট মালিকরা।
বাজারের দামের চেয়ে অর্ধেকেরও কম দামে মাংস কিনে বাড়ি ফিরে ওরা। রাতে আসাদদের বাসায় ঈদের ঘ্রাণ শুরু হয়। গরুর মাংসের মাতাল ঘ্রাণ। গভীর রাতে একসাথে খেতে বসে ওরা। মাংস খেতে খেতে বাবার চোখে পানি চলে আসে, বারবার হাত দিয়ে চোখ মোছেন। এটা কি ঝালের কারণে নাকি অন্য কারণে বুঝতে পারে না ছোট্ট আসাদ।
ব্যালকনিতে দাঁড়ানো আসাদের চোখও ভিজে ওঠে অজান্তে। তার খুব বাবার কথা মনে পড়ে। বাবাকে খুব দরকার ছিল এখন। আসাদ একা একটা গরু কোরবানি দিচ্ছে দেখে কি বাবা আনন্দে কেঁদে ফেলতেন? আসাদ চোখ মুছে নিচে তাকায়। গরুটাকে গেইটের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। গরুটার চোখটাও কি ভেজা? ঈদের আগের রাতে কি গরুরাও কাঁদে? আসাদ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে গরুটার দিকে। হঠাৎ চোখ ঝাপসা হয়ে দেখতে পায় বাবার মুখ। ঠিক গরুর মুখটাতেই। বাবা কাঁদছেন।
আসাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পশু কোরবানি দেখা যায়, বাবাদের কোরবানি হওয়া কেউ দেখতে পায় না, বাবারাও বুঝতে দিতে চান না। কারণ, বাবারা ম্যানেজার। তাঁরা সবকিছু ম্যানেজ করে নিতে জানেন, ম্যানেজ করে নিতে হয়!