BDOUTLOOK
  • হোম
  • দেশ
  • বিশ্ব
  • রাজনীতি
  • অর্থবাণিজ্য
  • খেলা
  • বিনোদন
  • মতামত
  • শিল্পসাহিত্য
    • কবিতা
    • গল্প
    • প্রবন্ধ-আলোচনা
    • সাহিত্যের খবর
BDOUTLOOK
  • হোম
  • দেশ
  • বিশ্ব
  • রাজনীতি
  • অর্থবাণিজ্য
  • খেলা
  • বিনোদন
  • মতামত
  • শিল্পসাহিত্য
    • কবিতা
    • গল্প
    • প্রবন্ধ-আলোচনা
    • সাহিত্যের খবর
শিরোনাম
২০২৬ সালের রমজানের আগেই জাতীয় নির্বাচন? ইউনূস-তারেক বৈঠকে ইঙ্গিত
কী কথা হলো?
বাণিজ্য যুদ্ধে বিশ্ব!
টাইম ট্রাভেল কি বাস্তবে সম্ভব
ইউনূস ও মোদির বৈঠকে কৌতূহল
Saturday | July 5 | 2025
BDOUTLOOK
BDOUTLOOK
  • হোম
  • দেশ
  • বিশ্ব
  • রাজনীতি
  • অর্থবাণিজ্য
  • খেলা
  • বিনোদন
  • মতামত
  • শিল্পসাহিত্য
    • কবিতা
    • গল্প
    • প্রবন্ধ-আলোচনা
    • সাহিত্যের খবর

News 24 Hours BDOUTLOOK.COM

গল্প

রত্নদ্বীপের খোঁজে :: প্রিন্স আশরাফ

বিডিআউটলুক July 5, 2025
July 5, 2025
6

খান বাহাদুর সলিম খান বাহাত্তরে মারা গেলেন। কিছুটা বাহাত্তরে পেয়ে, কিছুটা বায়ুচড়ে। কোনো অসুখবিসুখ করেনি, যদি বায়ুচড়াটাকে অসুখের মধ্যে না ধরা হয়। রাতে নিজ বিছানায় ঘুমিয়েছিলেন। পরিচারিকাই বিছানা করে দিয়েছিল। সকালে বিগতা স্ত্রীর বালিশের পাশে তার মাথা ঝুলে পড়তে দেখা যায়। অস্বাভাবিক মৃত্যু। মাথার পিছনে ভারী ভোঁতা কিছুর আঘাত দিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাকে। ঘরের সব জিনিসই স্বাভাবিক আছে। শুধু মাথার বালিশের নিচের সবসময়ে আগলে রাখা একটা বিশেষ পুরনো ডায়েরি মিসিং। এই ডায়েরিটা তিনি ছেলেমেয়েদেরও কখনো ধরতে দেননি। একমাত্র আদুরে মেয়ে রিমি আবদার ধরলে বলতেন, ‘ওটাই আমার সব। আমি মরলে তোরা পাবি। ওর ভেতরে রত্নভাণ্ডারের মানচিত্র আছে। মাথায় ছটাকখানিক ঘিলু থাকলে ও থেকেই তোরা রাজবাদশার মতো ধনসম্পদের মালিক হয়ে যাবি।’
তিনি নিজেও অনেক ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। তার চেনাজানারা বলত, ‘সব ওই ডায়েরির কল্যাণে। ডায়েরির কল্যাণে ফকির থেকে রাজা হয়েছে!’
সব ছেলেমেয়েরা একদিন আসল ঘটনা জানার জন্য বাবাকে চাপাচাপি করল। নিরুপায় হয়ে সেদিনই জানিয়ে দিলেন, ‘এক গোপন স্থানে তার রত্নভাণ্ডার গচ্ছিত রাখা আছে। পূর্বপুরুষের খান বাহাদুরের রত্নভান্ডার। আমার মৃত্যুর পর রত্নভাণ্ডার তুলে তোরা ভাগ করে নিবি। তিন ভাইবোনে সমানভাগে ভাগ।’
বাবার মৃত্যুর খবরে নিজ নিজ ফাটে নিজ নিজ সংসার যাপন করা ছেলে মেয়েদের টনক নড়ল। খবর পেয়ে ইন্নালিল্লাহের বদলে প্রথম যে কথাটা মনে পড়ল, ‘বাবার সে ডায়েরির ম্যাপ ঠিকঠাক আছে তো?’
সবাই ছুটে এলো বাবার বাড়ি। প্রথমে মৃতের ঘরে। বাবার ঘরের সবকিছুই অবিকৃত রয়েছে। শুধু কখনো হাতছাড়া না করা সেই ডায়েরিটাই হাতছাড়া। কোথাও নেই। আততায়ী মাথার পেছনে আঘাত করে সেটা নিয়ে সটকে পড়েছে। বিশ্বস্ত পরিচারিকা বানু যে তা করেনি তা তার সবল উপস্থিতিই বড় প্রমাণ। চুরির পরে চোর কখনো চুরির স্থানে থাকে না। তারপরও পুলিশ সবার আগে বানুকেই গ্রেফতার করল। বড়ভাই জামাল খান মৃত্যুর পরের সব দায়িত্ব ভাবগম্ভীর ভাবে নিতে চাইলেও পুলিশ বাদ সাধল। লাশ পোস্টমর্টেম হবে। মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করা হবে। তারপরে লাশ দাফন কাফন হবে।
লাশ চলে গেলে ময়নাতদন্তে। ছেলেমেয়েরা বাবার ঘরে দরজা দিয়ে ময়নাতদন্তে বসল। মেজো ছেলে কামাল খান বলল, ‘বড় ভাইয়া, বাবার পোস্টমর্টেম, লাশ দাফন-কাফন এসবের জন্য আমরা যত দেরি করব ততই ডায়েরি দূরে চলে যাবে। আরো দূরে যাবে।’
ছোট ছেলে আমান মেজো ভাইয়ের কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘মেজো ভাই ঠিকই বলেছে। আমাদের এখনই ডায়েরির খোঁজ নেয়া উচিত।’
‘কিন্তু কিভাবে খোঁজ নিবি? আমরা তো আর গোয়েন্দা না, যে চাইলেই খুঁজে বের করতে পারব?’ বড়ভাই আমানের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল।
মেয়ে রিমি কান্নায় ভেঙে পড়ার ভান করলেও কানখাড়া করে ভাইদের কথা শুনছিল। সেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমরা নিজেরা গোয়েন্দাগিরি না করতে পারি দেশে তো দু-একজন গোয়েন্দা আছে, নাকি নেই? তাদের ধরে খুঁজে বের করতে বলো।’ বলেই সে আবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। সেটা আবার মৃত্যু শোকে নাকি কোটি কোটি টাকার রত্নভাণ্ডার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তা গবেষণার বিষয়।
আমান বলল, ‘ভাইয়া, গোয়েন্দার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমার পরিচিত একজন ডিটেকটিভ আছে। ছদ্মনাম শালর্ক হোমস জুনিয়র। বেশ কাজের। আমি তার সাথে এখনই যোগাযোগ করছি।’ সে মোবাইল বের করে বাটন টিপতে শুরু করল।
পোস্টমর্টেম থেকে লাশ আসার আগে ডিটেকটিভ হোমস জুনিয়র অ্যাসিট্যান্ট-সুদ্ধ চলে এলো। ডিটেকটিভের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের কাছাকাছি। চেহারায় ধারালো কোনো ভাব নেই। বোকাসোকা একটা ছাপ মুখে আঁটা।
ডিটেকটিভ হোমস এসে ক্রাইম সিনে যাওয়ার কোনো তোড়জোড় করল না। সবার বিষণ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘লাশ কোথায়?’
সবাই চমকে তাকাল। হয়তো লাশ গোয়েন্দাগিরির কোনো কাজে আসবে। আমানই উত্তর দিল, ‘লাশ পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে গেছে।’
‘কখন আসবে?’
‘পোস্টমর্টেম শেষ হলেই আসবে। কেন?’ আমানই জিজ্ঞেস করল। তার রেফারেন্সে এসেছে। কথাবার্তা চালানোর দায়িত্ব সেই নিল।
‘কারণ লাশই জানে সেই ডায়েরি কোথায় আছে?’
‘লাশ কিভাবে জানবে?’ কামাল খান বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘লাশকে জীবিত করতে হবে। তাহলে সেই জানিয়ে দেবে।’
বড়ভাই জামাল খান বিস্মিত হলো না, বিরক্ত হলো। ‘আপনার মাথাটাথা ঠিক আছে তো? লাশ জীবিত করতে হবে মানে? মরামানুষ কি কখনও জীবিত হয়?’
‘হয়। সন্তানদের প্রয়োজনে হয়। আপনাদের প্রয়োজনেই ওনাকে জীবিত করতে হবে। প্রয়োজন মিটে গেলে আবার মরা লাশ হয়ে যাবে।’
‘আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না। কি বলছেন বুঝিয়ে বলুন!’ রিমি আর কথা না বলে পারল না।
ডিটেকটিভ হোমস বোকা বোকা চোখে তাকাল। মরা বাড়ি বলেই বোকা হাসি দিল না। ‘ঠিক জীবিত নয়। কিছু তন্ত্রমন্ত্রের প্রভাবে লাশের মধ্যে সাময়িকভাবে আত্মা ফিরে আসবে। সেই আত্মা সাইন ল্যাংগুয়েজে বুঝিয়ে দেবে জিনিসটা কোথায় আছে। বাকি কাজটা আমরা করতে পারব।’
বড়ভাই জামাল খান এবার সত্যিকারের বিরক্ত হলেন। সে বিরক্তি কণ্ঠস্বরে এড়াল না। ‘আপনি ডিটেকটিভ না তান্ত্রিক?’
ডিটেকটিভ হোমস এবার না হেসে পারল না। ‘আমি ডিটেকটিভই। তন্ত্রমন্ত্র জানি না। তবে তন্ত্রমন্ত্রআলা লোকের খবরাখবর রাখি।’ সে বিপন্ন বোধ করায় আমানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লাশ একবার তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে ফেলতে পারলে বাকিটা তান্ত্রিকই করবে। আমাদের এখন শুধু দরকার লাশের…’ সে কথা গিলে ফেলল। কারণ পোস্টমর্টেম শেষে লাশ ফিরে এসেছে। বড়ভাই জামাল খান এগিয়ে গিয়ে কাগজপত্রে সই করে লাশ নিল। ‘লাশের ব্যাপারে আর কোনো ঝামেলা নেই তো?’ সে পুলিশের কাছে জানতে চাইল।
‘আমাদের ঝামেলা শেষ। কেস তো করা হয়েছে। খুনির কোনো খবর পেলে জানাব। আপনারা লাশ নিয়ে দাফন কাফন করিয়ে ফেলতে পারেন।’ পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ভ্যানে উঠে পড়ল।
পুলিশ বেরিয়ে যেতে কান্নাকাটি করতে থাকা আত্মীয়পরিজনের দিকে তাকিয়ে বড়ভাই কাতর কণ্ঠে বলল, ‘লাশ এখনই দাফনকাফন করা যাবে না। বাবা খুন হয়েছেন। আমরা ডিটেকটিভ নিয়োগ দিয়েছি। তিনি লাশ নিয়ে তদন্ত করবেন।’
আত্মীয়স্বজন পিছু হটল। ডিটেকটিভের সাথে লাশ নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল তান্ত্রিকের সন্ধানে। ডিজিটাল তান্ত্রিক। মোবাইল আছে। ডিটেকটিভ নাম্বার দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিল। তাদের কেস হিস্ট্রি জানিয়ে যাগযজ্ঞ করে রাখতে বলল। ডায়েরির সন্ধান পেলেই তার ধনভাণ্ডারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে।
তান্ত্রিক তিলকরাজ আনন্দের কপালে চন্দনের বিশাল তিলক কাটা। ক্লিন শেভড। এক প্রস্ত গেরুয়া সারা গায়ে জড়ানো। মাথার চুলে জটা থাকলেও তা নকল। সেটা শুধু ডিটেকটিভ হোমস জানে।
যাগযজ্ঞের ঘটা দেখে তিনভাই ভড়কে গেল। তান্ত্রিকের কাছে আর রিমিকে আনেনি। ধুপধুনোর ধোঁয়ায় গোটা আস্তানা ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিছুই স্পষ্ট করে দেখা যায় না। তান্ত্রিকের মুখ বোঝা যায় না। শুধু গেরুয়া কালারটাই চোখে ভাসে।
বাবার লাশ তারা গেরুয়ার হাতে সমর্পণ করল। তান্ত্রিকের দুই গেরুয়াধারী সাগরেদ লাশ নিয়ে তান্ত্রিকের সামনে রাখল। তান্ত্রিক তিলকরাজ লাশটাকে বিশাল একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলো। ডিটেকটিভ হোমস গোয়েন্দাগিরি ফলাতে তান্ত্রিকের পাশে এসে বসল। তাদের দুজনের মধ্যে ফিসফিসানির কথাবার্তা হলেও আছন্ন ধোঁয়ার আড়ালে ভাইয়েরা কিছু দেখতে পেল না।
তান্ত্রিকের গম্ভীর গলা ভেসে এলো। ‘লাশের দিকে নজর রাখিস তোরা। লাশ জীবিত হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে। আত্মা ভর করছে লাশের শরীরে। এখনই লাশ দিকনির্দেশনা দেবে। তোদের হারানো জিনিসের সন্ধান জানিয়ে দেবে। কালো কাপড়ের দিকে নজর রাখিস।’
তিন ভাইয়ের চোখেই যেন ধান্ধা লাগল। কালো কাপড়ের ভেতর একটু নড়ে উঠেছে যেন। অবিশ্বাস্য! তিনজনেই চোখ কচলে ভালো করে তাকাল। তাইতো! ওইতো, লাশের ডান পাশটা উঁচু হয়ে উঠছে। মনে হয় ডান হাত উঁচু করে তুলছে। শীর্ণ আঙুল দিয়ে চারকোণা করে কিছু একটা দেখিয়ে দিচ্ছে।
ধারাভাষ্যকারের কাজ করতে লাগল তান্ত্রিকের মিডিয়াম। ফিসফিস করে জানিয়ে দিল, ‘ডায়েরিটা মিসিং হয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু যে জিনিসের খোঁজ সেটা ওই বাড়ির মধ্যেই আছে। ম্যাপটা বাড়িতেই আছে।’ একটু থামল। তারপর আবার ধারাবর্ণনা, ‘শুধু বাড়ির মধ্যে না। ওই ঘরের মধ্যেই আছে। যে ঘর ছেড়ে আত্মা বেরিয়ে গেছে।’ আবার বিরতি। ‘শুধু ঘরেই না। ওই বিছানাতেই আছে। আততায়ী প্রাণ নিলেও মানচিত্র নিতে পারেনি।’ আবার বিরতি। কালো কাপড়ের নড়নচড়ন। ‘আততায়ীকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন তিনি। আততায়ী ঘরের লোক। কাছের লোক।’ শ্বাস নেয়ার বিরতি। কালো কাপড়ের মধ্যে হাতপা সবই নড়েছে এবার। ‘তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কি জন্য আততায়ী এসেছে।’ এবার একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘তার আগেই মানচিত্রটা গায়েব করে ফেলেছিলেন তিনি।’
তিনজনই একই সাথে বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘গায়েব!’
ওদিক থেকে আর কোনো কথা নেই। কালো কাপড়ও নি®প্রাণ। তান্ত্রিক আবার তন্ত্রমন্ত্রের জোর বাড়ায়। আরেক পশলা ধোঁয়ায় ভরে যায় আস্তানা। আবার নড়ে ওঠে কাপড়। আবার নড়ে ওঠে মিডিয়ামের ঠোঁট, ‘গায়েব মানে অদৃশ্য নয়। গায়েব মানে উধাও। চোখের পলকে তিনি ম্যাপটা উধাও করে দেন তিনি।’
তিনজনে আবার একসাথে বলে উঠল, ‘কোথায়?’
ডিটেকটিভ হোমস বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘ধ্যানের সময় কোনো প্রশ্ন করবেন না। আত্মা নিজ থেকেই যা জানানোর সব জানাবে।’
মিডিয়ামের ঠোঁট সচল হতেই ডিটেকটিভ হোমস থেমে যায়, ‘ওটা তিনি হাতের কাছে থাকা মোবাইলের মধ্যে ব্যাটারির পেছনে ঢুকিয়ে ফেলেন।’
তিনজনের কণ্ঠেই বিস্ময়, ‘মোবাইলের ভেতরে!’
মানচিত্রের অবস্থান জানার সাথে সাথেই তিনজনেরই ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বাবার লাশ নিয়ে দাফনের কথা যেন তাদের মনে থাকে না। লাশ ছাড়াই চলে যেতে পারলে বাঁচে।
ধোঁয়ায় এবং নিজেদের লোভের কারণে কেউ খেয়াল করেনি ডিটেকটিভ হোমস বাড়িতে রেখে আসা অ্যাসিসটেন্টকে মোবাইল ফোনে কি যেন নির্দেশ দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তাদের বের হওয়ার আগেই পেছনের দরজা দিয়ে তান্ত্রিক আর ডিটেকটিভ উধাও।
তান্ত্রিককে দেখে এখন আর চেনার উপায় নেই। পুরোদস্তুর পর্যটকের পোশাক। থ্রিকোয়ার্টার প্যান্ট, কেডস, গায়ে টিশার্ট, মাথায় বারান্দাওয়ালা টুপি, গলায় ঝুলছে বাইনোকুলার। সে অনুযায়ী ডিটেকটিভ হোমসের পোশাক ভদ্রই বলা যায়। অফিসিয়াল পোশাক। প্যান্টের পকেটে লাইসেন্স করা পিস্তল।
তান্ত্রিক বিরক্ত গলায় বলল, ‘এ কোথায় এনে ফেললেন ভাই? এদিক দিয়ে আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
ডিটেকটিভও কিছুটা সন্দিহান, ‘ম্যাপে তো এরকমই দিকনির্দেশনা দেখছি। সেই অনুযায়ী চলছি।’
‘ওই ভাইদের কি অবস্থা?’
ডিটেকটিভ নিজের বুদ্ধিতে হেসে ফেলল, ‘কি অবস্থা আবার? ওরা হয়তো এতক্ষণে আলেয়ার পেছনে ঘুরে ঘুরে মরছে। রত্নভাণ্ডার ম্যাপ অ্যাসিসটেন্ট দিয়ে বদলে দিয়েছে। মোবাইলের ভেতর অন্য ম্যাপ ভরে দিয়েছে। ওদের যাওয়ার কথা সুন্দরবনে। ওরা এখন হয়তো বান্দরবনে। বান্দর খুঁজে মরছে।’
‘তার মানে আমরা এখন সুন্দরবনের দিকে রওনা দিয়েছি।’
‘হু। ম্যাপে তো সেরকমই যেতে বলছে। ম্যাপ ধরে ধরে যাচ্ছি। এখন নৌকায় চড়ে যেতে হবে। ম্যাপের নির্দেশ। আপনি দাঁড়ান। আমি বড় নৌকা ভাড়া করছি।
নৌকা মাটি ছেড়ে পানিতে ভাসতেই তান্ত্রিকের কেমন যেন হালকা বোধ হলো। সাঁতার না জানায় ডুবে যাওয়ার ভয় তাকে সবসময় কাবু করে রেখেছে। সে নৌকার দুপাশ ধরে ধরে কোনোমতে ভেতরে এসে বসল। তারা ভেতরে বসতেই নৌকা ছেড়ে দেয়ায় ঠাণ্ডা বাতাস তাদের কাঁপিয়ে দিল। ঢাকায় অগ্রহায়ণের শীত না লাগলেও এদিকে মনে হচ্ছে শীত পড়ে গেছে। মাঝি সামনে থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘সাব, ঠাণ্ডা লাগলি কইয়েন, ছইয়ের সামনে পর্দা লাগাই দিবানে।’
ডিটেকটিভ জোরেই বলল, ‘এখন থাক মাঝি ভাই। শীতের বাতাস মিষ্টিই লাগছে।’
তান্ত্রিক মনে মনে চাইছিল পর্দা দেয়া হোক। তাহলে ডিটেকটিভের সাথে কিছু কথা বলা যেত। সে ডিটেকটিভের একেবারে কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘ভাই, একটা খারাপ খবর আছে?’
ডিটেকটিভ গলা না নামিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘কি?’
তান্ত্রিক দাঁড়টানা মাঝির দিকে একবার তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘হালকা একটু ধ্যানে বসছিলাম। তন্ত্রমন্ত্রের মধ্যে দেখতে পেলাম, ওরাও আমাদের অনুসরণ করে এইদিকে আসছে। সম্ভবত পাইকগাছা পর্যন্ত এসে গেছে।’
ডিটেকটিভ গলা নামিয়ে বলল, ‘বলেন কি? ওরা কি আমাদের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে নাকি?’
‘আপনি যে অত গোয়েন্দাগিরি করছিলেন, না বুঝে কি পারে? কয় না চোরের মন পুলিশ পুলিশ। ওরা ঠিকই কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়ে পিছু নিয়েছে। ওরা আসল ম্যাপ না পেলেও আমাদের সন্দেহ করেছে। সন্দেহ করে আমাদের পিছু নিয়েছে। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে।’
তাদের কথোপকথনের কিছুটা বোধহয় মাঝি শুনে ফেলেছে, একটু ইতস্তত করে বলল, ‘সাবেরে কুনো ঝামেলায় পড়িছেন নাই? আমারে কতি পারেন, এদিকের ঝামেলা আমি মিটাতি পারবানে। এই হেকিম মাঝির জন্মই বলতি গিলি বাদায়। শুধু মাঝিগিরি না অনেক কামই করি। আমারে কতি পারেন।’
তান্ত্রিক ডিটেকটিভের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার মনে হয় মাঝি ভাইরে আমাদের আসল কথা বলে দেয়াই ভালো। তাতে বিপদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। আমি বিপদ দেখতে পাচ্ছি ভাই।’
ডিটেকটিভ বিরক্ত গলায় বলল, ‘আপনি এত ভীতুর ডিম তা জানতাম না তো। ঢাকায় তো আপনাকে কোনোদিন ভয় পেতে দেখিনি।’
তান্ত্রিক শুকনো মুখে বলল, ‘ডাঙার প্রাণী জলে ছেড়ে দিলে কি অবস্থা হয় বোঝেন। আমার অবস্থাও তাই। শহর অঞ্চলে আমি সবই করতে পারি। কিন্তু এই জঙ্গলে আমার হাত পা বাঁধা।’
নৌকা মাঝির দাঁড় বাওয়ার কারণে বেশ জোরে জোরেই এগিয়ে যাচ্ছে। পানিতে শুধু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। দুপারের জনজীবনে রাতের প্রস্তুতি। বড় নৌকা হওয়ার কারণে দুপাশে ছোট ছোট চারকোণা দুটো জানালাও আছে। ডিটেকটিভ জানালা তুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, ‘নদীর নিজস্ব একটা সৌন্দর্য আছে। সেটাই দেখেন। সুন্দরবনের চিন্তা পড়ে। আর ধনরতেœর চিন্তা আরো পরে। আগে ওরা আসুক, তারপর দেখা যাবে।’ ডিটেকটিভ চুপ করে গেল। তান্ত্রিকও চুপ করল, সেটা ভয়ে না নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তা বলা যায় না।
নৌকা একটা গতিতে চলে এসেছে। গতি চলে এসেছে মাঝির দাঁড় বাওয়াতেও, কেমন যেন ছান্দিক তালে পেটের সাথে দাঁড়ের মাথা বাঁধিয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে যাচ্ছে।
তাদের নৌকার পাশেই একটা কালো জীব হুশ করে মাথা উঁচিয়ে আবার ডুবে গেল। ডিটেকটিভের কাছে মনে হলো কালো পোশাকের কোনো আততায়ী ডুবুরির মতো তাদের পিছু নিয়েছে। পানিতে ডুবে ডুবে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। তিমি শিকারিদের মতো হারপুন দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে তাদের। কিছু না হলেও নিদেনপক্ষে তার পা ধরে যদি হেঁচকা টান দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়! সে তো সাঁতার জানে না।
ডিটেকটিভ নদীর পানির দিকে পিস্তল তাক করতেই হাকিম মাঝি ঢোক চিপে বিস্মিত গলায় বলল, ‘সাব, কি করতিছেন? পানিতে গুলি করতিছেন ক্যান? পানিতে কিডা আছে?’
ডিটেকটিভ একটু বিভ্রান্ত হলো। তখনই আবার মাথা তুলে দিল কালো প্রাণীটা। শুয়োরের মতো সুচালো মুখ। মাঝিও দেখলে সেদিকে। ‘মাইরেন না, মাইরেন না, ওডা আপনাগির কোনো ক্ষেতি করতি পারবিনানে।’
তান্ত্রিক ঢোক চিপে বলল, ‘কী ওটা?’
‘ওটারে চিনতি পারলেন না? ওটা শোষ।’
‘শোষ কী?’
হাকিম মাঝি শোষ কি ঠিক বুঝিতে দিতে পারলো না। আমতা আমতা করে বলল, ‘শোষ হলো গে শোষ।’
ডিটেকটিভ এবারে প্রাণীটারে চিনতে পারল। এতদিন শুধু নাম শুনেছে, এখন চুষ দেখল। সে বুঝিয়ে বলল, ‘শোষ মানে শুশুক। গ্রামের লোক শুশুকরে শোষ বলে ডাকে। ডলফিনের মতো প্রাণী।’
‘শুশুক কি কামড়ায়? মানুষ খায়?’ তান্ত্রিক ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করল। সাঁতার না জানায় পানির সব প্রাণীকেই তার কাছে ভয়ংকর মনে হতে থাকে।
‘ডলফিনে কি মানুষ খায়? বললাম না, শুশুক ডলফিন প্রজাতির প্রাণী।’
‘এই নদীতে কি কোনো কুমির টুমির আছে নাকি?’ তান্ত্রিক ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
হাকিম মাঝিই উত্তর দিল। ‘কুমির নাই সাব। কুমির বাদার ধারের গাঙে আছে।’
‘তা জানি। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ।’ তান্ত্রিক কথার মাঝখানে বলল।
হাকিম মাঝি দাঁড়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘সাব, কুমির না থাকলিও কামোঠ আছে কিন্তুক।’
তান্ত্রিক আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কামোঠ কি?’
হাকিম মাঝির হয়ে ডিটেকটিভ উত্তর দিল, ‘কামোঠ কুমিরের চেয়ে ছোট এক ধরনের ভয়ংকর প্রাণী। কুমির ধরলে গোটা মানুষ খেয়ে ফেলে। আর কামোঠে কচ করে হাত পা কেটে নিয়ে যায়। খুব ধারালো দাঁত এই ভয়ংকর প্রাণীটির।’
‘ঠিক কইয়েছন স্যার। চরে নিমিষেই পা হাওয়া।’ হাকিম মাঝি ফোড়ন কাটে।
কামটের ব্যাপারটা ডিটেকটিভ কিছুটা জানত। আর কিছুটা মাঝির কাছ থেকে শুনল। কুমিরের চেয়ে কামোঠেই এই মাঝিদের বেশি ভয়। কামট হাঙর শ্রেণির হিংস্র জলজšুÍ। হাঙরের মতোই অতি তীক্ষ্ন দুই পাটি দাঁত। আকারেও একটু ছোট। রঙটা কালো-সবুজ শ্যাওলার মতো, মুখ অনেকটা শুকরের মতো ছুচালো। অতি প্রি আর দ্রুতগামী এবং সজাগ জলচর প্রাণী। মানুষবাহী নৌকার এবং মনুষ্যবসতি ডাঙার কাছেপিঠেই তারা ঘুরে বেড়ায়। আর সুযোগ পেলেই ধারালো দাঁতে নিমিষেই অঙ্গ বিছিন্ন করে নেয়। কুমির তবু চিবিয়ে খায়, কামোঠ যান্ত্রিক ধারালো করাতের মতো চোখের পলকে শরীর টুকরো টুকরো করে দেয়।
‘শরীলে আর কুলোতিছে না সাব, ভরা প্যাট যে! এট্ট জিরোয় নিতি চায়িলাম।’
ডিটেকটিভ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ঠিক আছে। বড় গাঙের মুখে গিয়ে ঘণ্টাখানিক বিশ্রাম নেবেন। আজ রাতটা কষ্ট করেন। আপনারে পোষায় দেয়া যাবে।’
আরো খানিকদূর যেতেই নদীর কিনারে সারবাঁধা কয়েকটা নৌকা দেখা গেল। সবগুলো নৌকার ভেতরেই অন্ধকার। মনে হয় এত রাতে সব ঘুমিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে।
মাঝি নৌকায় লগি দিতে দিতে বলল, ‘স্যার, ঘুমোতি চালি এট্টুখানি ঘুমোয় নেন। বাদাবনের কাছে আলি কত বিপদ যে হতি পারে তার ঠিকঠিকানা নেই। তখন ঘুমাতি পারবেন না।’
ছইয়ের ফাঁক দিয়ে ডিটেকটিভ দেখল বাইরে অন্ধকার জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। চাঁদের আলোও কমে আসছে। আরেকটু পরে হয়তো পুরোপুরি কমে যাবে। সে হ্যারিকেনের জোর কমিয়ে আবার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
নৌকার দুলুনির তালে তালে ঘুমটা যখন জেঁকে এসেছিল তখনই ডিটেকটিভের মনে হলো কে যেন তার গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। ভূমিকম্পের সময় যেমনটি মনে হয় তেমন। জোরে জোরে ধাক্কা দেয়ার কারণে সে ধড়ফড় করে কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে বসল। তান্ত্রিক তার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। হ্যারিকেনের মিটিমিটি আলোয় তার মুখের ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ডিটেকটিভ ফিসফিস করে বলল, ‘ওরকম ধাক্কাচ্ছেন কেন? কী হয়েছে? নৌকায় বাঘ পড়েছে নাকি?’
তান্ত্রিকও ফিসফিস করে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘বাঘের চেয়ে বেশি। মাঝি ব্যাটার মতলব সুবিধের না মনে হচ্ছে। আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে নৌকা কোনো মতলবে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে কে জানে? হয় বাঘের মুখে ছেড়ে দিয়ে আসবে, নয়তো ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়ে কুমির কামোঠকে দিয়ে খাওয়াবে। এই মাঝিই যে ডাকাত না তার কি প্রমাণ আছে? কেমন ডাকাতের মতন চেহারা দেখেন। আর ডাকাত না হলেও ডাকাতের সাথে যোগাযোগ আছে। মাঝিই তো আগে বলল এদিকে বন্দুক কেড়ে নেয়ার জন্য ডাকাতি হয়। আমাদের পিস্তল কেড়ে নেয়ার জন্যও যদি ওরা ডাকাতের হাতে তুলে দেয়?’
সন্দেহটা ডিটেকটিভের কাছেও অমূলক মনে হলো না। এই অপরিচিত জায়গায় শুধুমাত্র পিস্তল সম্বল করে কতটুকু কি করা যায় বোঝা যাচ্ছে না। তবে মাঝি যে নৌকা ছেড়ে দিয়েছে, নৌকার দুলুনি আর ছপছপ শব্দে সেটুকু বোঝা যাচ্ছে।
ডিটেকটিভ ফিসফিসানি বজায় রেখেই বলল, ‘আমরা যে জেনে গেছি বা ভয় পেয়েছি এটা মাঝিকে বুঝতে দেয়া যাবে না।’ তারপর গলা আরো নামিয়ে বলল, ‘ঘুমের ভান করে সজাগ থাকতে হবে। অন্য কারোর সাথে মাঝির কথাবার্তা বা কোনো কিছু করার মতো দেখলে আগে মাঝি ব্যাটাকেই…’
বাইরে রাতের অন্ধকার। চাঁদ পুরোপুরি ডুবে গেছে। অন্ধকার আকাশে তারার মেলা। এক পাশে বনের ছায়া কালো কালো। অন্যপাশে দিগন্ত বিস্তৃত পানির আকাশ। আর কিছুই দেখা যায় না। মাঝির দাঁড়ের ঝপাঝপ আঘাতে পানিতে অজস্র জোনাকির মতো জ্বলজ্বল করছিল।
তান্ত্রিক জলজোছনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে সব ভয় ভুলে অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, পানিতে জ্বলছে ওগুলো কী?’
‘ফসফরাস। সাগরের পানিতে ফসফরাস থাকে। স্রোতের সাথে তাই জ্বলে।’
‘আমরা সমুদ্রে এসে পড়েছি নাকি?’
‘জি, সাব। বড় গাঙ ছাড়াইয়ি সাগরে পড়িছি অনেক আগে। আপনার ঘুমাই পড়িলেন এজন্যি আর ডাকতি যায় নি?’ হাকিম মাঝি দাঁড় টানতে টানতে ক্লান্ত গলায় বলল।
‘আমরা কোথায় কতদূর এলাম মাঝি ভাই?’ ডিটেকটিভ ভয় না পাওয়ার ভান করে প্রশ্ন করল।
মাঝি দাঁড় স্থির রেখে মাথা চুলকায়ে বলল, ‘বুঝতি পারতিছিনে সাব, লৌকা চালাতিছি খুব। কিন্তুক কোন জায়গায় যে আসবার লাগলাম ঠাহর করতি পারতিছিনে। অন্ধকারে পথ হারায়ি ফেলিছি কিনা সেইটা ধরবার পারতিছিনে।’
ডিটেকটিভ এবার সত্যিকারের ভয় পেল। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘কি বলছেন? পথ হারিয়ে ফেলেছেন মানে? কোন দিকে যাচ্ছেন বুঝছেন না? এদিকের সব কিছু চেনেন না?’
‘চিনি তো সাব। কিন্তুক এই অন্ধকারে ওদির বাদাবন আর এদির সাগর। সব একরম লাগতিছে। যাতি থাহি, সকাল হলি ঠিক বুঝবার পারবানে। ভয় পাইয়েন না।’
‘ভয়ের কিছু আছে নাকি?’
‘জে না। ভয় কি? সাগরের টানে লৌকো ভাসি যায়। আমাগির লৌকো বাদাবনের ধার দিয়ি চালাতিছি। পুলিশির ভয় আছে। আপনার তো সরকারি লোক। তালি পরে আর ভয় কি?’
তান্ত্রিক ইতস্তত করে বলল, ‘ডাকাতের কথা বলছিলেন যে?’
‘ডাকাতির কি আর ঠিকঠিকানা আছে? ধরলি ঘপ করি লৌকো বেড় দিয়ি ফেলবেনে। সেজন্যি তো আপনারা রইছেনই।’
তান্ত্রিক প্রশ্ন করল, ‘আমরা কি সুন্দরবনের কাছাকাছি এসে গেছি?’
‘জে। এখন আমরা বাদাবনের কুল দিয়ি যাতিছি। রাত্তিরে কিছু দেখতি পাবেন না। বেয়ান হোক।’
তারা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। অজানা রূপ রহস্য রোমাঞ্চে ভরা সুন্দরবন! পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন! রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সুন্দরবন!
ভোরের জন্য প্রতীক্ষায় থাকলেও নৌকার দুলুনিতে ঝিমঝিম ভাব চলে এলো। ঠাণ্ডা মনোরম হাওয়া শরীর কাঁপিয়ে দিতে লাগল। ভোরের নিজস্ব কোনো আর্কষণ আছে বোধহয়। মাঝিও নৌকা কোনো একটা খালের কাছে রেখে খালের পানি দড়ি বাঁধা বালতি দিয়ে তুলে অজু করে নামাজ পড়ে নিল। নামাজ শেষে তাদের ঝিমুনি ভাব দেখে মাঝি আর ডেকে তুলল না।
ডিটেকটিভের ঝিমুনি ভাব আগে ছুটল। সে নৌকার বাইরে এসে কুয়াশা মাখা ভোরে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। সবুজ বনবনানী ছাওয়া সুন্দরবনের কেওড়াগাছ দেখা যাচ্ছে। পাড়জুড়ে বিস্তৃত শ্বাসমূল। মাটি থেকে শূলের মতো উঁচু হয়ে থাকা গাছের শেকড়। জোয়ারের নোনা পানির মাঝে বেঁেচ থাকার জন্য গাছগুলোকে প্রকৃতি এই কৌশল দিয়েছে।
কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা তান্ত্রিককে ডিটেকটিভ ঠেলে তুলে দিল। সকালের এই অসাধারণ সুন্দরবনের ভোর দেখা উচিত। না হলে সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে। তান্ত্রিক ধড়ফড় করে উঠে বসে বলল, ‘কী? কী হয়েছে?’
ডিটেকটিভ আনন্দিত স্বরে বলল, ‘সুন্দরবন হয়েছে? ভোর হয়েছে? প্রাণ খুলে দেখ।’
তান্ত্রিকও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বনের দিকে। গত রাতের সকল ভয় ভোরের আলো ফুটতেই কর্পূরের মতো উবে গেছে। কুমির কামোঠের ভয়, বাঘের ভয়, ডাকাতের ভয়, সৌন্দর্যের সামনে সব ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেছে যেন।
তান্ত্রিক আনন্দিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা এখন কোন জায়গায় আছি হাকিম ভাই?’
‘ঠিকমতো কতি পারতিছিনে। আঠারোবেকি না নবেকি কোনদিকে যে চলি আলাম।’
‘হিরণপয়েন্ট কোনদিকে?’ তান্ত্রিক সুন্দরবনের এই একটিমাত্র জায়গার নাম জানে। পত্রিকায় আরো কয়েকটা জায়গার নাম যেন পড়েছিল। নীলকমল রেঞ্জ না কি যেন!
‘সেডা তো এদির না। আপনারা তো ওদির যাতি কলেন না। ওদের গিলি আরামে থাকতি পারতেন। ফরেস্ট অফিস, পিকনিকের জায়গা, বেড়ানির জায়গা, পুলিশ, বন্দুকয়ালা বনরক্ষী সব আছে।’
বনরক্ষীর কথা শুনেই নাভিদের নামে বনরক্ষক অথচ কামে বনভক্ষক ওসমান গণির কথা মনে পড়ে গেল। এ মানুষগুলো বনের মানুষখেকো বাঘের চেয়ে ভয়ংকর!
বড় খালের মধ্যে এসে পড়ায় এখন আর দাঁড় টানতে হচ্ছে না। বৈঠা মেরেই নৌকা চলছে। বানর প্রজাতির ছটফটানির কারণেই কিনা কে জানে খিদে আর কৌতূহল দুটোই বেশি মনে হয়। চরের দিকের কেওড়াগাছ বেয়ে বেয়ে চলে এসেছে। দুএকজন চরার উপরের দিকে কাকড়া খুঁজছে। হাত ব্যবহার করার স্টাইলটা ঠিক মানুষেরই মতন।
খালগুলো পানিতে কানায় কানায় ভরে উঠেছে। মাঝি জানাল, ‘গোন লাগিছে।’ খালের পাড় ডুবে দু-এক জায়গায় হাঁটু পানিও উঠে গেছে। মাঝি জানাল, ভাটার সময় পানি শুকাই যায়। তখন খালে নোনা পানির ছোট ছোট মাছ পাওয়া যায়।
আরো খানিক দূর এগুতেই খালের ধারে ধারে বিখ্যাত গোলপাতার গাছ দেখা গেল। পাতা গোল নয়Ñ নারকেল পাতার মতো। আবার নারকেল গাছের মতো বড় গাছ হয় না। একেবারে গোড়া থেকে পাতা গজায়। গোলপাতা দিয়ে ঘরের মজবুত ছাউনি করে সাতক্ষীরা খুলনার গ্রামের মানুষেরা। দুর্গম গহীন এলাকা থেকে যারা গোলপাতা, গাছের গুড়ি, কাঠ কেটে আনে তাদেরই বাওয়ালি বলে। হাকিম মাঝির মুখেই জানা গেল এসব। সে নিজেও জাতে বাওয়ালি।
মাঝির কাছে জানতেই মাঝি জানাল, এই জায়গাগুলোতে সে কখনো এসেছে বলে তার মনে পড়ে না। সুন্দরবনে অসংখ্য জায়গা আছে যেগুলো ভয়াল সুন্দর, কিন্তু অনাবিষ্কৃত। সেসব জায়গায়, কাঠচোর, ডাকাত, বনদস্যু, শিকারিরা অনায়াসে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে। কেউ কখনও খোঁজ পাবে না। পর্যটনের লোকেরা তো দূরে থাকুক, বনরক্ষী, কোস্ট গার্ডের লোকেরা, রেঞ্জ, বন পুলিশেরাও এখনও সেদিকটাতে আসে না। বাঘ সাপখোপের ভয় নয়, এত বড় সুন্দরবন যে সব জায়গা সার্ভে করা বন বিভাগের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। দুর্বৃত্তদের সুবিধা হয়ে যায় সে কারণেই। আর এসব জায়গাতে নিরাপত্তারও বড় অভাব। যে কারণে মাঝিরা বেশি ভাড়া পেলেও আসতে চায় না। হাকিম মাঝি এক নাগাড়ে কয়েকটা জায়গার নাম বলে গেল। নামগুলো প্রায় একই জাতীয়। গেওয়াখালী, ভোমরখালী, চানমিয়াখালী, টিয়ারচর, কোলারচর, কালীর চর। নাভিদের কোনো নামই মনে থাকল না।
তান্ত্রিক বেশ মজলিসি মেজাজে বলল, ‘মাঝি ভাই, আমরা কোনদিকে চাচ্ছি?’
মাঝি অনিশ্চয়তার সুরে বলল, ‘যাতি থাকি। বাঁদার সব খাল নদী আর সাগরেরতে আয়িছে। যাতি যাতি আরেট্টা খালে, আরেট্টা নদীতে পড়তি যাতিছি। খোলপাটুয়ার দিকে চলি যাতিছি মনে হতিছে।’
মাঝি চিড়ে গুড় খাচ্ছিল। সকালের নাশতা। মাঝির গালে চিড়ে থাকায় জড়িয়ে চিৎকার দিয়ে কি কথা বলল ডিটেকটিভ বুঝতে পারল না। শুধু ‘পারা পারা’ শব্দটাই ভেসে এলো।
‘কী হয়েছে হাকিম ভাই? কী দেখেছেন?’
হাকিম ভাইয়ের গালের চিড়ে শেষ। এবারে কথা পরিষ্কার বোঝা গেল। ‘ধাক করি এ জাগা পেরুতে হবি। না হলি বড়মামার পেটে চলি যাতি পারি।’
তান্ত্রিক আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘কেন? বড়মামা কে? নামকরা বড় ডাকাত?’
‘সাব, বড়মামা হলো গিয়ে ওই আপনারা কি কন রয়েল বেঙ্গল…’
‘বুঝেছি। কিন্তু বাঘের কথা কি বলছিলেন?’
‘এদিকি তেনারা আছেন। ওই যে দেহেন তেনাদের পায়ের পারা।’
মাঝির আঙুল উঁচিয়ে দেখানোর পাশাপাশি নদীর চরায় বাঘের তাজা পায়ের ছাপ দেখতে পেল তারা। ওহ, ক্যামেরা থাকলে, ছবি তুলে নেয়া যেত।
তান্ত্রিক বলল, ‘ভাই, আপনার মোবাইলে ক্যামেরা আছে না? বাঘের পায়ের ছবি তোলেন?’
এতক্ষণে ডিটেকটিভের মোবাইলের কথা মনে পড়ল। এরকম ভুলোমন নিয়ে তার গোয়েন্দা হওয়াই উচিত না। আসলে নেটওয়ার্কের অভাবে এদিকে কোনো সাড়াশব্দই ছিল না মোবাইলে, এজন্যই ভুলে থাকা। সাড়া না থাকলে ভুলে থাকা সহজ।
ডিটেকটিভ মোবাইল বের করে নেটওয়ার্ক পেল না। তবে ক্যামেরা কাজ করল। যদিও মাঝি বাঘের ভয়ে বৈঠা বেয়ে নৌকা বেশ এগিয়ে নিয়ে গেছে। ছবি উঠল ঝাপসা। অভিজ্ঞ মাঝি পায়ের ছাপ দেখেই বলল, ‘জাগা খারাপ। ছবিটবি পরে তুলেন। আগে জান বাঁচান।’
‘কেন বাঘ ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে নাকি?’ ডিটেকটিভ পিস্তল বের করে হাতে নিয়েছে।
‘পিস্তলের গুলিতি মানুষ মরলিও তেনাদের কিছু হইতো না। পারা দেখে বুঝতিছেন না তেনারা দুতিনজন আছে। রাতে পানি খাতি আসিলো। পার হয়নি। বনের মধ্যি আছে। পার হলি পরে বুঝতি পারতাম।’ মাঝি ইতস্তত করে বলল, ‘বনের ধারে লৌকো। তেনাদের ঝাপ তো দেহেননি।’
আর ছবি তোলায় প্রবৃত্ত হলো না। এক বাঘের পায়ের ছাপ দেখেই বাঘ শিকার এবং মানুষখেকো বাঘের নিরীহ মানুষ শিকারের গল্প একের পর এক বেরুতে লাগল। দুর্ধর্ষ শিকারি মেহের গাজী, তার ছেলে পচাব্দী গাছের নাম, তাদের দুঃসাহসিক শিকার কাহিনী চলে এলো। বাদাবনের পীর মান্দার পীরের নামও উঠল। এদিকের অনেকের নামই মান্দার পীরের নামে। মাঝি বাঘের পা নিয়ে এখানকার প্রচলিত একটা ছড়া কাটল। ‘ঘাটে গিলো জা’র (জায়ের) মা,/দেখি আইলো বাঘের পা।/ তুই কলি, মুই শুনলাম/মরি বাঁচি বাঘ দেখলাম।’
ছড়াটা শুনে তারা হেসে ফেলল। এক ছড়ার মধ্যেই এখনকার সুন্দরবন ভ্রমণকারী পর্যটকদের কি তীব্রভাবেই না ব্যঙ্গ করা হয়েছে। বাঘের পায়ের ছাপ দেখে অথবা না দেখে শুধু মুখে শুনেই বাঘ দেখার তৃপ্তি মেটাতে হয়। তাদের ভাগ্যেও বাঘ দেখার সৌভাগ্য আছে কিনা কে জানে!
সৌভাগ্যের কথা বলতে বলতেই সৌভাগ্য হাতের নাগালে চলে এলো। কিন্তু এতই ভয়াল সেই সৌভাগ্য যে তাদের চোরের মতো ছইয়ের ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে বাঘ দেখতে হলো।
নৌকা চলছে সরু খালের ভেতর দিয়ে। মাঝি জানাল, এরকম ছোট খালের মতো কিছু ভারানি আছে। সেই ভারানির মধ্য দিয়ে চলছে। ভারানির দুপাশেই কেওড়া আর গোলপাতা বন। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর মেলে বন দেখা গেল। বড় বড় এক মানুষ দেড় মানুষ ঘাস জাতীয় প্রজাতি। উপরের দিকে দ্রু দ্রু ফুল। এই মেলে দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ মাদুর তৈরি করে। মেলের মাদুর সারা বাংলাদেশে একমাত্র দক্ষিণাঞ্চলের লোকেই সাপ্লাই দেয়। সে সবুজ মেলে বনের মধ্যে হলুদ ছোপ ছোপ। হলুদ কালো ডোরা রয়েল বেঙ্গল টাইগার মাথা বের করে নদীর নৌকা বিস্ময়ের সাথে দেখছে। যেমন বিস্ময়ে তারা বাঘ দেখছে। বাঘ ভাবছে এই আপদ আবার এদিকে এলো কিভাবে?
এবারে আর ছবি তোলার কথা মনে হলো না। এত কাছ থেকে বাঘ দেখার সৌভাগ্যের পাশাপাশি দুর্ভাগ্য জড়িয়ে আছে। মানুষখেকো বাঘ হলে কোনো তালজ্ঞান ছাড়াই ঝাঁপিয়ে পড়বে নৌকার উপরে। পিস্তলে কাজ হবে না। বন্দুক ছাড়া বাঘ মারা যায় না। তাও পাকা শিকারিরা ছাড়া পারে না।
দুপুরেই দর্শন শেষ হলো। বাঘ মেলে বনের মধ্য দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আল্লা আল্লা করতে করতে মাঝি খালের মাঝখান দিয়ে লগিবৈঠা মেরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
সকাল পুরোপুরি ফুটে গেছে। রোদ চড়াও হয়েছে জোরালো ভাবে। গাছের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে যেটুকু সোনারোদ আসছে তার নির্মলতা গোটা পরিবেশকে বিশুদ্ধ করে দিচ্ছে। বাঘ দেখার আতঙ্ক বা আনন্দের রেশ কারোর ভেতর থেকে এখনো কাটেনি। মাঝিও স্বীকার করল এত কাছ থেকে বাঘ সে কোনো দিন দেখিনি টাক মাথার এক ধরনের পাখি দেখা গেল। ওটা মদনটাক। যতই এগুনো যাচ্ছে ততই পাখির কলকাকলি বাড়ছে। একটা জায়গার ওপর দিয়ে বেশ কয়েকটা শকুন উড়তে দেখা গেল। উড়ে আবার ভেতরে কোথায় যেন গিয়ে গিয়ে বসছে। শকুন মানেই কিছু মরেছে বোধহয়। হয়তো বাঘের খাওয়া ভুক্তাবশেষ পড়ে আছে। মানুষখেকো না হলে হরিণই শিকার করেছে হয়তো। হরিণ বাঘের প্রিয় ডিশ।
হরিণ আর তাদের দেখিয়ে দিতে হলো না। হরিণের কারণেই এদিকে বাঘের আনাগোনা বেশি মনে হয়। তাছাড়া এই অনাবিষ্কৃত জায়গাটা বোধহয় কিছুটা অভয়ারণ্যের মতো। সুন্দরবনের চিত্রল হরিণের মতো এত সুন্দর হরিণ বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই। চিড়িয়াখানায় মানুষ দেখতে অভ্যস্ত হরিণ দেখা এক রকম আর অবাক চোখে চরের কাছাকাছি এসে বোকার মতো তাদের দেখতে থাকা হরিণ আরেক রকম। এই সৌন্দর্যের কোনো তুলনা নেই। কেমন মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে থাকে। দেখলেই মায়া লাগে। এই মায়ার জীবগুলোকে মানুষ শুধু রসনা তৃপ্তির জন্য মেরে খায় কিভাবে!
এদিকে বালিহাঁসের ছড়াছড়ি। অন্য পাখিও চোখে পড়ছে। নাম না জানা পাখি। ছোট রঙিন কাকড়া আর জলজ পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করে। মাছরাঙা, ঈগল, কাক তো পরিচিত পাখিই।
এতসব নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মন অবশ হয়ে আসে। তখনই হাকিম মাঝি বলল, ‘আর ভয় নেই। এইবার গাঙে গিয়ে পড়তি পারি।’
ডিটেকটিভ যেন সরু খালের দুপাশের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে পড়েছিল। সে একটু বিরক্ত গলায় বলল, ‘বড় নদীতে গিয়ে পড়লে কি সুবিধা?’ যেন সে ছোট খাল ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না।
‘বড় গাঙের কোনখানে যদি এট্টা কুপে পাওয়া যায়।’
কুপের ব্যাপারটা মাঝির কাছ থেকে জেনে নিল। কুপ হলো বনের একটা নির্দিষ্ট চিহ্নিত এলাকা, যেখানে জেলে বাওয়ালি মৌয়ালরা বন বিভাগের তদারকিতে কাজ করে। একজন আরেকজনের প্রয়োজন মেটায়। কিছুটা স্টেশনের মতো। সেখানে গেলে খোঁজখবর করে তারা এখন কোথায় জানা যাবে। মান্দারের নৌকার সন্ধান জানা যেতে পারে। বা তাদের গন্তব্যও ঠিক করতে পারবে।
মাঝির বড় কুপ দূরে থাক, বড় গাঙই পাওয়া গেল না। তবে সরু খাল ছাড়িয়ে নৌকা বড় আরেকটা খালে গিয়ে পড়ল। বড় খাল যখন তখন সামনে হয়তো বড় নদী পড়বে। নয়তো অন্য কোনো নৌকারও হয় তো দেখা পাওয়া যাবে। না হলে কোথায় ঘুরে মরছে কিছুই জানা যাবে না। হাকিম মাঝি নিজেও অনেকখানি চুপসে গেছে। রাতের অন্ধকারের পথ হারানোর ভোগান্তি যে এভাবে তাকে দিতে হবে সে বুঝতে পারেনি।
দুধারেই সুন্দরবন। গোলপাতার ঝাড়। শ্বাসমূলের পাশেই কেওড়া গাছ। নদীর চরে রঙিন কাকড়া। বালিহাঁস চরে বেড়াচ্ছে। নানানরকম পাখপাখালির কলকাকলিতে মুখর চারিপাশ। বাদরের বাদরামিও চোখে পড়ছে এগাছ থেকে ও গাছে।
চারিদিকে প্রকৃতির শব্দ ছাড়া যান্ত্রিকতার কোনো শব্দ নেই। এ এক অপূর্ব মুগ্ধতা! যান্ত্রিকতার কোলাহলমুক্ত অবিশ্বাস্য রহস্যময়তা! যান্ত্রিক নিস্তব্ধতা!
এরকম সময় ওরা স্তম্ভিত হওয়ার মতো দৃশ্যটা দেখতে পেল।
সুন্দরবনের সব রূপ রস রহস্য রোমাঞ্চের প্রতিভূ হয়ে সোনালি দেহের অধিকারী পৃথিবীর অন্যতম সম্পদ বিশালাকারের বাঘ খালের এপাড় থেকে সাঁতরে ওপারে পার হচ্ছিল। গোটামাথা আর পিঠের উপরে সোনালির ডোরর কিছুটা দৃশ্যমান ছিল। এবং একেবারে সোজাসুজিই পার হচ্ছিল। পরে অবশ্য হাকিম মাঝি জানায়, বাঘেরা সোজাসুজি নদী বা খাল পার হয়। স্রোতে কোনোভাবে বেঁকে গেলে আবার গোড়ার থেকে শুরু করে। অর্থাৎ মূল জায়গায় ফিরে এসে সোজা পার হবে। এভাবে হাজারবার করতে হলেও করবে।
বাঘ খাল পার হয়ে কোনোদিক ভ্রু ক্ষেপ না করে চরের বালির উপর উঠে বিড়ালের মতো গা ঝাড়া দিয়ে পশমের পানি ঝেরে ফেলল। তাই দেখে গাছে ডালে বাদরামি করা বাদরেরা কিচমিচ করে শোরগোল শুরু করে দিল। বানরের বন্ধু হরিণেরা এই কিচমিচের অর্থ জানে, ‘বাঘ হাজির,’ লম্বা লম্বা ঠ্যাংয়ে শব্দ তুলে দৌড়াতে শুরু করল আশেপাশের যত হরিণ। বাঘ নবাবি চালে ঢুকে পড়ল বনের ভেতর।
খাল ছাড়িয়ে দুই নৌকা আরো কিছুদূর এগিয়ে গেছে। সামনে খালের মুখ। তারপর আবার বড় খাল। খালের এক পাশে একটা জায়গা কেমন যেন দ্বীপের মতোই মনে হলো। যেন জলে ভেসে থাকা এক খণ্ড দ্বীপ। চারিদিকে খাল দ্বারা বেষ্টিত হয়ে আছে।
দ্বীপ দেখেই তান্ত্রিকের আসল কথা মনে পড়ে গেল। যে কারণে এই গহন বনে আসা। সে ডিটেকটিভের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘ভাই, ম্যাপটা দেখেন তো? ম্যাপে এরকম বড় বড় গাছওয়ালা একটা দ্বীপ ছিল না। পাশাপাশি দুটো দ্বীপের ছোটটা।’
দ্বীপ দেখে ডিটেকটিভেরও ও চিন্তা মাথায় এসেছে। সে ম্যাপ নিয়ে বসে পড়ল। হ্যাঁ, এই তো! স্পষ্ট এই দ্বীপটার ছবি। তার পাশেই নাড়াখাড়া ছোট্ট রতœদ্বীপ। সে কম্পাসসহ যাবতীয় সরঞ্জাম বের করল। সব হিসাব নিকাশ সবকিছুই বলছে এই বড় দ্বীপটার পাশাপাশি ছোট দ্বীপ থাকার কথা। মামাভাগ্নে দ্বীপ। কিন্তু ভাগ্নে দ্বীপের কোনো হদিশ দেখা যাচ্ছে না। সেখানে শুধু পানি আর পানি।
শেষমেশ তারা মাঝির শরণাপন্ন হলো। ‘মাঝি ভাই, এই দ্বীপটারে কি চিনতে পারতিছেন?’
‘চিনতি পারব না ক্যান। হ্যানের সব মাঝিব্যাটাই চেনে।’
‘কি দ্বীপ ওইটা?’
মাঝি হেসে বলল, ‘আগে আমরা সবাই মামাভাগ্নি দ্বীপ কয়ি ডাকতাম। ভাগ্নি ডুবি গিছে। শুধু মামা টিকি আছে। ক্যান সাব?’
‘আপনি শিওর এইটা মামাভাগ্নি দ্বীপ?’
‘জে সাব। বাদাবন যেরম সত্যি সেরম মামাভাগ্নি দ্বীপ সত্যি সাব। কিন্তুক এখন তো ভাগ্নি নেই। তলায় গেছে।’
ডিটেকটিভ গম্ভীর মুখে বলল, ‘হু। সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’
তান্ত্রিক হতাশ গলায় বলল, ‘এখন কী হবে?’
‘কী আর হবে? ঢাকায় ফিরে যাব। লাভের হবে লাভ হলো রতœ খুঁজতে এসে অন্য ররত্নভাণ্ডার দেখা হয়ে গেল।’
‘সেটা কী?’
‘এতক্ষণ দুচোখ ভরে দেখেও বুঝতে পারেননি, কি রতœ আমরা দেখে ফিরছি। তবে ফিরে যাওয়ার আগে আমরা একটা কাজ করে যাব।
‘কী কাজ?’
‘এই মামা দ্বীপেই নামব। একটা জায়গা খুঁড়ে রেখে দেব। এমন ভাবে খুঁড়ব যাতে ওই তিনভাই এসে মনে করে আমরাই রত্ন তুলে নিয়ে গেছি।’
‘তাতে আমাদের লাভ?’
‘আমাদের লাভ নেই। কিন্তু ওদেরও শান্তিতে থাকতে দেব না। রতœ তুলে নিয়ে গেছি এই আফসোসে সারাজীবন জ্বলে পুড়ে মরবে।’
তান্ত্রিকও কি বুঝল কে জানে, ডিটেকটিভের সাথে শাবল কোদাল নিয়ে নেমে পড়ল মামাদ্বীপে। খুঁড়তে শুরু করল দ্বীপের বালি মাটি…রতœদ্বীপের খোঁজে :: প্রিন্স আশরাফ

খান বাহাদুর সলিম খান বাহাত্তরে মারা গেলেন। কিছুটা বাহাত্তরে পেয়ে, কিছুটা বায়ুচড়ে। কোনো অসুখবিসুখ করেনি, যদি বায়ুচড়াটাকে অসুখের মধ্যে না ধরা হয়। রাতে নিজ বিছানায় ঘুমিয়েছিলেন। পরিচারিকাই বিছানা করে দিয়েছিল। সকালে বিগতা স্ত্রীর বালিশের পাশে তার মাথা ঝুলে পড়তে দেখা যায়। অস্বাভাবিক মৃত্যু। মাথার পিছনে ভারী ভোঁতা কিছুর আঘাত দিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাকে। ঘরের সব জিনিসই স্বাভাবিক আছে। শুধু মাথার বালিশের নিচের সবসময়ে আগলে রাখা একটা বিশেষ পুরনো ডায়েরি মিসিং। এই ডায়েরিটা তিনি ছেলেমেয়েদেরও কখনো ধরতে দেননি। একমাত্র আদুরে মেয়ে রিমি আবদার ধরলে বলতেন, ‘ওটাই আমার সব। আমি মরলে তোরা পাবি। ওর ভেতরে রতœভাণ্ডারের মানচিত্র আছে। মাথায় ছটাকখানিক ঘিলু থাকলে ও থেকেই তোরা রাজবাদশার মতো ধনসম্পদের মালিক হয়ে যাবি।’
তিনি নিজেও অনেক ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। তার চেনাজানারা বলত, ‘সব ওই ডায়েরির কল্যাণে। ডায়েরির কল্যাণে ফকির থেকে রাজা হয়েছে!’
সব ছেলেমেয়েরা একদিন আসল ঘটনা জানার জন্য বাবাকে চাপাচাপি করল। নিরুপায় হয়ে সেদিনই জানিয়ে দিলেন, ‘এক গোপন স্থানে তার রতœভাণ্ডার গচ্ছিত রাখা আছে। পূর্বপুরুষের খান বাহাদুরের রত্মভাণ্ডার। আমার মৃত্যুর পর রতœভাণ্ডার তুলে তোরা ভাগ করে নিবি। তিন ভাইবোনে সমানভাগে ভাগ।’
বাবার মৃত্যুর খবরে নিজ নিজ ফাটে নিজ নিজ সংসার যাপন করা ছেলে মেয়েদের টনক নড়ল। খবর পেয়ে ইন্নালিল্লাহের বদলে প্রথম যে কথাটা মনে পড়ল, ‘বাবার সে ডায়েরির ম্যাপ ঠিকঠাক আছে তো?’
সবাই ছুটে এলো বাবার বাড়ি। প্রথমে মৃতের ঘরে। বাবার ঘরের সবকিছুই অবিকৃত রয়েছে। শুধু কখনো হাতছাড়া না করা সেই ডায়েরিটাই হাতছাড়া। কোথাও নেই। আততায়ী মাথার পেছনে আঘাত করে সেটা নিয়ে সটকে পড়েছে। বিশ্বস্ত পরিচারিকা বানু যে তা করেনি তা তার সবল উপস্থিতিই বড় প্রমাণ। চুরির পরে চোর কখনো চুরির স্থানে থাকে না। তারপরও পুলিশ সবার আগে বানুকেই গ্রেফতার করল। বড়ভাই জামাল খান মৃত্যুর পরের সব দায়িত্ব ভাবগম্ভীর ভাবে নিতে চাইলেও পুলিশ বাদ সাধল। লাশ পোস্টমর্টেম হবে। মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করা হবে। তারপরে লাশ দাফন কাফন হবে।
লাশ চলে গেলে ময়নাতদন্তে। ছেলেমেয়েরা বাবার ঘরে দরজা দিয়ে ময়নাতদন্তে বসল। মেজো ছেলে কামাল খান বলল, ‘বড় ভাইয়া, বাবার পোস্টমর্টেম, লাশ দাফন-কাফন এসবের জন্য আমরা যত দেরি করব ততই ডায়েরি দূরে চলে যাবে। আরো দূরে যাবে।’
ছোট ছেলে আমান মেজো ভাইয়ের কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘মেজো ভাই ঠিকই বলেছে। আমাদের এখনই ডায়েরির খোঁজ নেয়া উচিত।’
‘কিন্তু কিভাবে খোঁজ নিবি? আমরা তো আর গোয়েন্দা না, যে চাইলেই খুঁজে বের করতে পারব?’ বড়ভাই আমানের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল।
মেয়ে রিমি কান্নায় ভেঙে পড়ার ভান করলেও কানখাড়া করে ভাইদের কথা শুনছিল। সেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমরা নিজেরা গোয়েন্দাগিরি না করতে পারি দেশে তো দু-একজন গোয়েন্দা আছে, নাকি নেই? তাদের ধরে খুঁজে বের করতে বলো।’ বলেই সে আবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। সেটা আবার মৃত্যু শোকে নাকি কোটি কোটি টাকার রতœভাণ্ডার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তা গবেষণার বিষয়।
আমান বলল, ‘ভাইয়া, গোয়েন্দার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমার পরিচিত একজন ডিটেকটিভ আছে। ছদ্মনাম শালর্ক হোমস জুনিয়র। বেশ কাজের। আমি তার সাথে এখনই যোগাযোগ করছি।’ সে মোবাইল বের করে বাটন টিপতে শুরু করল।
পোস্টমর্টেম থেকে লাশ আসার আগে ডিটেকটিভ হোমস জুনিয়র অ্যাসিট্যান্ট-সুদ্ধ চলে এলো। ডিটেকটিভের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের কাছাকাছি। চেহারায় ধারালো কোনো ভাব নেই। বোকাসোকা একটা ছাপ মুখে আঁটা।
ডিটেকটিভ হোমস এসে ক্রাইম সিনে যাওয়ার কোনো তোড়জোড় করল না। সবার বিষণœ মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘লাশ কোথায়?’
সবাই চমকে তাকাল। হয়তো লাশ গোয়েন্দাগিরির কোনো কাজে আসবে। আমানই উত্তর দিল, ‘লাশ পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে গেছে।’
‘কখন আসবে?’
‘পোস্টমর্টেম শেষ হলেই আসবে। কেন?’ আমানই জিজ্ঞেস করল। তার রেফারেন্সে এসেছে। কথাবার্তা চালানোর দায়িত্ব সেই নিল।
‘কারণ লাশই জানে সেই ডায়েরি কোথায় আছে?’
‘লাশ কিভাবে জানবে?’ কামাল খান বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘লাশকে জীবিত করতে হবে। তাহলে সেই জানিয়ে দেবে।’
বড়ভাই জামাল খান বিস্মিত হলো না, বিরক্ত হলো। ‘আপনার মাথাটাথা ঠিক আছে তো? লাশ জীবিত করতে হবে মানে? মরামানুষ কি কখনও জীবিত হয়?’
‘হয়। সন্তানদের প্রয়োজনে হয়। আপনাদের প্রয়োজনেই ওনাকে জীবিত করতে হবে। প্রয়োজন মিটে গেলে আবার মরা লাশ হয়ে যাবে।’
‘আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না। কি বলছেন বুঝিয়ে বলুন!’ রিমি আর কথা না বলে পারল না।
ডিটেকটিভ হোমস বোকা বোকা চোখে তাকাল। মরা বাড়ি বলেই বোকা হাসি দিল না। ‘ঠিক জীবিত নয়। কিছু তন্ত্রমন্ত্রের প্রভাবে লাশের মধ্যে সাময়িকভাবে আত্মা ফিরে আসবে। সেই আত্মা সাইন ল্যাংগুয়েজে বুঝিয়ে দেবে জিনিসটা কোথায় আছে। বাকি কাজটা আমরা করতে পারব।’
বড়ভাই জামাল খান এবার সত্যিকারের বিরক্ত হলেন। সে বিরক্তি কণ্ঠস্বরে এড়াল না। ‘আপনি ডিটেকটিভ না তান্ত্রিক?’
ডিটেকটিভ হোমস এবার না হেসে পারল না। ‘আমি ডিটেকটিভই। তন্ত্রমন্ত্র জানি না। তবে তন্ত্রমন্ত্রআলা লোকের খবরাখবর রাখি।’ সে বিপন্ন বোধ করায় আমানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লাশ একবার তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে ফেলতে পারলে বাকিটা তান্ত্রিকই করবে। আমাদের এখন শুধু দরকার লাশের…’ সে কথা গিলে ফেলল। কারণ পোস্টমর্টেম শেষে লাশ ফিরে এসেছে। বড়ভাই জামাল খান এগিয়ে গিয়ে কাগজপত্রে সই করে লাশ নিল। ‘লাশের ব্যাপারে আর কোনো ঝামেলা নেই তো?’ সে পুলিশের কাছে জানতে চাইল।
‘আমাদের ঝামেলা শেষ। কেস তো করা হয়েছে। খুনির কোনো খবর পেলে জানাব। আপনারা লাশ নিয়ে দাফন কাফন করিয়ে ফেলতে পারেন।’ পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ভ্যানে উঠে পড়ল।
পুলিশ বেরিয়ে যেতে কান্নাকাটি করতে থাকা আত্মীয়পরিজনের দিকে তাকিয়ে বড়ভাই কাতর কণ্ঠে বলল, ‘লাশ এখনই দাফনকাফন করা যাবে না। বাবা খুন হয়েছেন। আমরা ডিটেকটিভ নিয়োগ দিয়েছি। তিনি লাশ নিয়ে তদন্ত করবেন।’
আত্মীয়স্বজন পিছু হটল। ডিটেকটিভের সাথে লাশ নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল তান্ত্রিকের সন্ধানে। ডিজিটাল তান্ত্রিক। মোবাইল আছে। ডিটেকটিভ নাম্বার দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিল। তাদের কেস হিস্ট্রি জানিয়ে যাগযজ্ঞ করে রাখতে বলল। ডায়েরির সন্ধান পেলেই তার ধনভাণ্ডারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে।
তান্ত্রিক তিলকরাজ আনন্দের কপালে চন্দনের বিশাল তিলক কাটা। ক্লিন শেভড। এক প্রস্ত গেরুয়া সারা গায়ে জড়ানো। মাথার চুলে জটা থাকলেও তা নকল। সেটা শুধু ডিটেকটিভ হোমস জানে।
যাগযজ্ঞের ঘটা দেখে তিনভাই ভড়কে গেল। তান্ত্রিকের কাছে আর রিমিকে আনেনি। ধুপধুনোর ধোঁয়ায় গোটা আস্তানা ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিছুই স্পষ্ট করে দেখা যায় না। তান্ত্রিকের মুখ বোঝা যায় না। শুধু গেরুয়া কালারটাই চোখে ভাসে।
বাবার লাশ তারা গেরুয়ার হাতে সমর্পণ করল। তান্ত্রিকের দুই গেরুয়াধারী সাগরেদ লাশ নিয়ে তান্ত্রিকের সামনে রাখল। তান্ত্রিক তিলকরাজ লাশটাকে বিশাল একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলো। ডিটেকটিভ হোমস গোয়েন্দাগিরি ফলাতে তান্ত্রিকের পাশে এসে বসল। তাদের দুজনের মধ্যে ফিসফিসানির কথাবার্তা হলেও আছন্ন ধোঁয়ার আড়ালে ভাইয়েরা কিছু দেখতে পেল না।
তান্ত্রিকের গম্ভীর গলা ভেসে এলো। ‘লাশের দিকে নজর রাখিস তোরা। লাশ জীবিত হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে। আত্মা ভর করছে লাশের শরীরে। এখনই লাশ দিকনির্দেশনা দেবে। তোদের হারানো জিনিসের সন্ধান জানিয়ে দেবে। কালো কাপড়ের দিকে নজর রাখিস।’
তিন ভাইয়ের চোখেই যেন ধান্ধা লাগল। কালো কাপড়ের ভেতর একটু নড়ে উঠেছে যেন। অবিশ্বাস্য! তিনজনেই চোখ কচলে ভালো করে তাকাল। তাইতো! ওইতো, লাশের ডান পাশটা উঁচু হয়ে উঠছে। মনে হয় ডান হাত উঁচু করে তুলছে। শীর্ণ আঙুল দিয়ে চারকোণা করে কিছু একটা দেখিয়ে দিচ্ছে।
ধারাভাষ্যকারের কাজ করতে লাগল তান্ত্রিকের মিডিয়াম। ফিসফিস করে জানিয়ে দিল, ‘ডায়েরিটা মিসিং হয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু যে জিনিসের খোঁজ সেটা ওই বাড়ির মধ্যেই আছে। ম্যাপটা বাড়িতেই আছে।’ একটু থামল। তারপর আবার ধারাবর্ণনা, ‘শুধু বাড়ির মধ্যে না। ওই ঘরের মধ্যেই আছে। যে ঘর ছেড়ে আত্মা বেরিয়ে গেছে।’ আবার বিরতি। ‘শুধু ঘরেই না। ওই বিছানাতেই আছে। আততায়ী প্রাণ নিলেও মানচিত্র নিতে পারেনি।’ আবার বিরতি। কালো কাপড়ের নড়নচড়ন। ‘আততায়ীকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন তিনি। আততায়ী ঘরের লোক। কাছের লোক।’ শ্বাস নেয়ার বিরতি। কালো কাপড়ের মধ্যে হাতপা সবই নড়েছে এবার। ‘তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কি জন্য আততায়ী এসেছে।’ এবার একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘তার আগেই মানচিত্রটা গায়েব করে ফেলেছিলেন তিনি।’
তিনজনই একই সাথে বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘গায়েব!’
ওদিক থেকে আর কোনো কথা নেই। কালো কাপড়ও নি®প্রাণ। তান্ত্রিক আবার তন্ত্রমন্ত্রের জোর বাড়ায়। আরেক পশলা ধোঁয়ায় ভরে যায় আস্তানা। আবার নড়ে ওঠে কাপড়। আবার নড়ে ওঠে মিডিয়ামের ঠোঁট, ‘গায়েব মানে অদৃশ্য নয়। গায়েব মানে উধাও। চোখের পলকে তিনি ম্যাপটা উধাও করে দেন তিনি।’
তিনজনে আবার একসাথে বলে উঠল, ‘কোথায়?’
ডিটেকটিভ হোমস বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘ধ্যানের সময় কোনো প্রশ্ন করবেন না। আত্মা নিজ থেকেই যা জানানোর সব জানাবে।’
মিডিয়ামের ঠোঁট সচল হতেই ডিটেকটিভ হোমস থেমে যায়, ‘ওটা তিনি হাতের কাছে থাকা মোবাইলের মধ্যে ব্যাটারির পেছনে ঢুকিয়ে ফেলেন।’
তিনজনের কণ্ঠেই বিস্ময়, ‘মোবাইলের ভেতরে!’
মানচিত্রের অবস্থান জানার সাথে সাথেই তিনজনেরই ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বাবার লাশ নিয়ে দাফনের কথা যেন তাদের মনে থাকে না। লাশ ছাড়াই চলে যেতে পারলে বাঁচে।
ধোঁয়ায় এবং নিজেদের লোভের কারণে কেউ খেয়াল করেনি ডিটেকটিভ হোমস বাড়িতে রেখে আসা অ্যাসিসটেন্টকে মোবাইল ফোনে কি যেন নির্দেশ দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তাদের বের হওয়ার আগেই পেছনের দরজা দিয়ে তান্ত্রিক আর ডিটেকটিভ উধাও।
তান্ত্রিককে দেখে এখন আর চেনার উপায় নেই। পুরোদস্তুর পর্যটকের পোশাক। থ্রিকোয়ার্টার প্যান্ট, কেডস, গায়ে টিশার্ট, মাথায় বারান্দাওয়ালা টুপি, গলায় ঝুলছে বাইনোকুলার। সে অনুযায়ী ডিটেকটিভ হোমসের পোশাক ভদ্রই বলা যায়। অফিসিয়াল পোশাক। প্যান্টের পকেটে লাইসেন্স করা পিস্তল।
তান্ত্রিক বিরক্ত গলায় বলল, ‘এ কোথায় এনে ফেললেন ভাই? এদিক দিয়ে আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
ডিটেকটিভও কিছুটা সন্দিহান, ‘ম্যাপে তো এরকমই দিকনির্দেশনা দেখছি। সেই অনুযায়ী চলছি।’
‘ওই ভাইদের কি অবস্থা?’
ডিটেকটিভ নিজের বুদ্ধিতে হেসে ফেলল, ‘কি অবস্থা আবার? ওরা হয়তো এতক্ষণে আলেয়ার পেছনে ঘুরে ঘুরে মরছে। রতœভাণ্ডার ম্যাপ অ্যাসিসটেন্ট দিয়ে বদলে দিয়েছে। মোবাইলের ভেতর অন্য ম্যাপ ভরে দিয়েছে। ওদের যাওয়ার কথা সুন্দরবনে। ওরা এখন হয়তো বান্দরবনে। বান্দর খুঁজে মরছে।’
‘তার মানে আমরা এখন সুন্দরবনের দিকে রওনা দিয়েছি।’
‘হু। ম্যাপে তো সেরকমই যেতে বলছে। ম্যাপ ধরে ধরে যাচ্ছি। এখন নৌকায় চড়ে যেতে হবে। ম্যাপের নির্দেশ। আপনি দাঁড়ান। আমি বড় নৌকা ভাড়া করছি।
নৌকা মাটি ছেড়ে পানিতে ভাসতেই তান্ত্রিকের কেমন যেন হালকা বোধ হলো। সাঁতার না জানায় ডুবে যাওয়ার ভয় তাকে সবসময় কাবু করে রেখেছে। সে নৌকার দুপাশ ধরে ধরে কোনোমতে ভেতরে এসে বসল। তারা ভেতরে বসতেই নৌকা ছেড়ে দেয়ায় ঠাণ্ডা বাতাস তাদের কাঁপিয়ে দিল। ঢাকায় অগ্রহায়ণের শীত না লাগলেও এদিকে মনে হচ্ছে শীত পড়ে গেছে। মাঝি সামনে থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘সাব, ঠাণ্ডা লাগলি কইয়েন, ছইয়ের সামনে পর্দা লাগাই দিবানে।’
ডিটেকটিভ জোরেই বলল, ‘এখন থাক মাঝি ভাই। শীতের বাতাস মিষ্টিই লাগছে।’
তান্ত্রিক মনে মনে চাইছিল পর্দা দেয়া হোক। তাহলে ডিটেকটিভের সাথে কিছু কথা বলা যেত। সে ডিটেকটিভের একেবারে কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘ভাই, একটা খারাপ খবর আছে?’
ডিটেকটিভ গলা না নামিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘কি?’
তান্ত্রিক দাঁড়টানা মাঝির দিকে একবার তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘হালকা একটু ধ্যানে বসছিলাম। তন্ত্রমন্ত্রের মধ্যে দেখতে পেলাম, ওরাও আমাদের অনুসরণ করে এইদিকে আসছে। সম্ভবত পাইকগাছা পর্যন্ত এসে গেছে।’
ডিটেকটিভ গলা নামিয়ে বলল, ‘বলেন কি? ওরা কি আমাদের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে নাকি?’
‘আপনি যে অত গোয়েন্দাগিরি করছিলেন, না বুঝে কি পারে? কয় না চোরের মন পুলিশ পুলিশ। ওরা ঠিকই কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়ে পিছু নিয়েছে। ওরা আসল ম্যাপ না পেলেও আমাদের সন্দেহ করেছে। সন্দেহ করে আমাদের পিছু নিয়েছে। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে।’
তাদের কথোপকথনের কিছুটা বোধহয় মাঝি শুনে ফেলেছে, একটু ইতস্তত করে বলল, ‘সাবেরে কুনো ঝামেলায় পড়িছেন নাই? আমারে কতি পারেন, এদিকের ঝামেলা আমি মিটাতি পারবানে। এই হেকিম মাঝির জন্মই বলতি গিলি বাদায়। শুধু মাঝিগিরি না অনেক কামই করি। আমারে কতি পারেন।’
তান্ত্রিক ডিটেকটিভের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার মনে হয় মাঝি ভাইরে আমাদের আসল কথা বলে দেয়াই ভালো। তাতে বিপদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। আমি বিপদ দেখতে পাচ্ছি ভাই।’
ডিটেকটিভ বিরক্ত গলায় বলল, ‘আপনি এত ভীতুর ডিম তা জানতাম না তো। ঢাকায় তো আপনাকে কোনোদিন ভয় পেতে দেখিনি।’
তান্ত্রিক শুকনো মুখে বলল, ‘ডাঙার প্রাণী জলে ছেড়ে দিলে কি অবস্থা হয় বোঝেন। আমার অবস্থাও তাই। শহর অঞ্চলে আমি সবই করতে পারি। কিন্তু এই জঙ্গলে আমার হাত পা বাঁধা।’
নৌকা মাঝির দাঁড় বাওয়ার কারণে বেশ জোরে জোরেই এগিয়ে যাচ্ছে। পানিতে শুধু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। দুপারের জনজীবনে রাতের প্রস্তুতি। বড় নৌকা হওয়ার কারণে দুপাশে ছোট ছোট চারকোণা দুটো জানালাও আছে। ডিটেকটিভ জানালা তুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, ‘নদীর নিজস্ব একটা সৌন্দর্য আছে। সেটাই দেখেন। সুন্দরবনের চিন্তা পড়ে। আর ধনরতেœর চিন্তা আরো পরে। আগে ওরা আসুক, তারপর দেখা যাবে।’ ডিটেকটিভ চুপ করে গেল। তান্ত্রিকও চুপ করল, সেটা ভয়ে না নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তা বলা যায় না।
নৌকা একটা গতিতে চলে এসেছে। গতি চলে এসেছে মাঝির দাঁড় বাওয়াতেও, কেমন যেন ছান্দিক তালে পেটের সাথে দাঁড়ের মাথা বাঁধিয়ে একবার এদিকে একবার ওদিকে যাচ্ছে।
তাদের নৌকার পাশেই একটা কালো জীব হুশ করে মাথা উঁচিয়ে আবার ডুবে গেল। ডিটেকটিভের কাছে মনে হলো কালো পোশাকের কোনো আততায়ী ডুবুরির মতো তাদের পিছু নিয়েছে। পানিতে ডুবে ডুবে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। তিমি শিকারিদের মতো হারপুন দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে তাদের। কিছু না হলেও নিদেনপক্ষে তার পা ধরে যদি হেঁচকা টান দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়! সে তো সাঁতার জানে না।
ডিটেকটিভ নদীর পানির দিকে পিস্তল তাক করতেই হাকিম মাঝি ঢোক চিপে বিস্মিত গলায় বলল, ‘সাব, কি করতিছেন? পানিতে গুলি করতিছেন ক্যান? পানিতে কিডা আছে?’
ডিটেকটিভ একটু বিভ্রান্ত হলো। তখনই আবার মাথা তুলে দিল কালো প্রাণীটা। শুয়োরের মতো সুচালো মুখ। মাঝিও দেখলে সেদিকে। ‘মাইরেন না, মাইরেন না, ওডা আপনাগির কোনো ক্ষেতি করতি পারবিনানে।’
তান্ত্রিক ঢোক চিপে বলল, ‘কী ওটা?’
‘ওটারে চিনতি পারলেন না? ওটা শোষ।’
‘শোষ কী?’
হাকিম মাঝি শোষ কি ঠিক বুঝিতে দিতে পারলো না। আমতা আমতা করে বলল, ‘শোষ হলো গে শোষ।’
ডিটেকটিভ এবারে প্রাণীটারে চিনতে পারল। এতদিন শুধু নাম শুনেছে, এখন চুষ দেখল। সে বুঝিয়ে বলল, ‘শোষ মানে শুশুক। গ্রামের লোক শুশুকরে শোষ বলে ডাকে। ডলফিনের মতো প্রাণী।’
‘শুশুক কি কামড়ায়? মানুষ খায়?’ তান্ত্রিক ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করল। সাঁতার না জানায় পানির সব প্রাণীকেই তার কাছে ভয়ংকর মনে হতে থাকে।
‘ডলফিনে কি মানুষ খায়? বললাম না, শুশুক ডলফিন প্রজাতির প্রাণী।’
‘এই নদীতে কি কোনো কুমির টুমির আছে নাকি?’ তান্ত্রিক ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
হাকিম মাঝিই উত্তর দিল। ‘কুমির নাই সাব। কুমির বাদার ধারের গাঙে আছে।’
‘তা জানি। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ।’ তান্ত্রিক কথার মাঝখানে বলল।
হাকিম মাঝি দাঁড়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘সাব, কুমির না থাকলিও কামোঠ আছে কিন্তুক।’
তান্ত্রিক আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কামোঠ কি?’
হাকিম মাঝির হয়ে ডিটেকটিভ উত্তর দিল, ‘কামোঠ কুমিরের চেয়ে ছোট এক ধরনের ভয়ংকর প্রাণী। কুমির ধরলে গোটা মানুষ খেয়ে ফেলে। আর কামোঠে কচ করে হাত পা কেটে নিয়ে যায়। খুব ধারালো দাঁত এই ভয়ংকর প্রাণীটির।’
‘ঠিক কইয়েছন স্যার। চরে নিমিষেই পা হাওয়া।’ হাকিম মাঝি ফোড়ন কাটে।
কামটের ব্যাপারটা ডিটেকটিভ কিছুটা জানত। আর কিছুটা মাঝির কাছ থেকে শুনল। কুমিরের চেয়ে কামোঠেই এই মাঝিদের বেশি ভয়। কামট হাঙর শ্রেণির হিংস্র জলজšুÍ। হাঙরের মতোই অতি তীক্ষè দুই পাটি দাঁত। আকারেও একটু ছোট। রঙটা কালো-সবুজ শ্যাওলার মতো, মুখ অনেকটা শুকরের মতো ছুচালো। অতি প্রি আর দ্রুতগামী এবং সজাগ জলচর প্রাণী। মানুষবাহী নৌকার এবং মনুষ্যবসতি ডাঙার কাছেপিঠেই তারা ঘুরে বেড়ায়। আর সুযোগ পেলেই ধারালো দাঁতে নিমিষেই অঙ্গ বিছিন্ন করে নেয়। কুমির তবু চিবিয়ে খায়, কামোঠ যান্ত্রিক ধারালো করাতের মতো চোখের পলকে শরীর টুকরো টুকরো করে দেয়।
‘শরীলে আর কুলোতিছে না সাব, ভরা প্যাট যে! এট্ট জিরোয় নিতি চায়িলাম।’
ডিটেকটিভ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘ঠিক আছে। বড় গাঙের মুখে গিয়ে ঘণ্টাখানিক বিশ্রাম নেবেন। আজ রাতটা কষ্ট করেন। আপনারে পোষায় দেয়া যাবে।’
আরো খানিকদূর যেতেই নদীর কিনারে সারবাঁধা কয়েকটা নৌকা দেখা গেল। সবগুলো নৌকার ভেতরেই অন্ধকার। মনে হয় এত রাতে সব ঘুমিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে।
মাঝি নৌকায় লগি দিতে দিতে বলল, ‘স্যার, ঘুমোতি চালি এট্টুখানি ঘুমোয় নেন। বাদাবনের কাছে আলি কত বিপদ যে হতি পারে তার ঠিকঠিকানা নেই। তখন ঘুমাতি পারবেন না।’
ছইয়ের ফাঁক দিয়ে ডিটেকটিভ দেখল বাইরে অন্ধকার জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। চাঁদের আলোও কমে আসছে। আরেকটু পরে হয়তো পুরোপুরি কমে যাবে। সে হ্যারিকেনের জোর কমিয়ে আবার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
নৌকার দুলুনির তালে তালে ঘুমটা যখন জেঁকে এসেছিল তখনই ডিটেকটিভের মনে হলো কে যেন তার গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। ভূমিকম্পের সময় যেমনটি মনে হয় তেমন। জোরে জোরে ধাক্কা দেয়ার কারণে সে ধড়ফড় করে কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে বসল। তান্ত্রিক তার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। হ্যারিকেনের মিটিমিটি আলোয় তার মুখের ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ডিটেকটিভ ফিসফিস করে বলল, ‘ওরকম ধাক্কাচ্ছেন কেন? কী হয়েছে? নৌকায় বাঘ পড়েছে নাকি?’
তান্ত্রিকও ফিসফিস করে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘বাঘের চেয়ে বেশি। মাঝি ব্যাটার মতলব সুবিধের না মনে হচ্ছে। আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে নৌকা ছেড়ে দিয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে নৌকা কোনো মতলবে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে কে জানে? হয় বাঘের মুখে ছেড়ে দিয়ে আসবে, নয়তো ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়ে কুমির কামোঠকে দিয়ে খাওয়াবে। এই মাঝিই যে ডাকাত না তার কি প্রমাণ আছে? কেমন ডাকাতের মতন চেহারা দেখেন। আর ডাকাত না হলেও ডাকাতের সাথে যোগাযোগ আছে। মাঝিই তো আগে বলল এদিকে বন্দুক কেড়ে নেয়ার জন্য ডাকাতি হয়। আমাদের পিস্তল কেড়ে নেয়ার জন্যও যদি ওরা ডাকাতের হাতে তুলে দেয়?’
সন্দেহটা ডিটেকটিভের কাছেও অমূলক মনে হলো না। এই অপরিচিত জায়গায় শুধুমাত্র পিস্তল সম্বল করে কতটুকু কি করা যায় বোঝা যাচ্ছে না। তবে মাঝি যে নৌকা ছেড়ে দিয়েছে, নৌকার দুলুনি আর ছপছপ শব্দে সেটুকু বোঝা যাচ্ছে।
ডিটেকটিভ ফিসফিসানি বজায় রেখেই বলল, ‘আমরা যে জেনে গেছি বা ভয় পেয়েছি এটা মাঝিকে বুঝতে দেয়া যাবে না।’ তারপর গলা আরো নামিয়ে বলল, ‘ঘুমের ভান করে সজাগ থাকতে হবে। অন্য কারোর সাথে মাঝির কথাবার্তা বা কোনো কিছু করার মতো দেখলে আগে মাঝি ব্যাটাকেই…’
বাইরে রাতের অন্ধকার। চাঁদ পুরোপুরি ডুবে গেছে। অন্ধকার আকাশে তারার মেলা। এক পাশে বনের ছায়া কালো কালো। অন্যপাশে দিগন্ত বিস্তৃত পানির আকাশ। আর কিছুই দেখা যায় না। মাঝির দাঁড়ের ঝপাঝপ আঘাতে পানিতে অজস্র জোনাকির মতো জ্বলজ্বল করছিল।
তান্ত্রিক জলজোছনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে সব ভয় ভুলে অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, পানিতে জ্বলছে ওগুলো কী?’
‘ফসফরাস। সাগরের পানিতে ফসফরাস থাকে। স্রোতের সাথে তাই জ্বলে।’
‘আমরা সমুদ্রে এসে পড়েছি নাকি?’
‘জি, সাব। বড় গাঙ ছাড়াইয়ি সাগরে পড়িছি অনেক আগে। আপনার ঘুমাই পড়িলেন এজন্যি আর ডাকতি যায় নি?’ হাকিম মাঝি দাঁড় টানতে টানতে ক্লান্ত গলায় বলল।
‘আমরা কোথায় কতদূর এলাম মাঝি ভাই?’ ডিটেকটিভ ভয় না পাওয়ার ভান করে প্রশ্ন করল।
মাঝি দাঁড় স্থির রেখে মাথা চুলকায়ে বলল, ‘বুঝতি পারতিছিনে সাব, লৌকা চালাতিছি খুব। কিন্তুক কোন জায়গায় যে আসবার লাগলাম ঠাহর করতি পারতিছিনে। অন্ধকারে পথ হারায়ি ফেলিছি কিনা সেইটা ধরবার পারতিছিনে।’
ডিটেকটিভ এবার সত্যিকারের ভয় পেল। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘কি বলছেন? পথ হারিয়ে ফেলেছেন মানে? কোন দিকে যাচ্ছেন বুঝছেন না? এদিকের সব কিছু চেনেন না?’
‘চিনি তো সাব। কিন্তুক এই অন্ধকারে ওদির বাদাবন আর এদির সাগর। সব একরম লাগতিছে। যাতি থাহি, সকাল হলি ঠিক বুঝবার পারবানে। ভয় পাইয়েন না।’
‘ভয়ের কিছু আছে নাকি?’
‘জে না। ভয় কি? সাগরের টানে লৌকো ভাসি যায়। আমাগির লৌকো বাদাবনের ধার দিয়ি চালাতিছি। পুলিশির ভয় আছে। আপনার তো সরকারি লোক। তালি পরে আর ভয় কি?’
তান্ত্রিক ইতস্তত করে বলল, ‘ডাকাতের কথা বলছিলেন যে?’
‘ডাকাতির কি আর ঠিকঠিকানা আছে? ধরলি ঘপ করি লৌকো বেড় দিয়ি ফেলবেনে। সেজন্যি তো আপনারা রইছেনই।’
তান্ত্রিক প্রশ্ন করল, ‘আমরা কি সুন্দরবনের কাছাকাছি এসে গেছি?’
‘জে। এখন আমরা বাদাবনের কুল দিয়ি যাতিছি। রাত্তিরে কিছু দেখতি পাবেন না। বেয়ান হোক।’
তারা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। অজানা রূপ রহস্য রোমাঞ্চে ভরা সুন্দরবন! পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন! রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সুন্দরবন!
ভোরের জন্য প্রতীক্ষায় থাকলেও নৌকার দুলুনিতে ঝিমঝিম ভাব চলে এলো। ঠাণ্ডা মনোরম হাওয়া শরীর কাঁপিয়ে দিতে লাগল। ভোরের নিজস্ব কোনো আর্কষণ আছে বোধহয়। মাঝিও নৌকা কোনো একটা খালের কাছে রেখে খালের পানি দড়ি বাঁধা বালতি দিয়ে তুলে অজু করে নামাজ পড়ে নিল। নামাজ শেষে তাদের ঝিমুনি ভাব দেখে মাঝি আর ডেকে তুলল না।
ডিটেকটিভের ঝিমুনি ভাব আগে ছুটল। সে নৌকার বাইরে এসে কুয়াশা মাখা ভোরে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। সবুজ বনবনানী ছাওয়া সুন্দরবনের কেওড়াগাছ দেখা যাচ্ছে। পাড়জুড়ে বিস্তৃত শ্বাসমূল। মাটি থেকে শূলের মতো উঁচু হয়ে থাকা গাছের শেকড়। জোয়ারের নোনা পানির মাঝে বেঁেচ থাকার জন্য গাছগুলোকে প্রকৃতি এই কৌশল দিয়েছে।
কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা তান্ত্রিককে ডিটেকটিভ ঠেলে তুলে দিল। সকালের এই অসাধারণ সুন্দরবনের ভোর দেখা উচিত। না হলে সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে। তান্ত্রিক ধড়ফড় করে উঠে বসে বলল, ‘কী? কী হয়েছে?’
ডিটেকটিভ আনন্দিত স্বরে বলল, ‘সুন্দরবন হয়েছে? ভোর হয়েছে? প্রাণ খুলে দেখ।’
তান্ত্রিকও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বনের দিকে। গত রাতের সকল ভয় ভোরের আলো ফুটতেই কর্পূরের মতো উবে গেছে। কুমির কামোঠের ভয়, বাঘের ভয়, ডাকাতের ভয়, সৌন্দর্যের সামনে সব ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেছে যেন।
তান্ত্রিক আনন্দিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা এখন কোন জায়গায় আছি হাকিম ভাই?’
‘ঠিকমতো কতি পারতিছিনে। আঠারোবেকি না নবেকি কোনদিকে যে চলি আলাম।’
‘হিরণপয়েন্ট কোনদিকে?’ তান্ত্রিক সুন্দরবনের এই একটিমাত্র জায়গার নাম জানে। পত্রিকায় আরো কয়েকটা জায়গার নাম যেন পড়েছিল। নীলকমল রেঞ্জ না কি যেন!
‘সেডা তো এদির না। আপনারা তো ওদির যাতি কলেন না। ওদের গিলি আরামে থাকতি পারতেন। ফরেস্ট অফিস, পিকনিকের জায়গা, বেড়ানির জায়গা, পুলিশ, বন্দুকয়ালা বনরক্ষী সব আছে।’
বনরক্ষীর কথা শুনেই নাভিদের নামে বনরক্ষক অথচ কামে বনভক্ষক ওসমান গণির কথা মনে পড়ে গেল। এ মানুষগুলো বনের মানুষখেকো বাঘের চেয়ে ভয়ংকর!
বড় খালের মধ্যে এসে পড়ায় এখন আর দাঁড় টানতে হচ্ছে না। বৈঠা মেরেই নৌকা চলছে। বানর প্রজাতির ছটফটানির কারণেই কিনা কে জানে খিদে আর কৌতূহল দুটোই বেশি মনে হয়। চরের দিকের কেওড়াগাছ বেয়ে বেয়ে চলে এসেছে। দুএকজন চরার উপরের দিকে কাকড়া খুঁজছে। হাত ব্যবহার করার স্টাইলটা ঠিক মানুষেরই মতন।
খালগুলো পানিতে কানায় কানায় ভরে উঠেছে। মাঝি জানাল, ‘গোন লাগিছে।’ খালের পাড় ডুবে দু-এক জায়গায় হাঁটু পানিও উঠে গেছে। মাঝি জানাল, ভাটার সময় পানি শুকাই যায়। তখন খালে নোনা পানির ছোট ছোট মাছ পাওয়া যায়।
আরো খানিক দূর এগুতেই খালের ধারে ধারে বিখ্যাত গোলপাতার গাছ দেখা গেল। পাতা গোল নয়Ñ নারকেল পাতার মতো। আবার নারকেল গাছের মতো বড় গাছ হয় না। একেবারে গোড়া থেকে পাতা গজায়। গোলপাতা দিয়ে ঘরের মজবুত ছাউনি করে সাতক্ষীরা খুলনার গ্রামের মানুষেরা। দুর্গম গহীন এলাকা থেকে যারা গোলপাতা, গাছের গুড়ি, কাঠ কেটে আনে তাদেরই বাওয়ালি বলে। হাকিম মাঝির মুখেই জানা গেল এসব। সে নিজেও জাতে বাওয়ালি।
মাঝির কাছে জানতেই মাঝি জানাল, এই জায়গাগুলোতে সে কখনো এসেছে বলে তার মনে পড়ে না। সুন্দরবনে অসংখ্য জায়গা আছে যেগুলো ভয়াল সুন্দর, কিন্তু অনাবিষ্কৃত। সেসব জায়গায়, কাঠচোর, ডাকাত, বনদস্যু, শিকারিরা অনায়াসে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে। কেউ কখনও খোঁজ পাবে না। পর্যটনের লোকেরা তো দূরে থাকুক, বনরক্ষী, কোস্ট গার্ডের লোকেরা, রেঞ্জ, বন পুলিশেরাও এখনও সেদিকটাতে আসে না। বাঘ সাপখোপের ভয় নয়, এত বড় সুন্দরবন যে সব জায়গা সার্ভে করা বন বিভাগের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। দুর্বৃত্তদের সুবিধা হয়ে যায় সে কারণেই। আর এসব জায়গাতে নিরাপত্তারও বড় অভাব। যে কারণে মাঝিরা বেশি ভাড়া পেলেও আসতে চায় না। হাকিম মাঝি এক নাগাড়ে কয়েকটা জায়গার নাম বলে গেল। নামগুলো প্রায় একই জাতীয়। গেওয়াখালী, ভোমরখালী, চানমিয়াখালী, টিয়ারচর, কোলারচর, কালীর চর। নাভিদের কোনো নামই মনে থাকল না।
তান্ত্রিক বেশ মজলিসি মেজাজে বলল, ‘মাঝি ভাই, আমরা কোনদিকে চাচ্ছি?’
মাঝি অনিশ্চয়তার সুরে বলল, ‘যাতি থাকি। বাঁদার সব খাল নদী আর সাগরেরতে আয়িছে। যাতি যাতি আরেট্টা খালে, আরেট্টা নদীতে পড়তি যাতিছি। খোলপাটুয়ার দিকে চলি যাতিছি মনে হতিছে।’
মাঝি চিড়ে গুড় খাচ্ছিল। সকালের নাশতা। মাঝির গালে চিড়ে থাকায় জড়িয়ে চিৎকার দিয়ে কি কথা বলল ডিটেকটিভ বুঝতে পারল না। শুধু ‘পারা পারা’ শব্দটাই ভেসে এলো।
‘কী হয়েছে হাকিম ভাই? কী দেখেছেন?’
হাকিম ভাইয়ের গালের চিড়ে শেষ। এবারে কথা পরিষ্কার বোঝা গেল। ‘ধাক করি এ জাগা পেরুতে হবি। না হলি বড়মামার পেটে চলি যাতি পারি।’
তান্ত্রিক আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘কেন? বড়মামা কে? নামকরা বড় ডাকাত?’
‘সাব, বড়মামা হলো গিয়ে ওই আপনারা কি কন রয়েল বেঙ্গল…’
‘বুঝেছি। কিন্তু বাঘের কথা কি বলছিলেন?’
‘এদিকি তেনারা আছেন। ওই যে দেহেন তেনাদের পায়ের পারা।’
মাঝির আঙুল উঁচিয়ে দেখানোর পাশাপাশি নদীর চরায় বাঘের তাজা পায়ের ছাপ দেখতে পেল তারা। ওহ, ক্যামেরা থাকলে, ছবি তুলে নেয়া যেত।
তান্ত্রিক বলল, ‘ভাই, আপনার মোবাইলে ক্যামেরা আছে না? বাঘের পায়ের ছবি তোলেন?’
এতক্ষণে ডিটেকটিভের মোবাইলের কথা মনে পড়ল। এরকম ভুলোমন নিয়ে তার গোয়েন্দা হওয়াই উচিত না। আসলে নেটওয়ার্কের অভাবে এদিকে কোনো সাড়াশব্দই ছিল না মোবাইলে, এজন্যই ভুলে থাকা। সাড়া না থাকলে ভুলে থাকা সহজ।
ডিটেকটিভ মোবাইল বের করে নেটওয়ার্ক পেল না। তবে ক্যামেরা কাজ করল। যদিও মাঝি বাঘের ভয়ে বৈঠা বেয়ে নৌকা বেশ এগিয়ে নিয়ে গেছে। ছবি উঠল ঝাপসা। অভিজ্ঞ মাঝি পায়ের ছাপ দেখেই বলল, ‘জাগা খারাপ। ছবিটবি পরে তুলেন। আগে জান বাঁচান।’
‘কেন বাঘ ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে নাকি?’ ডিটেকটিভ পিস্তল বের করে হাতে নিয়েছে।
‘পিস্তলের গুলিতি মানুষ মরলিও তেনাদের কিছু হইতো না। পারা দেখে বুঝতিছেন না তেনারা দুতিনজন আছে। রাতে পানি খাতি আসিলো। পার হয়নি। বনের মধ্যি আছে। পার হলি পরে বুঝতি পারতাম।’ মাঝি ইতস্তত করে বলল, ‘বনের ধারে লৌকো। তেনাদের ঝাপ তো দেহেননি।’
আর ছবি তোলায় প্রবৃত্ত হলো না। এক বাঘের পায়ের ছাপ দেখেই বাঘ শিকার এবং মানুষখেকো বাঘের নিরীহ মানুষ শিকারের গল্প একের পর এক বেরুতে লাগল। দুর্ধর্ষ শিকারি মেহের গাজী, তার ছেলে পচাব্দী গাছের নাম, তাদের দুঃসাহসিক শিকার কাহিনী চলে এলো। বাদাবনের পীর মান্দার পীরের নামও উঠল। এদিকের অনেকের নামই মান্দার পীরের নামে। মাঝি বাঘের পা নিয়ে এখানকার প্রচলিত একটা ছড়া কাটল। ‘ঘাটে গিলো জা’র (জায়ের) মা,/দেখি আইলো বাঘের পা।/ তুই কলি, মুই শুনলাম/মরি বাঁচি বাঘ দেখলাম।’
ছড়াটা শুনে তারা হেসে ফেলল। এক ছড়ার মধ্যেই এখনকার সুন্দরবন ভ্রমণকারী পর্যটকদের কি তীব্রভাবেই না ব্যঙ্গ করা হয়েছে। বাঘের পায়ের ছাপ দেখে অথবা না দেখে শুধু মুখে শুনেই বাঘ দেখার তৃপ্তি মেটাতে হয়। তাদের ভাগ্যেও বাঘ দেখার সৌভাগ্য আছে কিনা কে জানে!
সৌভাগ্যের কথা বলতে বলতেই সৌভাগ্য হাতের নাগালে চলে এলো। কিন্তু এতই ভয়াল সেই সৌভাগ্য যে তাদের চোরের মতো ছইয়ের ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে বাঘ দেখতে হলো।
নৌকা চলছে সরু খালের ভেতর দিয়ে। মাঝি জানাল, এরকম ছোট খালের মতো কিছু ভারানি আছে। সেই ভারানির মধ্য দিয়ে চলছে। ভারানির দুপাশেই কেওড়া আর গোলপাতা বন। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর মেলে বন দেখা গেল। বড় বড় এক মানুষ দেড় মানুষ ঘাস জাতীয় প্রজাতি। উপরের দিকে দ্রু দ্রু ফুল। এই মেলে দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ মাদুর তৈরি করে। মেলের মাদুর সারা বাংলাদেশে একমাত্র দক্ষিণাঞ্চলের লোকেই সাপ্লাই দেয়। সে সবুজ মেলে বনের মধ্যে হলুদ ছোপ ছোপ। হলুদ কালো ডোরা রয়েল বেঙ্গল টাইগার মাথা বের করে নদীর নৌকা বিস্ময়ের সাথে দেখছে। যেমন বিস্ময়ে তারা বাঘ দেখছে। বাঘ ভাবছে এই আপদ আবার এদিকে এলো কিভাবে?
এবারে আর ছবি তোলার কথা মনে হলো না। এত কাছ থেকে বাঘ দেখার সৌভাগ্যের পাশাপাশি দুর্ভাগ্য জড়িয়ে আছে। মানুষখেকো বাঘ হলে কোনো তালজ্ঞান ছাড়াই ঝাঁপিয়ে পড়বে নৌকার উপরে। পিস্তলে কাজ হবে না। বন্দুক ছাড়া বাঘ মারা যায় না। তাও পাকা শিকারিরা ছাড়া পারে না।
দুপুরেই দর্শন শেষ হলো। বাঘ মেলে বনের মধ্য দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আল্লা আল্লা করতে করতে মাঝি খালের মাঝখান দিয়ে লগিবৈঠা মেরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
সকাল পুরোপুরি ফুটে গেছে। রোদ চড়াও হয়েছে জোরালো ভাবে। গাছের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে যেটুকু সোনারোদ আসছে তার নির্মলতা গোটা পরিবেশকে বিশুদ্ধ করে দিচ্ছে। বাঘ দেখার আতঙ্ক বা আনন্দের রেশ কারোর ভেতর থেকে এখনো কাটেনি। মাঝিও স্বীকার করল এত কাছ থেকে বাঘ সে কোনো দিন দেখিনি টাক মাথার এক ধরনের পাখি দেখা গেল। ওটা মদনটাক। যতই এগুনো যাচ্ছে ততই পাখির কলকাকলি বাড়ছে। একটা জায়গার ওপর দিয়ে বেশ কয়েকটা শকুন উড়তে দেখা গেল। উড়ে আবার ভেতরে কোথায় যেন গিয়ে গিয়ে বসছে। শকুন মানেই কিছু মরেছে বোধহয়। হয়তো বাঘের খাওয়া ভুক্তাবশেষ পড়ে আছে। মানুষখেকো না হলে হরিণই শিকার করেছে হয়তো। হরিণ বাঘের প্রিয় ডিশ।
হরিণ আর তাদের দেখিয়ে দিতে হলো না। হরিণের কারণেই এদিকে বাঘের আনাগোনা বেশি মনে হয়। তাছাড়া এই অনাবিষ্কৃত জায়গাটা বোধহয় কিছুটা অভয়ারণ্যের মতো। সুন্দরবনের চিত্রল হরিণের মতো এত সুন্দর হরিণ বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই। চিড়িয়াখানায় মানুষ দেখতে অভ্যস্ত হরিণ দেখা এক রকম আর অবাক চোখে চরের কাছাকাছি এসে বোকার মতো তাদের দেখতে থাকা হরিণ আরেক রকম। এই সৌন্দর্যের কোনো তুলনা নেই। কেমন মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে থাকে। দেখলেই মায়া লাগে। এই মায়ার জীবগুলোকে মানুষ শুধু রসনা তৃপ্তির জন্য মেরে খায় কিভাবে!
এদিকে বালিহাঁসের ছড়াছড়ি। অন্য পাখিও চোখে পড়ছে। নাম না জানা পাখি। ছোট রঙিন কাকড়া আর জলজ পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করে। মাছরাঙা, ঈগল, কাক তো পরিচিত পাখিই।
এতসব নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মন অবশ হয়ে আসে। তখনই হাকিম মাঝি বলল, ‘আর ভয় নেই। এইবার গাঙে গিয়ে পড়তি পারি।’
ডিটেকটিভ যেন সরু খালের দুপাশের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে পড়েছিল। সে একটু বিরক্ত গলায় বলল, ‘বড় নদীতে গিয়ে পড়লে কি সুবিধা?’ যেন সে ছোট খাল ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না।
‘বড় গাঙের কোনখানে যদি এট্টা কুপে পাওয়া যায়।’
কুপের ব্যাপারটা মাঝির কাছ থেকে জেনে নিল। কুপ হলো বনের একটা নির্দিষ্ট চিহ্নিত এলাকা, যেখানে জেলে বাওয়ালি মৌয়ালরা বন বিভাগের তদারকিতে কাজ করে। একজন আরেকজনের প্রয়োজন মেটায়। কিছুটা স্টেশনের মতো। সেখানে গেলে খোঁজখবর করে তারা এখন কোথায় জানা যাবে। মান্দারের নৌকার সন্ধান জানা যেতে পারে। বা তাদের গন্তব্যও ঠিক করতে পারবে।
মাঝির বড় কুপ দূরে থাক, বড় গাঙই পাওয়া গেল না। তবে সরু খাল ছাড়িয়ে নৌকা বড় আরেকটা খালে গিয়ে পড়ল। বড় খাল যখন তখন সামনে হয়তো বড় নদী পড়বে। নয়তো অন্য কোনো নৌকারও হয় তো দেখা পাওয়া যাবে। না হলে কোথায় ঘুরে মরছে কিছুই জানা যাবে না। হাকিম মাঝি নিজেও অনেকখানি চুপসে গেছে। রাতের অন্ধকারের পথ হারানোর ভোগান্তি যে এভাবে তাকে দিতে হবে সে বুঝতে পারেনি।
দুধারেই সুন্দরবন। গোলপাতার ঝাড়। শ্বাসমূলের পাশেই কেওড়া গাছ। নদীর চরে রঙিন কাকড়া। বালিহাঁস চরে বেড়াচ্ছে। নানানরকম পাখপাখালির কলকাকলিতে মুখর চারিপাশ। বাদরের বাদরামিও চোখে পড়ছে এগাছ থেকে ও গাছে।
চারিদিকে প্রকৃতির শব্দ ছাড়া যান্ত্রিকতার কোনো শব্দ নেই। এ এক অপূর্ব মুগ্ধতা! যান্ত্রিকতার কোলাহলমুক্ত অবিশ্বাস্য রহস্যময়তা! যান্ত্রিক নিস্তব্ধতা!
এরকম সময় ওরা স্তম্ভিত হওয়ার মতো দৃশ্যটা দেখতে পেল।
সুন্দরবনের সব রূপ রস রহস্য রোমাঞ্চের প্রতিভূ হয়ে সোনালি দেহের অধিকারী পৃথিবীর অন্যতম সম্পদ বিশালাকারের বাঘ খালের এপাড় থেকে সাঁতরে ওপারে পার হচ্ছিল। গোটামাথা আর পিঠের উপরে সোনালির ডোরর কিছুটা দৃশ্যমান ছিল। এবং একেবারে সোজাসুজিই পার হচ্ছিল। পরে অবশ্য হাকিম মাঝি জানায়, বাঘেরা সোজাসুজি নদী বা খাল পার হয়। স্রোতে কোনোভাবে বেঁকে গেলে আবার গোড়ার থেকে শুরু করে। অর্থাৎ মূল জায়গায় ফিরে এসে সোজা পার হবে। এভাবে হাজারবার করতে হলেও করবে।
বাঘ খাল পার হয়ে কোনোদিক ভ্রু ক্ষেপ না করে চরের বালির উপর উঠে বিড়ালের মতো গা ঝাড়া দিয়ে পশমের পানি ঝেরে ফেলল। তাই দেখে গাছে ডালে বাদরামি করা বাদরেরা কিচমিচ করে শোরগোল শুরু করে দিল। বানরের বন্ধু হরিণেরা এই কিচমিচের অর্থ জানে, ‘বাঘ হাজির,’ লম্বা লম্বা ঠ্যাংয়ে শব্দ তুলে দৌড়াতে শুরু করল আশেপাশের যত হরিণ। বাঘ নবাবি চালে ঢুকে পড়ল বনের ভেতর।
খাল ছাড়িয়ে দুই নৌকা আরো কিছুদূর এগিয়ে গেছে। সামনে খালের মুখ। তারপর আবার বড় খাল। খালের এক পাশে একটা জায়গা কেমন যেন দ্বীপের মতোই মনে হলো। যেন জলে ভেসে থাকা এক খণ্ড দ্বীপ। চারিদিকে খাল দ্বারা বেষ্টিত হয়ে আছে।
দ্বীপ দেখেই তান্ত্রিকের আসল কথা মনে পড়ে গেল। যে কারণে এই গহন বনে আসা। সে ডিটেকটিভের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘ভাই, ম্যাপটা দেখেন তো? ম্যাপে এরকম বড় বড় গাছওয়ালা একটা দ্বীপ ছিল না। পাশাপাশি দুটো দ্বীপের ছোটটা।’
দ্বীপ দেখে ডিটেকটিভেরও ও চিন্তা মাথায় এসেছে। সে ম্যাপ নিয়ে বসে পড়ল। হ্যাঁ, এই তো! স্পষ্ট এই দ্বীপটার ছবি। তার পাশেই নাড়াখাড়া ছোট্ট রতœদ্বীপ। সে কম্পাসসহ যাবতীয় সরঞ্জাম বের করল। সব হিসাব নিকাশ সবকিছুই বলছে এই বড় দ্বীপটার পাশাপাশি ছোট দ্বীপ থাকার কথা। মামাভাগ্নে দ্বীপ। কিন্তু ভাগ্নে দ্বীপের কোনো হদিশ দেখা যাচ্ছে না। সেখানে শুধু পানি আর পানি।
শেষমেশ তারা মাঝির শরণাপন্ন হলো। ‘মাঝি ভাই, এই দ্বীপটারে কি চিনতে পারতিছেন?’
‘চিনতি পারব না ক্যান। হ্যানের সব মাঝিব্যাটাই চেনে।’
‘কি দ্বীপ ওইটা?’
মাঝি হেসে বলল, ‘আগে আমরা সবাই মামাভাগ্নি দ্বীপ কয়ি ডাকতাম। ভাগ্নি ডুবি গিছে। শুধু মামা টিকি আছে। ক্যান সাব?’
‘আপনি শিওর এইটা মামাভাগ্নি দ্বীপ?’
‘জে সাব। বাদাবন যেরম সত্যি সেরম মামাভাগ্নি দ্বীপ সত্যি সাব। কিন্তুক এখন তো ভাগ্নি নেই। তলায় গেছে।’
ডিটেকটিভ গম্ভীর মুখে বলল, ‘হু। সে তো দেখতেই পাচ্ছি।’
তান্ত্রিক হতাশ গলায় বলল, ‘এখন কী হবে?’
‘কী আর হবে? ঢাকায় ফিরে যাব। লাভের হবে লাভ হলো রত্ন খুঁজতে এসে অন্য রত্নভাণ্ডার দেখা হয়ে গেল।’
‘সেটা কী?’
‘এতক্ষণ দুচোখ ভরে দেখেও বুঝতে পারেননি, কি রতœ আমরা দেখে ফিরছি। তবে ফিরে যাওয়ার আগে আমরা একটা কাজ করে যাব।
‘কী কাজ?’
‘এই মামা দ্বীপেই নামব। একটা জায়গা খুঁড়ে রেখে দেব। এমন ভাবে খুঁড়ব যাতে ওই তিনভাই এসে মনে করে আমরাই রত্ন তুলে নিয়ে গেছি।’
‘তাতে আমাদের লাভ?’
‘আমাদের লাভ নেই। কিন্তু ওদেরও শান্তিতে থাকতে দেব না। রত্ন তুলে নিয়ে গেছি এই আফসোসে সারাজীবন জ্বলে পুড়ে মরবে।’
তান্ত্রিকও কি বুঝল কে জানে, ডিটেকটিভের সাথে শাবল কোদাল নিয়ে নেমে পড়ল মামাদ্বীপে। খুঁড়তে শুরু করল দ্বীপের বালি মাটি…

শেয়ার Facebook

আরও যেসব নিউজ পড়তে পারেন

অদম্য কলাগাছ :: গাজী তানভীর আহমদ

July 5, 2025

ফুলে কাঁটা :: বিশ্বজিৎ দাস

July 5, 2025

হৈমন্তী : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

July 3, 2025

সাম্প্রতিক খবর

  • বাংলা সাহিত্যে ডান-বামের অস্তিত্ব ও সংকট :: জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

    July 5, 2025
  • অদম্য কলাগাছ :: গাজী তানভীর আহমদ

    July 5, 2025
  • রত্নদ্বীপের খোঁজে :: প্রিন্স আশরাফ

    July 5, 2025
  • জগলুল হায়দার এর ছড়া :: দেশপ্রেমী সব লাল ছিলো

    July 5, 2025
  • ফুলে কাঁটা :: বিশ্বজিৎ দাস

    July 5, 2025

BDOUTLOOK.COM

নির্বাহী সম্পাদক : কাদের বাবু

  • হোম
  • দেশ
  • বিশ্ব
  • রাজনীতি
  • অর্থবাণিজ্য
  • খেলা
  • বিনোদন
  • মতামত
  • শিল্পসাহিত্য
    • কবিতা
    • গল্প
    • প্রবন্ধ-আলোচনা
    • সাহিত্যের খবর

bdoutlooknews@gmail.com

  • Privacy Policy
BDOUTLOOK
  • হোম
  • দেশ
  • বিশ্ব
  • রাজনীতি
  • অর্থবাণিজ্য
  • খেলা
  • বিনোদন
  • মতামত
  • শিল্পসাহিত্য
    • কবিতা
    • গল্প
    • প্রবন্ধ-আলোচনা
    • সাহিত্যের খবর