বাসায় ঢুকেই হাঁক দিলাম, ‘মা, রাতে কিন্তু মোরগ পোলাও খাব।’
‘কেন। আজ কি তোর জন্মদিন?’ মা টিভির চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বলল।
‘বারে! তুমি ভুলে গেছ! আজ আমার পরীক্ষা শেষ হলো। সকালেই তো বলে গেলাম।’
‘তা তো বলেছিস। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হলে যে রাতে মোরগ পোলাও খাবি, তা তো বলিসনি।’
‘এখন বললাম। শুনলে তো। কাজেই রেডি হয়ে নাও।’
‘কীসের জন্য রেডি হবো?’ মা প্লেটে ভাত দিতে দিতে বলল।
‘রাতে আমরা বাইরে খাব। মোরগ পোলাও খাব। বাইরের কোনো রেস্টুরেন্টে।’
‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু ঋষি ফোন করেছিল। তোরা নাকি কোথায় যাওয়ার প্ল্যান করেছিস?’
দুপুরের খাওয়া মাথায় উঠল। ঋষিদা মানে রহস্য রোমাঞ্চের হাতছানি। নিশ্চয়ই নতুন কোনো কেস হাতে পেয়েছে। ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠেই নিজের রুমে দৌড়ে গেলাম। মায়ের সামনে এসব বিষয়ে গল্প করা ঠিক হবে না।
মোবাইল হাতে নিয়ে কল করতে যাব, অমনি দেখি কল এসেছে।
ঋষিদার ফোন।
‘তুমি নাকি ফোন করেছিলে?’
‘হ্যাঁ। তুই রেডি তো?’ ওপাশ থেকে জানতে চাইল ঋষিদা।
‘রেডি।’ থতমত খেয়ে গেলাম প্রশ্নটা শুনে।
‘বাহ! ভুলে গেছিস? তোকে বলেছিলাম, পরীক্ষা শেষ হলেই তোকে বেড়াতে নিয়ে যাব।’ ঋষিদা হেসে বলল।
সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম।
‘কোথায় যাচ্ছি আমরা? নতুন কোনো কেস পেয়েছ বুঝি?’ আগ্রহ ঝরে পড়ল আমার কণ্ঠ থেকে।
‘কেস না। আমরা বেড়াতেই যাচ্ছি।’
‘কোথায় ঋষিদা?’
‘রংপুর।’
‘হঠাৎ রংপুর?’
‘আরে সে অনেক কথা। পরে শুনিস।’
‘কীভাবে যাব আমরা?’
‘আমার পছন্দ ছিল ট্রেন। কিন্তু মি. চৌধুরী ছাড়লেন না। বললেন, আমার আয়োজনে যখন আপনি রংপুর যাবেন তখন প্লেনেই যান।’
মি. চৌধুরীকে প্রশ্ন করতে গিয়ে থেমে গেলাম। মায়ের মুচকি হাসির রহস্য বুঝতে পারলাম। আজই যে রংপুর যাচ্ছি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ঋষিদা নিশ্চয়ই মায়ের সাথে আগেই এ বিষয়ে কথা বলেছে।
‘তুই রেডি হয়ে নে। চারটের দিকে আমি তোকে তুলে নেব। সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমাদের বিমান।’
ঋষিদা ফোন রেখে দিল।
ঘর থেকে বের হয়ে মা’কে চিৎকার করে বললাম, ‘মা, রাতে মোরগ পোলাও রান্না করতে হবে না। আমি ঋষিদার সাথে রংপুর বেড়াতে যাচ্ছি।’
‘আবার কোনো কেস টেস সমাধান করতে যাচ্ছিস না কি তোরা?’ মা হেসে জানতে চাইল।
মায়ের ধারণা, ঋষিদা হলো ফেলুদা আর আমি নাকি তার সহকারী তোপসে।
‘কেস না। ঋষিদা বলল, এবার শুধুই বেড়াতে যাচ্ছি আমরা।’
কথাটা বলার পর আমার নিজেরই কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। বিখ্যাত গোয়েন্দা ঋষিদা কোনো কেস টেস ছাড়াই দেশের একপ্রান্তে ছুটে যাবে সেটাই যেন কেমন শোনাচ্ছে।
তখন কী আর জানতাম, ঋষিদা আর আমার কপালে কী অভিজ্ঞতাই না জুটতে যাচ্ছে!
দুই.
সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে রংপুর প্রায় বিশ কিলোমিটার।
‘সৈয়দপুর থেকে কীভাবে রংপুরে যাব?’ জানতে চাইলাম ঋষিদার কাছে।
‘চল না গিয়ে দেখি। বিমান কোম্পানির গাড়িই না কি রংপুরে নিয়ে যায়।’
সৈয়দপুরে নেমে দেখি মি. চৌধুরীর লোক গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার যখন পরীক্ষা চলছিল তখন ঋষিদা নাকি মি. আশফাক চৌধুরীর একটা কেস সলভ করে দিয়েছে। মি. চৌধুরী দেশের একজন বড় নামকরা ব্যবসায়ী। কনজুমার, ওষুধ, পোশাক শিল্প ছাড়াও বেশ কয়েকটা শিল্পে মি. চৌধুরীর ব্যবসায়িক ইনভেস্ট আছে। তিনি দেশের একজন সিআইপি। তাঁর কল্যাণেই আমাদের আজকের এই ভ্রমণ।
রংপুরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা বেজে গেল।
ড্রাইভার আমাদেরকে নিয়ে এলো জাহাজ কোম্পানির মোড়ে।
‘এটাই রংপুরের প্রাণকেন্দ্রÑ জাহাজ কোম্পানির মোড়।’ ঋষিদা বলল।
‘অদ্ভুত নাম! এখানে কি জাহাজ ভিড়ত?’
ঋষিদা হাসল।
‘লোকে তাই মনে করে বটে! কিন্তু রংপুরের ভৌগোলিক অবস্থান কিন্তু তা বলে না। রংপুর সমুদ্রের ধারে অবস্থিত কখনো ছিল না। কাজেই জাহাজ ভেড়ার প্রশ্নই আসে না।’
‘তাহলে এমন নাম কেন?’
‘যতদূর পড়েছি, এখানে জাহাজ কোম্পানি নামেই একটা দোকান ছিল। বেশ জনপ্রিয়।’
আরো কিছু জানতে চাওয়ার আগেই গাড়ি থেমে গেল।
‘আপনাদের হোটেল এসে গেছে স্যার।’ ড্রাইভার বলল।
তার কাছে আগেই জেনেছি, চৌধুরী সাহেব আমাদের জন্য রংপুর শহরের সেরা ফোর স্টার হোটেলে থাকার বন্দোবস্ত করে রেখেছেন।
হোটেলের লবিতে ঢুকতেই মন ভরে গেল। বেশ সাজানো গোছানো একটা লবি। একপাশে চমৎকার কয়েকটা সোফা রাখা আছে। অপেক্ষমাণদের জন্য নিখুঁত আয়োজন।
কাউন্টারের মেয়েটি আমাদেরকে দেখে মিষ্টি হাসি উপহার দিল।
‘ওয়েলকাম মি. ঋষি। রংপুরে স্বাগত। আশা করি, এবারের ভ্রমণটা আপনাদের জন্য দারুণ ইনজয়েবল হবে।’
বেয়ারা এসে আমাদের লাগেজ নিয়ে গেল।
‘এক্সকিউজ মি স্যার, আপনারা রাতে কী কী খাবেন আমাদের রেস্টুরেন্টে অর্ডার করে দিতে পারেন। জিরো-তে ফোন করলেই সরাসরি রেস্টুরেন্টের লাইন পেয়ে যাবেন স্যার।’
‘ধন্যবাদ।’
লিফটে চড়ে রুমে এলাম আমরা। ঢুকতেই মন ভরে গেল। মি. চৌধুরী আমাদের জন্য ভিআইপি রুমের ব্যবস্থাই করেছেন। পরিপাটি বিছানা দেখে মন চাইল এখনই শুয়ে পড়ি।
ফ্রন্ট সাইডে বিশাল কাচের দেয়াল। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই পুরো রংপুর শহরের রাতের দৃশ্য চোখের সামনে ফুটে উঠল।
‘চমৎকার!’ ঋষিদা পেছন থেকে বলল।
‘থ্যাংকু ঋষিদা। তুমি না থাকলে এই দৃশ্য কপালেও জুটত কি না সন্দেহ।’
‘সবাই নিজের নিজের কপাল নিয়ে জন্মায়। এই নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। এখন তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নে। বাইরে যাব।’
‘বাইরে। কোথায়?’
‘আরে, মাত্র তো নয়টা বাজে। এখন যদি হেঁটে হেঁটে রংপুর শহরটা ঘুরে আসি। কেমন হবে?’
‘দারুণ হবে।’ লাফিয়ে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলাম আমি।
তিন.
‘এই তাজহাট রাজবাড়ির বৈশিষ্ট্য কী কী?’
গেট পেরিয়ে গাড়ি ঢুকল। চৌধুরী সাহেব বেড়ানোর জন্য একটি কার দিয়ে রেখেছেন। ড্রাইভারকে বলা আছে, আমরা যেখানে যেখানে যেতে চাই নিয়ে যাবে।
‘চল আমরা আগে তোকে তাজহাট রাজবাড়িটাই দেখিয়ে আনি।’ নাশতা খাওয়ার পর ঢেঁকুর তুলে বলল ঋষিদা।
‘রাজবাড়ি?’
‘হ্যাঁ। এটা জমিদার বাড়ি।’
রংপুর শহর থেকে বেশি দূরে নয় রাজবাড়িটি। গাড়িতে যাওয়ার কারণে আমরা দ্রুতই সেখানে পৌঁছে গেলাম।
টিকেট কাটা হতেই জমিদারবাড়ির ঢোকার গেট খুলে দিল একজন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই মন ভরে গেল আমার।
কী চমৎকার রাজবাড়ি। অনেকগুলো সিঁড়ি। চারপাশে মনোমুগ্ধকর ফুলের বাগান।
‘এই জমিদার বাড়ির বৈশিষ্ট্য কী কী?’
ঋষিদা উইকপিডিয়া ঘেটে জানাল, ‘এই প্রাসাদটি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল রায় নির্মাণ করেন। সময় লেগেছিল প্রায় দশ বছর। মহারাজা গোপাল রায় ছিলেন হিন্দু। পেশায় ছিলেন স্বর্ণকার। কথিত আছে তাঁর মনোমুগ্ধকর তাজ বা মুকুটের কারণেই এ এলাকা তাজহাট নামে পরিচিত হয়।’
‘তুমি কি আগে এখানে এসেছ ঋষিদা?’
‘হ্যাঁ। ছাত্রজীবনে কারমাইকেল কলেজে বেড়াতে এসেছিলাম। তখন একবার ঘুরে গিয়েছিলাম।’
গাড়ি থেকে নেমে মার্বেলের সিঁড়িতে পা রাখলাম। অনেকগুলো সিঁড়ি পার হয়ে জাদুঘরে পৌঁছালাম। আমি আর ঋষিদা ঘুরে ঘুরে দেখলাম দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পকর্ম। বেশকিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি দেখলাম।
‘ওগুলো সংস্কৃত আর আরবি ভাষায় লেখা।’ ঋষিদা বলল।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলের কুরআন শরিফ, মহাভারত, রামায়ণ দেখলাম। বেশ কয়েকটা হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও দেখতে পেলাম।
বারান্দায় আসতেই নিচে চোখ পড়ল। বুঝতে পারলাম, দোতলায় রয়েছি।
‘ঋষিদা, এই রাজবাড়িটি কত উঁচু?
‘এই প্রাসাদটি প্রায় ২১০ ফুটের মতো প্রশস্ত এবং চার তলার সমান উঁচু।’
আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ। দোতলা থেকে নিচতলায় নেমে এলাম। জমিদার বাড়ির পেছনে চলে এলাম। গাছগাছালিতে ভর্তি জায়গাটি। বেশ নিরিবিলি। পেছনে তাকালাম। ছ্যাঁৎ করে উঠল ভেতরটা।
ঋষিদা নেই!
‘ঋষিদা! কই তুমি?’ প্রায় চিৎকার করে উঠলাম আমি।
‘এই যে রে আমি।’
আমার পেছন দিক দিয়ে উদয় হলো ঋষিদা।
‘ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। তুইও সেরে নে। এখান থেকে আমরা কারমাইকেল কলেজে যাব।’
মাথা ঝাঁকালাম। ওয়াশরুমের দিকে এগোতে যাব এমন সময় কে যেন জানতে চাইল, ‘আপনিই প্রখ্যাত গোয়েন্দা ঋষিদা?’
চমকে গেলাম।
ঢাকা শহর থেকে এতদূরে এমন নির্জন জমিদার বাড়িতে ঋষিদাকে কেউ চিনতে পারবে ভাবতেই পারিনি।
চার.
‘আপনাকে চিনলাম না?’ ঋষিদা সামলে নিল দ্রুত।
‘ওহ্! আমি অনিমেষ। অনিমেষ সাহা। এই রংপুরেই বাসা। ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে এসেছি।’
দূরে একজন নারীকে দেখিয়ে দিল তরুণ। বয়স তার বেশি নয়। পঁচিশ ছাব্বিশ হবে।
‘কী করেন আপনি?’
‘ব্যবসা করি। মুদিখানা আছে।’
‘আমাকে চিনলেন কীভাবে?’
‘ছোটবেলা থেকেই ফেলুদা, মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দা পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। গোয়েন্দাদের সম্পর্কে কৌতূহল ছিলই। ফেসবুকে আপনার সম্পর্কে পড়েছি।’
মাথা ঝাঁকাল ঋষিদা। আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘এই হলো পল্টু। আমার কাজিন।’
‘আচ্ছা, ও তাহলে আপনার তোপসে। একটা জটায়ু থাকলে বেশ হতো।’ হেসে বলল অনিমেষ।
আমরাও হাসলাম।
‘স্যার কি রংপুরে কোনো কেসের সমাধান করতে এসেছেন? এমনিই জানতে চাইলাম।’
‘না। আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি।’
‘ঠিক আছে স্যার। আবার হয়তো কখনো দেখা হবে।’ বিদায় নিল অনিমেষ।
আমরাও ফিরে চললাম।
‘পথে ঘাটে ক্ষণিকের এই পরিচয় হওয়াটা মন্দ নয়, কী বলিস?’
‘হুম।’ বললাম।
তখন কী আর জানতাম, শিগগিরই অনিমেষের সাথে আবার দেখা হবে।
পাঁচ.
হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। কারমাইকেল কলেজ, পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান দেখে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। সেখান থেকে সোজা চলে গেলাম পুলিশ সুপার মি. সোহেল আরমানের বাসভবনে। ভদ্রলোক ঋষিদার বন্ধু।
চাকরির জন্য দু’জনের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ কম হলেও যোগাযোগটা কমেনি। তার উষ্ণ আতিথেয়তা এটাই মনে করিয়ে দিল যে, বন্ধুত্ব চিরকালের জন্য অটুট থাকে।
হোটেলের লবিতে চাবি নিতেই রিসেপশনিস্ট বলল, ‘একজন ভদ্রলোক আপনার জন্য ওয়েট করে আছেন মি. ঋষি।’
ঋষিদা আমার দিকে চাইল। তার চোখে বিস্ময়।
লবিতে গিয়ে দেখি সেই একজন আর কেউ না, অনিমেষ। আজ সকালেই যার সাথে দেখা হয়েছিল।
‘কী ব্যাপার? অনিমেষ বাবু একেবারে হোটেলে এসে হাজির। জানলেন কীভাবে যে এই হোটেলে আমরা আছি।’
মাথা চুলকাল অনিমেষ। হাসল।
‘এ আর এমন কী। আপনারা যে গাড়িতে করে তাজহাট রাজবাড়ি গিয়েছিলেন সেটার গায়েই হোটেলের স্টিকার সাঁটানো ছিল।’
‘বাহ! তা আমার কাছে কেন এসেছেন?’ ঋষিদা জানতে চাইল।
ইতস্তত করল যুবক।
‘আমি না হয় রুমে যাই।’ অস্বস্তি কাটাতে প্রস্তাব দিলাম আমি।
‘না না। আসলে একটু নিরিবিলিতে বসে বলতে চাইছিলাম। যদি আপনি সময় দেন।’
‘ঠিক আছে। আসুন।’
অনিমেষকে নিয়ে হোটেলের ক্যাফেতে বসলাম আমরা। ক্যাফেতে মানুষজন নেই।
‘কী খাবেন বলুন? চা না কফি?’
‘এত রাতে কফি খাব না। চা বলতে পারেন।’
ঋষিদা অর্ডার দিয়ে দিল।
‘এখন বলুন কোন বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছেন?’
‘ঠিক বিপদ না। একটা জিজ্ঞাসা থেকে আপনার কাছে ছুটে আসা।’
‘জিজ্ঞাসা?’
‘জি। সংক্ষেপে ঘটনাটি বলি। আমাদের গ্রামের বাসা পাশের সুন্দরপুর উপজেলায়। আমার বাবা সেখানকার পৌরসভায় মেম্বার ছিলেন। এক মেয়াদ শেষ করে পরবর্তী মেয়াদে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেজন্য তিনি তার তিন বন্ধু জব্বার, আসলাম আর সোবহান চাচার সাথে মিটিংয়ে বসেন। সারারাত ধরে মিটিং চলে। পাশাপাশি তারা মদ্যপানও করেন।
সকালবেলা আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিন বন্ধু মিলে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায় তাকে। ডাক্তার বাবাকে মৃত ঘোষণা করেন। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে রিপোর্ট দেন।
এরপরই মা আমাকে নিয়ে রংপুরে চলে আসেন। এখানেই আমি পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে ব্যবসা করছি।’ অনিমেষ থামল।
‘আপনার বাবা কি নিয়মিতই মদ্যপান করতেন?’
মাথা ঝাঁকাল অনিমেষ।
‘তখন তো আমি ছোট ছিলাম। সবটা জানি না। তবে খেতেন। বন্ধুবান্ধবদের সাথে মাঝে মাঝে মদ্যপান করতেন।’
‘অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে দেশে অনেক মানুষই প্রতিবছর মারা যায়।’ ঋষিদা মন্তব্য করল।
‘তা জানি। এ বিষয়ে আমার মনেও প্রশ্ন নেই। বাবা মারা যাওয়ায় মা আমাকে নিয়ে রংপুরে চলে আসেন। অনেকটা নীরবে। আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে আর যোগাযোগ রাখেননি। বাবার রেখে যাওয়া টাকা দিয়েই মা এখানে মুদিখানা খোলেন। পাশাপাশি আমাকেও পড়াশোনা করান। সবসময় চোখে চোখে রাখতেন। গত বছর মা মারা যান। মৃত্যুশয্যায় মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেন আমরা বাবার বাসা ছেড়ে রংপুরে চলে এলাম। উত্তরে মা চুপচাপ ছিলেন অনেকক্ষণ। তারপর বললেন, ‘তুই ওখানে থাকলে তোকেও তোর বাবার মতন মেরে ফেলত।’
চমকে গিয়েছিলাম। বাবাকে হত্যা করা হয়েছিলÑ এটা আমার চিন্তাতেই ছিল না। কে হত্যা করেছে, জানতে চেয়েছিলাম। মা আর উত্তর দেননি। কিছুক্ষণ পরেই তিনি আমাদের চিরতরে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।’
‘এখন আপনি কী করতে চান?’ ঋষিদা জানতে চাইল।
‘আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই। ভেবেছিলাম এ রহস্যের সমাধান হয়তো পাব না। আজ আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর মনে হলো বিষয়টি আপনার সাথে শেয়ার করি।’
‘বিশ বছর আগের রহস্য।’ ঋষিদা মন্তব্য করল।
‘কিন্তু ভদ্রলোক তো সত্যি সত্যি মদ্যপানের কারণেও মারা গিয়ে থাকতে পারেন।’ ধীরে ধীরে বললাম আমি।
‘পারেন। কিন্তু বিষয়টা আমার দিক দিয়ে ভেবে দেখুন। একজন সন্তান জানে না কেন কী কারণে তার জন্মদাতা পিতা মারা গেছেন।’ কান্নাজড়িত গলায় বলল অনিমেষ।
‘বুঝতে পারছি, আমি চেষ্টা করব। আমার জন্য যেটা জানা জরুরি আপনার বাবার ওই বন্ধুরা বেঁচে আছেন কি না। তারা এখন কী করেন? এলাকায় থাকেন কি না?’
‘আছেন। তারা বেঁচে আছেন। জব্বার চাচা বড় সিমেন্টের ব্যবসা করেন। আসলাম চাচা স্থানীয় নেতা। আর সোবহান চাচার বাস আছে।’
‘আপনি কীভাবে জানলেন?’
‘মায়ের মৃত্যুর খবর আত্মীয়-স্বজনকে জানিয়েছিলাম। তারা আম্মার কুলখানিকে এসেছিলেন। তাদের মাধ্যমেই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খবর বের করেছি।’
‘আপনার বাবার ছবি দিতে পারবেন?’
‘পারব। বাসায় আছে। আপনি চাইলে এনে দিচ্ছি।’
‘এনে দিতে হবে না। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালেই হবে।’
‘কেসটা তাহলে আপনি নিচ্ছেন? আমি কিন্তু জানি না আপনার ফিস কত? অনেক টাকা ফিস দেওয়ার মতো সামর্থও নেই আমার।’
‘গোয়েন্দা ঋষিদা সব কেস টাকার জন্য সমাধান করে না।’ ঋষিদা’র হয়ে জবাব দিলাম।
ছয়.
খুব সকালেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
ড্রাইভারকে বলাই ছিল। তিনি সকাল সকালই চলে এসেছেন। রওনা হওয়ার আগে আমরা নাশতা খেয়ে নিলাম। নাশতার টেবিলে বসে ঋষিদাকে গম্ভীর দেখলাম। আমার মনে পড়ল রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঋষিদা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল। থানা পুলিশ ক্যামেরা শব্দগুলো কানে এসেছিল আমার।
কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলাম। সময় হলে ঋষিদা নিজেই জানাবে সব।
রাস্তায় অনিমেষকে উঠিয়ে নিলাম আমরা।
গাড়ি ছুটে চলল সুন্দরপুর।
কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে আমি জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে লাগলাম। চমৎকার হাইওয়ে। মনে হচ্ছে ইংরেজি মুভিতে দেখা হাইওয়ে ধরে যাচ্ছি। দু’পাশে গাছপালা থাকলে বেশ লাগত।
‘কতক্ষণ লাগতে পারে?’ ঋষিদা জানতে চাইল।
‘বাসে একঘণ্টা লাগে। গাড়িতে যখন যাচ্ছি তখন সময় আরো কম লাগবে।’
‘আমরা যাচ্ছি কোথায়? অনিমেষদার বাসায়?’ জানতে চাইলাম।
‘আমাদের বাসা তো আর নেই। দখল হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজনরা দখল করে নিয়েছে।’
‘জায়গার দলিল আপনাদের কাছে নেই?’
‘নেই। মা আসলে ভয়ে দ্রুত আমাকে নিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে ছিলেন। তেমন কোনো কিছুই নিয়ে যেতে পারেননি।’
‘এ নিয়ে আপনার মন কি দুঃখ আছে?’
‘বেঁচে আছি এই তো ঢের।’ বিষণ্ন গলায় বলল অনিমেষ।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল।
‘কোথায় যেতে হবে স্যার?’
‘সুন্দরপুর থানায়।’ অনিমেষ বাবু রাস্তা দেখিয়ে দিল।
থানায় পৌঁছাতে ওসি ছুটে এলেন।
‘গুড মর্নিং স্যার।’
‘গুড মর্নিং।’
‘আমি আহাদ চৌধুরী। এখানকার অফিসার ইনচার্জ।’
‘হ্যাঁ। সৈকত বলেছে।’
এসপি’র নাম শোনামাত্র তাৎক্ষণিক পরিবর্তন ঘটল ওসির চোখেমুখে।
‘আসুন স্যার, সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।’
কনস্টেবলকে গাড়ি বের করতে বললেন আহাদ। আমরাও গাড়িতে চললাম তার পিছু পিছু। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সুন্দরপুর রেস্ট হাউসে।
‘আসুন স্যার।’ রুম খুলে দিল কেয়ারটেকার।
পাশাপাশি দুটো রুম।
মাস্টার বেডরুমে আমাদের বসিয়ে ঋষিদা বলল, ‘আপাতত তোদের কোনো কাজ নেই। তোরা বসে বসে টিভি দেখ বা ফেসবুকে চ্যাটিং কর। আমি ওসি সাহেবের সাথে বের হচ্ছি। আমার ফিরতে দেরি হলে চিন্তা করিস না।’
মাথা ঝাঁকালাম। ঋষিদার কাজকর্ম এমনই। আগে থেকে কোনোকিছুই বলবে না।
আমি বসে বসে ফেসবুক দেখতে লাগলাম। অনিমেষ সোজা শুয়ে পড়ল।
‘বাবা মারা যাওয়ার পর কি এই প্রথম এখানে এলেন?’ জানতে চাইলাম।
‘হ্যাঁ। মা চাননি আমি এখানে আসি। আর আমি যে একা একা এখানে আসব, সেই সাহস আমার হয়ইনি।’
‘কেন! আপনি কি জানতেন যে জায়গাটা আপনার জন্য নিরাপদ না?’
শৈশবে আমাকে নিয়ে মা যখন রংপুরে চলে যান; তখন তার চোখেমুখে যে আতঙ্ক দেখেছি সেটা আমার মনে বেশ প্রভাব ফেলেছিল।’
সময় যেন আর কাটতে চাইছে না। একটু পরেই একজন কর্মচারী আমাদেরকে ডেকে নিয়ে গেল। ডাইনিংয়ে আমাদের জন্য নাশতার আয়োজন করা হয়েছে। কয়েক রকম ফল, মিষ্টি, সন্দেশ, বিস্কুট আর চানাচুর। সাথে পেলাম ধুমায়িত কফি। ঋষিদা কফি খেতে পছন্দ করে।
কল দিতে চেয়েও হাতটা সরিয়ে নিলাম। ফ্রি হলে ঋষিদা নিজেই ফোন করবে।
ফেসবুক দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। ঘুম যখন ভাঙল তখন ঘড়ির কাঁটা আড়াইটার ঘর পেরিয়ে গেছে।
অনিমেষ বসে বসে টিভি দেখছে।
‘কতক্ষণ আর ঘুমিয়ে থাকবে? উঠো, দুজনে মিলে খেয়ে নিই।’
‘ঋষিদা ফেরেনি?’
‘না। কর্মচারীরা আমাদের ডেকে বলল।’
হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। ডাল, ভাত, মাছ, মাংসসহ কয়েক রকম পদের সমাহার। খেতে বসে মন কিছুটা খারাপই হলো।
যার কল্যাণে খেতে বসেছি, সেইই খেতে পারছে না।
বিকেলের দিকে ঋষিদার ফোন এল, ‘খেয়েছিস তোরা?’
‘হ্যাঁ। তুমি খেয়েছ?’
‘খেয়েছি সামান্য।’
‘কখন আসবে?’
‘আসা তো এখন হবে না। তোদেরকেই এখানে আনিয়ে নেব। তৈরি থাকিস।’ লাইন কেটে দিল ঋষিদা।
অপেক্ষার পালা বাড়ল আমাদের।
সাত.
অপেক্ষার পালা শেষ হতে চলেছে আমাদের। নিজেকে মনে হচ্ছে শিকারি, যে কিনা ফাঁদ পেতে শিকার ধরার জন্য অপেক্ষা করে।
ঋষিদা লোক পাঠিয়েছিল। সেই লোক আমাদেরকে নদীর ধারে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রেখে গেছে। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব, তার আগেই লোকটি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় আমাদের চুপ করে থাকতে বলল।
অনিমেষ আমার ঘাড়ে হাত রাখল। সামনে দেখাল।
সামনে তাকাতেই চমকে গেলাম। নদীর ধারে একটা টংঘর। সেখানে চাদর মুড়ি দিয়ে একজন লোক বসে আছে।
‘বাবা।’
এগিয়ে যেতে চাইল অনিমেষ। হাত টেনে ধরল পুলিশের লোক।
চমকে গেলাম। অনিমেষের বাবা বিশ বছর আগেই মারা গেছে।
তাহলে!
রহস্যের জট কাটতে সময় লাগবে, বুঝতে পারলাম। ঋষিদাই বা কোথায়। আশেপাশে তাকালাম। আবছা অন্ধকারে আশেপাশে কেউ আছে কি না বোঝাই মুশকিল। বুঝতে পারছি, অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই।
সময় বয়ে যাচ্ছে।
আকাশে চাঁদ উঠেছে।
গাছের জন্য আমরা অপেক্ষাকৃত অন্ধকার অঞ্চলে আছি।
চারদিক নিস্তব্ধ।
সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে নুড়িপাথর পড়ার শব্দ হলো। চমকে গিয়ে তাকাতেই বুঝতে পারলাম নদীর পাড়ে নামার রাস্তার ধারে কারা যেন নেমে আসছে।
অনিমেষ ফিসফিস করে বলল, ‘আহাদ কাকারা।’
বুঝতে পারলাম, অনিমেষের বাবার বন্ধুরা চলে এসেছে।
অনিমেষের বাবার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল তিন বন্ধু।
দূর থেকে দেখছি বলে কী কথা হচ্ছে তা জানার উপায় নেই। তবু কান খাড়া করলাম।
মনের মধ্যে খচখচ করছে, ঋষিদা কোথায়? তিনজনে উঁচু স্বরে কী যেন বলল অনিমেষের বাবাকে।
জবাবে ওর বাবাকে দেখলাম সামান্য ঘুরে বসল। বন্ধুদের কারো দিকে তাকাল না।
বুঝতে পারলাম অনিমেষের বাবা কিছু বলছে।
একটুপরই বিদ্যুৎ খেলে গেল বাকি তিনজনের শরীরে।
ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা অনিমেষের বাবার ওপর। তাকে শুইয়ে মুহূর্তের মধ্যে একজন অনিমেষের বাবার বুকের উপর চড়ে বসল। অন্য দুজনের হাত দুটো দুদিক দিয়ে চেপে ধরল। আমার পেছনে ঝোপ নড়ে উঠল। চমকে উঠে পেছনে চাইতেই দেখি তিনজন দৌড় দিল নদীর পাড়ে। বুঝতে পারলাম সাদা পোশাকের পুলিশ। অনিমেষের বাবাকে বাঁচাতে যাচ্ছে।
সংবিৎ ফিরে পেতে আমি আর অনিমেষ একসাথে দৌড় দিলাম। তবে তার আগেই ভোজবাজির মতন ব্যাপার ঘটল। মুহূর্তের মধ্যে অনিমেষের বাবার পায়ের আঘাতে উড়ে গেল বুকের উপর বসে থাকা লোকটি। এরপরই দু’পাশে বসা লোক দু’জনকে টেনে মাথা দুটো ঠুকে দিলেন তিনি।
‘আউ।’ চিৎকার করে উঠল দুজন। মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল। পুলিশের লোক পৌঁছে তাদের হাতে হাত কড়া পরিয়ে দিল।
বুকের উপর বসে থাকা লোকটি দূরে ছিটকে পড়েছিল। পুলিশকে দেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল।
‘অপরাধ করে অপরাধী যতই লুকানোর চেষ্টা করুক না কেন, ধরা তাকে একদিন না একদিন পড়তেই হবে। গায়ের চাদর ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন অনিমেষের বাবা।
গলাটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগল না।
আমি আর অনিমেষ অবাক হয়ে দেখলাম, অনিমেষের ‘মৃত’ বাবা আসলে আমাদের ঋষিদা।
আট.
সন্ধ্যায় রেস্ট হাউজে আড্ডা জমে উঠল।
আমাদের সাথে যোগ দিলেন রংপুরের পুলিশ সুপার।
‘গল্প শোনার লোভে চলে এলাম। বিশ বছর আগের লুকিয়ে থাকা রহস্য তুমি সলভ করেছ। এ কি কম কথা!’
‘বন্ধু প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে না। যতই লুকিয়ে রাখ, একদিন না একদিন উন্মোচিত হবেই।’
‘তবু কৌতূহলী মন জানাতে চাইছে কেমন করে তুমি বুঝতে পারলে এটি হত্যাকা ছিল?’
‘অনিমেষের মায়ের কথা শুনে। কোনো নারী কি এমনি এমনি স্বামীর বাসা ছেড়ে দূরে পালিয়ে যাবে? গেলে তো নিজের বাবা-মায়ের কাছে যাওয়াই সহজ ছিল।’
‘আপনি তাদেরকে এক জায়গায় করলেন কীভাবে?’ অনিমেষ জানতে চাইল।
‘সব কৃতিত্ব ওসি সাহেবের।’ প্রশংসা শুনে চওড়া হাসি বের হলো তার মুখ থেকে।
‘পুলিশ সুপার বন্ধু আর ওসি সাহেবের সাহায্য ছাড়া তাদের একসাথে করা সম্ভব হতো না। আজ সারাদিন আমি এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। ওদের তিনজনকেই অনিমেষের বাবা সেজে লোক মারফত চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলাম। সাদা পোশাকের পুলিশরা চিঠি পৌঁছে দেওয়ার কাজে সাহায্য করেছে। চিঠিতে আমি লিখেছিলাম, ‘বিশ বছর আগে যে অন্যায় তোমরা করেছ আজ তার জবাব তোমাদের দিতে হবে। আজ রাত ৮টায় আমি তোমাদের জন্য শ্মশানঘাটে অপেক্ষা করব।’
চিঠি পৌঁছে দেওয়ার পর আমরা তাদের ফোনে আড়ি পাতি। তিনজন মিলেই যে আলোচনা করে তাতে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, খুনের সাথে তারাই জড়িত। মূলত কমিশনার পদে আবুল দাঁড়াতে চেয়েছিল। তিনজনে চেয়েছিল, সেই ভোটে অনিমেষের বাবা যেন না দাঁড়ায়। সেই কথা না শোনাতে ওরা তিনজনে মিলে তাার বাবাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
সে কাজে তারা সফলও হয়। সবাই জেনেছে, তিনি মদ্যপানে মারা গিয়েছিল। আসলে মদের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনিমেষের বাবা ঘুমিয়ে পড়ার পর শ্বাসরোধ করে তাকে মেরে ফেলে তারা।’
‘ডাক্তার যে সার্টিফিকেট দিয়েছিল?’
‘আসলে এক্ষেত্রে ডাক্তারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। পুলিশও যদি সেই লাশের বিষয়ে কমপ্লেইন না করে আর আত্মীয়স্বজনও যদি পোস্টমার্টেম না করাতে চায় তবে ডাক্তারেরও কিছু করার থাকে না।’
‘আমার ধারণা, ওই তিন খুনি অনিমেষের মাকে বিনা পোস্টমর্টেমে লাশ নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিল।’
‘রাইট। তখনই মিসেস এর সন্দেহ হয় যে তার স্বামীকে খুন করা হয়েছে। কেউ হয়তো তাকেসহ সন্তানকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিল। তাই তিনি রংপুরে পালিয়ে যান।’
‘বিশ বছর যাক। খুনিরা ধরা তো পড়ল।’ বললাম আমি।
‘ধরা পড়ল তবে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ যোগাড় করা পুলিশের কাজ।’ ধীরে ধীরে বলল ঋষিদা।
‘সেই চেষ্টা আমরা করব। ইতোমধ্যে তিন খুনির মধ্যে একজন স্বীকারোক্তি দিয়েছে।’
‘ওরা আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। বন্ধুত্বের সম্পর্ক ফুলের মতোই নিষ্পাপ। সেই নিষ্পাপ সম্পর্কেও কত না কাঁটা লুকিয়ে থাকে তা আজ জানলাম।’ ধীরে ধীরে বলল অনিমেষ।