আহা বাতাস
বাতাস, আহা বাতাস। আমাদের চারদিকে কত বাতাস। ঠাণ্ডা, গরম। কাব্যের ভাষায় আবার কখনো মৃদুমন্দ। হাওয়া, সমীরণ, পবন, বায়ু যে নামেই আমরা ডাকি না কেন বাতাস বাতাসই। বাতাস আমরা চোখে দেখি না। কিন্তু অনুভব করি। বাতাসের কোনো স্বাদ নেই, গন্ধ নেই। তবে নানা কারণে বাতাস যখন দূষিত হয়ে পড়ে তখন বাতাসে গন্ধ ছড়ায়। বাতাস ছড়িয়ে থাকে সবখানে। আমাদের সারাক্ষণ জড়িয়ে রাখে। ঘিরে রাখে। আমাদের মাথার ওপরেই তো আছে পাঁচটি হাতির ওজনের সমান অর্থাৎ ৩৪০ মণ বা ৩০ হাজার পাউন্ড ভার। এই চাপে তো আমাদের পিষে যাবার কথা। অথচ আমরা চাপ টের পাই না। কারণ আমাদের শরীরের ভেতর থেকে এক ধরনের চাপ বাইরের দিকে আসে। বাইরের বাতাসের সঙ্গে সে চাপ সমান থাকে বলে আমরা দুটি চাপের কোনোটাই টের পাই না। আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। হাঁটাহাঁটি, দৌড়াদৌড়ি করি।
ডুবে যাই বাতাসের মহাসমুদ্রে
আমাদের মাথার উপরের দিকে কত জায়গা। বিশাল এই জায়গাকে আমরা বলি আকাশ। এর নিচের অংশে বায়ুমণ্ডল। তার উপরে মহাকাশ। যে আকাশে পাখি ওড়ে, মেঘ জমে, সে আকাশকে আমরা বলি বায়ুমণ্ডল। যে আকাশে চন্দ্র-সূর্য-তারা দেখতে পাই সে আকাশকে বলি মহাকাশ। সেটি পৃথিবীর বাইরে। পৃথিবীর সব স্থল আর পানি ঘিরে বাতাসের এক মহাসাগর আছে। এর একেবারে নিচে আমরা বসবাস করি। বাতাসের সেই মহাসাগর পানির মহাসাগরের গভীরতম জায়গার চাইতেও ৩০-৪০ গুণ বেশি গভীর। এর নাম বায়ুমণ্ডল। এটি পৃথিবীরই অংশ। শিলামণ্ডল, বারিমণ্ডল আর বায়ুমণ্ডল নিয়েই পৃথিবী। পৃথিবীর জীবজগৎকে ক্ষতিকর বিকিরণ এবং মহাজাগতিক ধ্বংসাবশেষ থেকে রক্ষা করে এই বায়ুমণ্ডল।
কী আছে বাতাসে
সৃষ্টির প্রথম যুগে পৃথিবী যখন ঠাণ্ডা হয়ে জমাট বাঁধে, তখন তা থেকে বেরিয়েছিল অনেক রকম গ্যাস। গ্যাস হালকা বলে উপরের দিকে উঠে গেল বটে, কিন্তু পৃথিবীর টানে পৃথিবীর একেবারে বাইরে চলে যেতে পারল না। এই গ্যাসগুলোকে একসঙ্গে বলে বায়ু বা বাতাস। নানাবিধ গ্যাসের মিশ্রণে বাতাস গঠিত হয়েছে। এসব গ্যাসের মধ্যে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বায়ুর প্রধান উপাদানগুলো হলো— নাইট্রোজেন ৭৮.০৯%, অক্সিজেন ২০.৯৫%, আর্গন ০.৯৩% এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড ০.০৩%। এছাড়া বাতাসে রয়েছে সামান্য পরিমাণে নিয়ন, হিলিয়াম, মিথেন, ক্রিপটন, হাইড্রোজেন, জেনন এবং ওজন। আছে জলীয়বাষ্প ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড। সুতরাং বাতাস একটি মিশ্র পদার্থ। পদার্থের সব ধর্মই আছে বাতাসে। যেমন— বাতাস স্থান দখল করে। বল প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করে এবং বাতাসের ওজন আছে। প্রতি লিটার বাতাসের ওজন ১.৩ গ্রাম।
আমরা বেঁচে থাকি বাতাস ছুঁয়ে
বাতাসই পৃথিবীতে মানুষসহ যাবতীয় প্রাণীর বসবাসের উপযোগী করেছে। জীবজন্তু বাতাস থেকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং উদ্ভিদ কার্বন-ডাই-অক্সাইড টেনে নিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। বাতাসে অক্সিজেন আছে বলেই আগুন জ্বলে আর বাতাসে জলীয়বাষ্প আছে বলেই বৃষ্টি হয়। সুতরাং সকল প্রাণী বেঁচে থাকে বাতাসের শরীর ছুঁয়ে।
বাতাসের প্রকারভেদ
পৃথিবীতে অনবরত যে বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে তারও রয়েছে শ্রেণিভেদ। বাতাসকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায়। আয়ন বায়ু, প্রত্যয়ন বায়ু এবং মেরুদেশীয় বায়ু সারাবছর একই দিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে এদের বলা হয় নিয়ত বায়ু। দিন বা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে যে বায়ু প্রবাহিত হয় তাকে বলে সাময়িক বায়ু। স্থল বায়ু, সমুদ্র বায়ু ও মৌসুমী বায়ুকে একসঙ্গে সাময়িক বায়ু বলে। ঘূর্ণবাত, প্রতীপ ঘূর্ণবাত এবং টর্নেডো প্রভৃতি বায়ুকে বলে আকস্মিক বায়ু। এছাড়া সিরক্কো, খামসিন এবং কালবৈশাখীকে বলা হয় স্থানীয় বায়ু।
বায়ুমণ্ডলের নানা স্তর
বিজ্ঞানীরা বায়ুমণ্ডলকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। সবচেয়ে নিচের স্তরটির নাম ট্রপোস্ফিয়ার বা ঘনমণ্ডল। এই স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। মেঘ, বৃষ্টি সবই হয় এই স্তরে। এজন্য এই স্তরকে আবহাওয়া স্তরও বলা হয়। আমাদের বসবাস এই স্তরে। এর উপরের স্তরের নাম ট্রপোপজ। ট্রপোপজের উপরের স্তরের নাম স্ট্রাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডল। এই স্তরে মেঘ নেই, ঝড়-বৃষ্টিও নেই। যে কারণে এ স্তরে বিমান চলাচল করে। এ দুটি স্তরের বিস্তৃতি ৬৬ কিলোমিটারের মধ্যে। স্ট্রাটোস্ফিয়ারের উপরের স্তরের নাম ওজোনোস্ফিয়ার বা ওজনমণ্ডল। সূর্যের তাপ এবং অতি বেগুনি রশ্মি শোষণ করে এ স্তর। স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ঠিক উপর থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত এই স্তরের অবস্থান। এর অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে পৃথিবীর জীবজগৎকে রক্ষা করে। ওজোনোস্ফিয়ার পরের স্তরের নাম আয়রোস্ফিয়ার বা আয়োনমণ্ডল। এই স্তর প্রায় ৩৯৬ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরের বিশেষত্ব হচ্ছে, এ স্তরে বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত হতে পারে। হয় উল্কাপাত। বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে উপরের স্তরের নাম একসোস্ফিয়ার বা বহির্মণ্ডল। এর পরেই মহাশূন্যের শুরু। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উপর থেকে ৭৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এ স্তর। এ স্তরের বায়ু একেবারেই হালকা।
বায়ুমণ্ডলের তাপ
ভূপৃষ্ঠ ছেড়ে উপরে উঠলে গরম মোটেই বাড়ে না, বরং কমতে থাকে। এই উত্তাপ সাধারণভাবে ৩০০ ফুট উচ্চতায় এক ডিগ্রি ফারেনহাইট হারে কমে। সূর্যের তাপ যেহেতু বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়েই আসে, সেহেতু বাতাস গরম হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় না। প্রকৃতির এ এক আশ্চর্য নিয়ম। তবু আমরা যে গরম হাওয়া পাই, সেটি গরম হয় পৃথিবীর মাটি, পানির তাপ লেগে। তাই উপরের বাতাস ঠাণ্ডা। কেননা ভূপৃষ্ঠ থেকে স্থান যতই উঁচু হবে, গরম হাওয়া সেখানে ততই কম পৌঁছাবে। মজার ব্যাপার হলো— পৃথিবী থেকে ৯৬ কিলোমিটার উঁচুতে যে আয়নমণ্ডল রয়েছে সে স্থানের বাতাস কিন্তু ভীষণ গরম। এই স্তরের গড় তাপমাত্রা ১১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আয়নমণ্ডলের শেষ সীমায় অর্থাৎ প্রায় ৪০০-৭০০ কিলোমিটার উঁচুতে বাতাস ২২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড গরম। ১৫০৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় লোহা গলে যায়— তাহলে বুঝতে হবে আয়নমণ্ডল কতটা গরম।
হাওয়ার গাড়ি
পৃথিবীর একদিক থেকে অন্যদিকে বাতাস বয়ে যাওয়ার ফলে যে প্রবাহের সৃষ্টি হয় শুধু সে প্রবাহকে বলে বাতাস। তাপ ও চাপের পার্থক্যের ফলে বাতাস এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়। একে বলা হয় বায়ুপ্রবাহ। বাতাস যখন ওপরে ওঠে তখন তাকে বলে উৎক্ষেপ। আর যখন নিচের দিকে প্রবাহিত হয় তখন তাকে বলে অধঃক্ষেপ। এই হাওয়া বা বাতাস সবসময় নদীর পানির মতো বয়ে চলেছে। বাতাস অনবরত চলছে দুটি কারণে। এক. পৃথিবী ঘুরছে। পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার খোলসটিও ঘণ্টায় এক হাজার মাইলের বেশি দ্রুত বেগে ঘুরছে। আমরাও ঠিক ততটাই দ্রুত বেগে ঘুরছি। যে কারণে বাতাসের এই গতি আমরা টের পাই না। দুই. বাতাস যখন গরম হয় তখন হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। পাশ থেকে তখন শীতল হাওয়া সেই শূন্যস্থান পূরণ করে। এভাবেই হাওয়া অনবরত চলতে থাকে, এটি বাতাসের স্বাভাবিক চলাচল।
তবে কোনো জায়গায় বাতাসের চাপ হঠাৎ কমে গেলে শুরু হয় ঝড়। বৈশাখ মাসে গরমের সময় এমনটি হয় বেশি। বিজ্ঞানীরা বাতাসের গতিবেগ হিসাব করে ঝড়ের নানারকম নাম দিয়েছেন। যেমন— বাতাসের বেগ প্রতি ঘণ্টায় ৩২-৩৮ মাইল হলে বলে জোরালো হাওয়া। বাতাসের বেগ প্রতি ঘণ্টায় ৩৯-৬৩ মাইল হলে বলে বাত্যা। বাতাসের বেগ প্রতি ঘণ্টায় ৬৪-৭৫ মাইল হলে বলে ঝড়। আর বাতাসের বেগ প্রতি ঘণ্টায় ৭৫ মাইলের বেশি হলে সে বাতাসকে বলে ঝঞ্ঝা। বাতাসের এই চাপ মাপা যায় বিজ্ঞানী টরিচেলির উদ্ভাবিত ব্যারোমিটার যন্ত্রের সাহায্যে। ঝড় যে শুধু ডাঙায় হয় তা নয়। সমুদ্রেও ঝড় হয়। নিরক্ষরেখার কাছে চীন সমুদ্রে যে ঝড় ওঠে তাকে বলে টাইফুন। প্রধানত ভারত মহাসাগরে যে ঝড় ওঠে তাকে বলে সাইক্লোন। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যবর্তী ক্যারাবিয়ান সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে যে ঝড় ওঠে তাকে বলে হারিকেন। আর আটলান্টিক মহাসাগরে যে ঝড় হয় তাকে বলে টর্নেডো। টর্নেডো ঝড়ের বেগ ঘণ্টায় ২০০ মাইলেরও বেশি হয়। মরুভূমিতেও ঝড় হয়। মরুভূমির বালির ঝড়কে বলে সাইমুম। আবার কোথাও বলে সিরক্কো। আমাদের দেশে ধুলোর যে ঝড় ওঠে তাকে বলে লু বা আঁধি। এছাড়া দুটি বাতাস যখন উল্টো দিক থেকে এসে মুখোমুখি ধাক্কা খায় তখনই শুরু হয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়।
বাতাসের শেষ কোথায়?
সমুদ্রের তীর আর এর উপরের বাতাস সবচেয়ে ঘন। সেখান থেকে যতই ওপরে ওঠা যায় বাতাস ততই পাতলা হতে থাকে। সমুদ্রপৃষ্ঠে বাতাসের স্বাভাবিক চাপ এক বর্গ ইঞ্চিতে প্রায় ১৫ পাউন্ড বা এক বর্গ সেন্টিমিটারে প্রায় এক কেজি। বায়ুর চাপ সবসময় সমান থাকে না। একই স্থানে বছরের বিভিন্ন সময় বায়ুর চাপ বিভিন্ন হয়। আবার একই স্থানে সকাল, দুপুর, বিকেলে বায়ুর চাপ পরিবর্তন হয়। বায়ুর চাপ পরিবর্তন হয় প্রধানত ৩টি কারণে। এক. উষ্ণতার তারতম্য। দুই. ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা। তিন. জলীয়বাষ্পের পার্থক্য।
পৃথিবী থেকে ৯৬ কিলোমিটার উঁচুতে দেখা যায় যে, সমুদ্রের ওপর যতটুকু জায়গায় ১০ লক্ষ বাতাসের কণা গাদাগাদি করে থাকে সেখানে ততটুকু জায়গায় রয়েছে মাত্র একটি বাতাসের কণা। আমরা যদি ৪৮২-৭৫০ কিলোমিটার উঁচুতে উঠি তাহলে দেখা যাবে বাতাসের চাপ একেবারেই নেই। এজন্য যত ওপরে ওঠা যাবে আমাদের নিশ্বাস নিতে তত বেশি কষ্ট হবে। এজন্য ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠতে গেলে অক্সিজেন লাগে, লাগে বিশেষ ধরনের পোশাক। তাই বলে ওপরের দিকে বাতাসের চাপ একেবারেই ফুরিয়ে যায় না। হাজার মাইল ওপরেও বাতাসের কণা দেখা যায়। তাই বায়ুমণ্ডলের শেষ আর মহাকাশের শুরু কোথায় তা সঠিকভাবে বলা যায় না। ধরে নেয়া যায় মহাকাশ শুরু হয়েছে আমাদের মাথার ৪০০ কিলোমিটার উপর থেকে। তবে সব জায়গাতেই বায়ুমণ্ডল যে এতটা পুরু বা গভীর তা নয়। তবে যেভাবে বা যে স্থান দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হোক না কেন বায়ুর প্রবাহ কখনো শেষ হবে না। আর উপরের দিকে ওঠার এক পর্যায়ে তো বাতাসের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এজন্য ঠিক কতদূর উচ্চতা পর্যন্ত বাতাস আছে তা সঠিকভাবে বলা যায় না। বাতাসের বুঝি কোনো শেষ নেই। বাতাসের কোনো দেশ নেই। বাতাস সারাক্ষণ আমাদের ছুঁয়ে আছে মায়া হয়ে, ছায়া হয়ে।