নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে এখন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। এক বছরের ব্যবধানে দেশের খেলাপি ঋণের হার ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশই খেলাপি।
সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ২০২১ সালে যেখানে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ শতাংশ, তা ২০২৩ সালে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশে। একই সময়ে ভারতের খেলাপি ঋণের হার ৭ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে কমে ১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে, ভুটান ও মালদ্বীপেও ঋণ খেলাপির হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে খেলাপি ঋণের হার ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। আর চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
কেন খেলাপি ঋণ বাড়ছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী জানান, আগে নানা কৌশলে খেলাপি ঋণ আড়াল করা হতো। ঋণ সহজে পুনঃতফসিল করার সুযোগও খেলাপি ঋণ কম দেখানোর কারণ ছিল। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঋণের শ্রেণিবিন্যাস শুরু হওয়ায় প্রকৃত চিত্র সামনে আসছে। পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা এবং আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে ঋণের বোঝা আরও বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই সুস্থ ব্যবসায়ীদের পুনরায় উদ্যোগী হওয়ার পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব : ২০২৩ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের গোপন খেলাপি ঋণ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপসহ ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের নেওয়া ঋণের প্রকৃত অবস্থা সামনে আসে। ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়ে যায়। এর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইভাবে সরকারি খাতের অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের আইএফআইসি, ইউসিবি ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বাড়ছে।
সমাধানের উদ্যোগ : খেলাপি হয়ে পড়া প্রায় ১ হাজার ৪০০ প্রতিষ্ঠান ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের আবেদন ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করছে, যাতে মাত্র ১ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ মিলবে। তবে পুনর্গঠনের সময়সীমায় সুদ পরিশোধ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, এ পদক্ষেপে খেলাপি ঋণের চাপ কিছুটা হলেও কমবে।