তারিক মনজুর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবার এমন এক ডাকসু নির্বাচন করছে, যেটি আদৌ হবে কি না, এ নিয়েই সন্দেহ ছিল। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা বড় অংশ এই আট থেকে দশ দিন আগেও মনে করেছে, নির্বাচন হবে না। তবে গঠিত নির্বাচন কমিশনের রিটার্নিং কর্মকর্তারা তফসিল ঘোষণার আগে যখন বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন, তখনই নিশ্চিত হয়েছেন, নির্বাচন করা সম্ভব। কারণ, ডাকসুর ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের কোনো দ্বিমত নেই। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী ও ভোটারদের আগ্রহ ও সহযোগিতার কারণেই ডাকসু হচ্ছে।
এবারের ২০২৫ সালের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন অনেক কারণে ব্যতিক্রম। এত বেশি প্রার্থী ও ভোটার অতীতে কখনোই ছিল না। এক বছরের বেশি সময় ধরে ডাকসু ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনের দফায় দফায় আলোচনা ও সভা হয়েছে। আর গঠিত নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নিরপেক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতা ও কাজের ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কখনোই অভিযোগ বা আপত্তি করেননি। সে কারণেই জাকসু, রাকসু, চাকসুর চেয়ে নির্বিঘ্নে নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, ডাকসু কোনো নির্দিষ্ট প্যানেল বা দলীয় নির্বাচন নয়। অথচ শিক্ষার্থীদের প্রচারণায় এবং গণমাধ্যমের সংবাদে প্রার্থীদের দলগত পরিচয় প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এবারই হয়তো প্রথম, গুরুত্বপূর্ণ পদে দাঁড়ানো বেশির ভাগ প্রার্থীই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কিংবা প্রচুরসংখ্যক ভোট পাওয়ার আশা করছেন। অনলাইন ও ক্যাম্পাসের প্রচারে তাই পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার থাকলেও চূড়ান্তভাবে তাঁরা নির্বাচনকে পণ্ড করতে চাননি।
নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের আচরণবিধি কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত অভিযোগ পেয়েছে খুবই কম। যেগুলো পেয়েছে, সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে টাস্কফোর্স ও তদন্ত কমিটি গঠন করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কাজ করার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। এই নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর-বাইরে কয়েকটি পক্ষ কাজ করেছে। তা ছাড়া এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলেও প্রস্তুতি নিতে হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের মতো করে। বরাবরই তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চিন্তার প্রধান বিষয় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রক্টোরিয়াল বডি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই কয় দিন দিনরাত কাজ করে সব বাধা দূর করেছেন এবং প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।
এবারই প্রথম ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে আবাসিক হলগুলোর বাইরে। ২০১৯ সালের সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কারণে এটি শিক্ষার্থীদের জোরালো দাবি ছিল। তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ডাকসুতে নতুন কিছু পদও তৈরি করা হয়, গঠনতন্ত্রেও পরিবর্তন আনা হয়। এরপরও ছাত্রসংগঠনগুলো বলেছে, তাদের কিছু দাবি আমলে নেওয়া হয়নি। যেমন সংগঠনগুলোর নেতারা চেয়েছিলেন, উপাচার্য যাতে ডাকসুর সভাপতি না হন, কিংবা আবাসিক হলের প্রভোস্ট যেন হল সংসদের সভাপতি না হন। তাঁরা এসব পদেও শিক্ষার্থী-প্রতিনিধি চেয়েছিলেন। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এমন দাবির কথা আমরা শুনিনি। এই দাবির পক্ষে যাঁরা আছেন, তাঁদের বোঝা দরকার, ডাকসু কোনো বিচ্ছিন্ন সংস্থা বা পক্ষ নয়, এর সদস্যদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়েই কাজ করতে হবে। ফলে বিদ্যমান ধারার মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে আপত্তির কিছু দেখি না।
ফ্যাসিবাদ সরকারের পতনের পর থেকেই ‘গণরুম-গেস্টরুম কালচার’ এবং দলীয় পরিচয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সোচ্চার থেকেছেন। এবার নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়ও এটি প্রাধান্য পেয়েছে। নির্বাচনের আগে ডাকসুর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীদের নিয়ে যে নির্বাচনী বিতর্কের আয়োজন করা হয়, সেখানেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে প্রশ্ন ছিল। আশার কথা, প্রত্যেক ছাত্রনেতাই দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে আবাসনব্যবস্থার অনিয়ম দূর করবেন। তবে এগুলো যতটুকু না নির্বাচিত প্রতিনিধি বা শিক্ষার্থীর দায়িত্ব, এর চেয়ে বেশি হল প্রশাসনের দায়িত্ব। যদি সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে আবাসিক হলগুলোয় সিট বরাদ্দ করা হয়, এমনকি শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সুপারিশও যদি অগ্রাহ্য করা হয়, তবে এ নিয়ে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।
ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না, কিংবা কোন আকারে থাকবে—এবার নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই এটি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় এসেছে। সংগঠনভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক রূপ শিক্ষার্থীরা অতীতে দেখেছেন। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে ভীতি কাজ করে। দলীয় সরকারের আমলে এর রূপ কী হবে, সেটি আমরা এখনই বলতে পারছি না। তবে ডাকসু যদি নিয়মিত হয় এবং সেই নির্বাচন যদি গ্রহণযোগ্য হয়, ছাত্ররাজনীতির ‘অপ’ ও ‘নেতি’ রূপ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত করা সম্ভব।
অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। তাই এবার নির্বাচনের দিন পরিবহনের নিয়মিত ট্রিপের বাইরেও অতিরিক্ত গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বড় অংশ উন্মুক্ত; সেখানে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা সহজ নয়। তারপরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা ও পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাতে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশ নষ্ট না হয়।
নির্বাচনের ভোট গণনা ও ফলাফল তৈরির কাজে শিক্ষক ও প্রযুক্তিবিদদের যুক্ত করা হয়েছে, যাতে এ নিয়ে কোনো রকম বিতর্ক না হয়। তা ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্র থেকে ভোট গণনার কাজটি সরাসরি দেখানোর জন্য কেন্দ্রের ভেতরে ক্যামেরা ও বাইরে এলইডি স্ক্রিন বসানো হয়েছে। নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষকেরা এবার সত্যিই একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে চান। রিটার্নিং কর্মকর্তারাও সতর্ক ছিলেন, যাতে তাঁদের পক্ষপাত নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে।
স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে মাত্র সাতবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। ফলে, প্রতিবার নতুন করে ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করতে হয়। আগের সুবিধা ও কাঠামো ব্যবহার করা যায় না। তা ছাড়া মাত্র দু-আড়াই মাসে এমন একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সহজ কাজ নয়। সারা দেশ এই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ডাকসু নির্বাচনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে যুক্ত না করা পর্যন্ত আসল সমস্যা কাটবে না। এটি করা গেলে ক্লাস-পরীক্ষায়ও বিশেষ বিঘ্ন ঘটবে না।
ভবিষ্যতের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য আরেকটি উপায়ের কথা ভাবা যেতে পারে। এখন প্রত্যেক শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তাঁর ব্যক্তিগত ড্যাশবোর্ডে ঢুকে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষক মূল্যায়নের কাজ করতে পারেন। একইভাবে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও যদি ওয়েবসাইটে ঢুকে ইউনিক আইডির মাধ্যমে গোপনে ভোট প্রদানের সুযোগ তৈরি যায়, তবে এত ঝামেলা পোহাতে হয় না।
তারিক মনজুর, ডাকসু রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়