বিশেষ প্রতিবেদন
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বাংলাদেশের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকাকালীন এবং পরবর্তী সময়েও তিনি একের পর এক বিতর্কিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন—যার ফলে দেশ হারিয়েছে একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ।
ক্ষমতা অপব্যবহার ও রাজনৈতিক আনুগত্য
প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে খায়রুল হক চুক্তিভিত্তিকভাবে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করেন। এই পদটি গ্রহণের মাধ্যমে তিনি বিচারপতির অবসরের মর্যাদা লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন এক উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি যে আচরণ করেছেন, তা ভবিষ্যৎ বিচারকদের জন্য নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
গণবিরোধী ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
খায়রুল হকের বিরুদ্ধে যেসব গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ:
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল
খায়রুল হক, মোজাম্মেল হোসেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মিলে আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চে এই ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। অথচ প্রকাশ্য রায়ে বলা হয়েছিল, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হবে—এই অংশটি পরবর্তী চূড়ান্ত রায় থেকে গায়েব করে দেন তারা।
জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে অস্বীকার
বিচারপতি থাকাকালীন খায়রুল হক নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার একমাত্র ঘোষক ঘোষণা করে। এসময় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলিলপত্র’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড বাতিল করে তা বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন তিনি।
দুই বিতর্কিত বিচারপতির শপথ
প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থেকেই বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস বাবুকে হাইকোর্ট বিভাগে শপথ করান। এদের মধ্যে রুহুল কুদ্দুস একটি হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছিলেন, যার মামলা হাইকোর্টে খারিজ হয়েছিল।
আগাম জামিনের এখতিয়ার বাতিল
খায়রুল হকের নেতৃত্বে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের আগাম জামিন প্রদানের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্তে নাগরিকদের বিচারিক সুরক্ষা ক্ষুণ্ন হয়।
খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদে মূল ভূমিকা রাখেন খায়রুল হক। কোনো শুনানি ছাড়াই আপিল বিভাগের বেঞ্চ থেকে একতরফা আদেশ দিয়ে উচ্ছেদ কার্যকর করা হয়।
ত্রাণ তহবিলের টাকা ব্যক্তিগত চিকিৎসায় ব্যবহার
২০০৯ সালে বিচারপতি থাকা অবস্থায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা অনুদান নেন। সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখায় চেক জমা দিয়ে সেইদিনই তিনি নগদ ৯ লাখ টাকা উত্তোলন করেন।
আইন কমিশনে ক্ষমতার অপব্যবহার
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালে গাড়িচালক এসএম সামসুল আলমকে ২০১৩ সালে জোরপূর্বক অবসর দিতে বাধ্য করেন। সামসুল আলম বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং চাকরি ফেরত চেয়ে আবেদন করেছেন।
প্লট বরাদ্দে জালিয়াতি ও অনিয়ম
২০০৩ সালে পূর্বাচল প্রকল্পে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ পেলেও প্রথম কিস্তি পরিশোধ না করায় খায়রুল হকের বরাদ্দ বাতিল হয়। কিন্তু ২০০৯ সালে সরকারপ্রধান ঘনিষ্ঠ অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় পুরনো তারিখের অপ্রদত্ত চেক জমা দিয়ে তিনি প্লট পুনরায় গ্রহণ করেন, যা ছিল আইন ও বিধিবহির্ভূত।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, “খায়রুল হকই আয়নাঘরের মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা করে হাজার হাজার মানুষ হত্যার পথ খুলে দিয়েছিলেন। তার বিচার জনতার আদালতেই হওয়া উচিত।”
ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল মন্তব্য করেন, “শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বানানোর প্রধান রূপকার খায়রুল হক। বিচারবিভাগে যেন আর কোনো খায়রুল হক না জন্ম নেয়, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি।”
এবিএম খায়রুল হকের কার্যকলাপ শুধু বিচারবিভাগকেই কলুষিত করেনি, বরং গোটা গণতান্ত্রিক কাঠামোকেই নড়বড়ে করে তুলেছে। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আসনে বসে নৈতিকতা, সততা ও নিরপেক্ষতার যে আদর্শ ধরে রাখার কথা, তা বরং তার পদক্ষেপে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এখন সময় এসেছে বিচারবিভাগে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে এমন অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার।