বিশেষ প্রতিবেদক
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দীর্ঘদিনের অস্থিরতা, কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি এবং নির্বাচনব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক—সব মিলিয়ে একটি কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বহুদিনের। ২০২৪ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আত্মদান সেই প্রয়োজনীয়তাকে তীব্র রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত করে। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের “জুলাই জাতীয় সনদ” হয়ে উঠেছে একটি সম্ভাব্য রাজনৈতিক মোড়বদলের রূপরেখা।
✦ সনদের সূচনা: সংস্কার কমিশন থেকে ঐকমত্য কমিশন
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত হয় ছয়টি সংস্কার কমিশন—সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, প্রশাসন ও পুলিশ। কমিশনগুলো ফেব্রুয়ারিতে তাদের সুপারিশ জমা দিলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যার কাজ ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংস্কার সনদের খসড়া তৈরি করা।
✦ ১২ দফায় রাজনৈতিক ঐকমত্য
দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ১২টি মৌলিক সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে উঠেছে, যা জুলাই সনদের খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে:
১. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা: একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন।
২. ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার: অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে সাংসদরা দলীয় হুইপ মুক্তভাবে ভোট দিতে পারবেন।
৩. সংসদীয় কমিটিতে বিরোধীদের ভূমিকা: আসন অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সভাপতিত্বে বিরোধীদলীয় সাংসদদের অগ্রাধিকার।
৪. নির্বাচনী সীমানা পুনর্বিন্যাস: অবিলম্বে এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সীমানা নির্ধারণ।
৫. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের বিধান পর্যালোচনা।
৬. বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ: হাইকোর্টের আঞ্চলিক শাখা এবং উপজেলা পর্যায়ে বিচার কার্যক্রম সম্প্রসারণ।
৭. সংবিধান সংশোধন পদ্ধতির আধুনিকায়ন।
৮. জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ।
৯. প্রধান বিচারপতি নিয়োগে নতুন নিয়ম।
১০. নির্বাচন কমিশন গঠন: সরকার, বিরোধী দল ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ইসি সদস্য মনোনয়ন।
১১. স্বাধীন পুলিশ কমিশন: পেশাদার, জনবান্ধব ও দায়বদ্ধ পুলিশ প্রশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিশন গঠন।
১২. প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদ পৃথকীকরণ: এ বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত হলেও বিএনপি ভিন্নমত পোষণ করেছে।
✦ মতভেদ রয়ে গেছে যেসব ইস্যুতে
তবে আটটি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো পূর্ণ ঐকমত্য হয়নি:
১. সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে (পিএসসি, ইসি, তথ্য কমিশন, দুদক) নিয়োগপদ্ধতি।
২. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন ও উচ্চকক্ষের ভূমিকা।
৩. সংরক্ষিত নারী আসন বৃদ্ধি ও সরাসরি নির্বাচন।
৪. রাষ্ট্রপতির নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ক্ষমতার পরিধি।
৫. সংবিধানের মূলনীতির ব্যাখ্যা ও সংযোজন।
৬. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো ও কার্যকাল।
৭. মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ।
৮. রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নির্ধারণ ও সীমাবদ্ধতা।
✦ বিএনপির আপত্তি ও সাময়িক ওয়াকআউট
ঐকমত্য কমিশন যখন সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের আলাদা কমিটির প্রস্তাব দেয়, বিএনপি তাতে আপত্তি জানায়। তাদের দাবি, এতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব হবে এবং নির্বাহী কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে। বিএনপির প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হলে প্রশাসনিক স্থবিরতা তৈরি হবে।” আপত্তির প্রেক্ষিতে বিএনপি বৈঠক থেকে ওয়াকআউট করলেও পরে আলোচনায় ফিরে আসে।
✦ জুলাই সনদের ৭টি প্রধান রাজনৈতিক অঙ্গীকার
জুলাই সনদের খসড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সাতটি প্রধান অঙ্গীকার নির্ধারণ করা হয়েছে:
১. জনগণের রক্ত ও ত্যাগের মূল্যায়ন করে সংস্কার বাস্তবায়নের দায়বদ্ধতা।
২. সংবিধান ও আইন সংশোধনের মাধ্যমে কাঠামোগত সংস্কারের প্রতিশ্রুতি।
৩. নির্বাচনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করার অঙ্গীকার।
৪. প্রতিটি সংস্কারের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ।
৫. আইনি ও সংবিধানিক নিরাপত্তা বিধান।
৬. রাজনৈতিক সদিচ্ছার অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর।
৭. ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনের সংবিধানে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
✦ একটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ?
বিশ্লেষকদের মতে, “জুলাই জাতীয় সনদ” রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরল এক ঐকমত্যের চিত্র তুলে ধরেছে, যদিও মতভেদও কম নয়। এটি শুধু আসন্ন নির্বাচন নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানউজ্জামান বলেন,
“এই সনদ যদি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক না হয়, তবে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দুর্বল হবে। অতীতে যেমন তিনদলীয় জোটের রূপরেখাও বাস্তবায়িত হয়নি।”
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত অংশগ্রহণ এবং মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা—এই দুটি উপাদান রাজনীতির ভাষায় একটি নতুন অধ্যায় সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
চূড়ান্ত খসড়া এখনও তৈরি হয়নি, কিন্তু এর প্রস্তুতিপর্ব ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রেখে চলেছে।