২০২৪ সালের ২৩ জুলাই (মঙ্গলবার) ছিল বাংলাদেশের সমসাময়িক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সারাদেশজুড়ে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও ঘটনা ঘটেছিল এদিন।
কোটা সংস্কার: সরকার জারি করলো নতুন প্রজ্ঞাপন
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ এবং ৭ শতাংশ পদে কোটার বিধান রেখে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। এই সিদ্ধান্ত ৯ম থেকে ২০তম গ্রেডের চাকরির জন্য প্রযোজ্য হয়। এতে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নতুন নিয়োগব্যবস্থার সূচনা ঘটে।
সীমিত পরিসরে ইন্টারনেট চালু
টানা ছয় দিনের ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতার পর ২৩ জুলাই রাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হয়। তবে সবার জন্য নয়—জরুরি সেবা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও কিছু ব্যবসায়িক খাতে এই সুবিধা সীমিতভাবে চালু করা হয়। মোবাইল ইন্টারনেট তখনো বন্ধই ছিল।
শিথিল হলো কারফিউ, খুলে দেওয়া হয় অফিস ও পোশাক কারখানা
কারফিউ অব্যাহত থাকলেও পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। মহাসড়কগুলোতে যান চলাচল শুরু হয়। সরকার ২৪ জুলাই (বুধবার) সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি অফিস খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেওয়ার ঘোষণাও আসে।
চললো চিরুনি অভিযান, গ্রেফতার ছাড়াল তিন হাজার
দেশব্যাপী সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের চিরুনি অভিযান অব্যাহত রাখে। ২৩ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে গ্রেফতার হয় আরও প্রায় ১,১০০ জন, যার মধ্যে শুধু ঢাকায় ৫১৭ জন। এক সপ্তাহে (১৭–২৩ জুলাই) মোট গ্রেফতার সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়ায়। এদিন ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে ৩৮টি মামলা দায়ের করা হয়।
আন্দোলনকারীদের চার দফা দাবি ও আলটিমেটাম
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে চার দফা দাবি পেশ করে এবং ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল:
১. সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ পুনরায় চালু করতে হবে
২. কারফিউ প্রত্যাহার করতে হবে
৩. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরিয়ে নিয়ে আবাসিক হল খুলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় ফেরার পরিবেশ তৈরি করতে হবে
৪. আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
এই দাবিগুলো সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। তিনি জানান, সরকার দাবি মেনে নিলে সংলাপের পথ তৈরি হতে পারে।
নিখোঁজ আন্দোলনকারীদের খোঁজ দাবি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১৮ জুলাই থেকে আন্দোলনের তিনজন শীর্ষ নেতা—আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আবু বাকের মজুমদার এবং রিফাত রশীদ নিখোঁজ রয়েছেন। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান ও সরকারের বার্তা
তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “কোনো নির্দোষ শিক্ষার্থীকে যদি মামলায় জড়ানো হয়ে থাকে, তাদের নাম দিলে তা যাচাই-বাছাই করা হবে।”
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, “শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে আবাসিক হল খুলে দেওয়া সম্ভব নয়।”
র্যাবের মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “নাশকতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
রেল যোগাযোগে আংশিক স্বাভাবিকতা
টানা পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর এদিন তেলবাহী ট্রেন চালু করা হয়। যাত্রীবাহী ট্রেন এখনো বন্ধ থাকলেও রেল যোগাযোগে এই আংশিক স্বস্তি আসে।
২৩ জুলাই ছিল উত্তাল আন্দোলন ও সরকারের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার এক মোড় পরিবর্তনের দিন। এই দিনের ঘটনাগুলো সামনের দিনগুলোর গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।