ইবনে হাকিম
গোপালগঞ্জে ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ‘জুলাই পদযাত্রা’কে কেন্দ্র করে যে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক ঘটনার সীমা অতিক্রম করে জননিরাপত্তা, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের ক্ষেত্রে একাধিক গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই ঘটনার পর যেসব প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়েও জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, যা রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত।
ঘটনার সূত্রপাত এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা এবং পাল্টাপাল্টি সহিংসতায়। এতে পাঁচজন নিহত হন এবং সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা এবং কারফিউ জারি করা হয়। এসব ব্যবস্থার পেছনে যুক্তি থাকলেও, তা যেন স্বল্পমেয়াদি হয় এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে—এটাই কাম্য।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ঘটনার পর ৩ হাজার ৮ জনকে আসামি করে চারটি মামলা এবং ৫ হাজার ৪০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে আরও চারটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলার পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয়েছে গণগ্রেপ্তারের আশঙ্কা। যাঁরা প্রকৃত অপরাধী নন, তাঁদের গ্রেপ্তার হলে শুধু তাঁদের জীবনেই নয়, আইনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাতেও মারাত্মক ধাক্কা লাগবে।
এছাড়া নিহতদের মধ্যে চারজনের ময়নাতদন্ত না করে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর, সুরতহাল না করা—এসব বিষয় তদন্তের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বজনরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ নিয়ে গেছেন। কিন্তু স্বজনদের বক্তব্য ভিন্ন। এটা স্পষ্ট, তদন্ত ও বিচারের প্রক্রিয়ায় এমন গাফিলতি থাকলে দায়ী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাবে, আর নির্দোষরা হয়রানির শিকার হবেন।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে একদিকে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা, অন্যদিকে নিরপরাধ নাগরিকদের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। গোপালগঞ্জে বর্তমানে যেসব তল্লাশি ও গ্রেপ্তার অভিযান চলছে, তা অবশ্যই হতে হবে নিরপেক্ষ, প্রমাণভিত্তিক এবং জবাবদিহিমূলক। অতীতে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় যেভাবে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও ভীতিকর অভিযান পরিচালিত হয়েছে, তেমন কিছু আবার ঘটলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে।
সরকারকে এখন যে কাজটি করতে হবে তা হলো—স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা, নিরপরাধ কাউকে হয়রানি না করা এবং মানুষের চলাচল ও জীবিকা নির্বিঘ্ন রাখতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ। শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষা নয়, মানুষের মধ্যে আস্থা ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনা এখন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
গোপালগঞ্জে শান্তি ফিরিয়ে আনা এবং মানবাধিকার রক্ষা—এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেই সরকারকে পথ চলতে হবে। রাজনৈতিক বিরোধ যেন জনজীবনে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টি না করে, সে বিষয়ে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। নইলে এটি দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।