এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন। ‘নির্বাচিত সরকার সনদে উল্লেখিত সাংবিধানিক সংস্কার সমূহ বাস্তবায়ন করবে’- বিএনপির এই ইচ্ছা সফল হবে না। যদি এই ফাঁদে সরকার পা দেয় তাহলে জুলাই যোদ্ধাদের ঠেকানো যাবে না। তারা আবার রাজপথে নামবে। নামবে না-ই বা কেন? মাত্র তিন সপ্তাহে দেড় হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে, ত্রিশ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে কি বর্তমান কাঠামোর মধ্যে একটি নির্বাচন করে দেশকে আবার সেই পুরনো অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য? জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না করে নির্বাচনে যাওয়া, আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো অবস্থা হবে।
অনেকে হয়তো মনে করছেন ছাত্র উপদেষ্টাদের ছোটখাটো ভুলত্রুটি, সার্জিসের গাড়িবহর, ওয়েস্টিনে বা নীলা মার্কেটে হাঁসের মাংস-কাণ্ড, তুষারের নীলাকাণ্ড, ইত্যাদির কারণে এবং উপুর্যপরি আওয়ামী প্রপাগান্ডা জুলাই অভ্যুত্থানের উত্তাল ঢেউকে ম্লান করে দিতে পেরেছে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই বাংলাদেশের মানুষ শুধু হাসিনাকে উচ্ছেদ করেনি, এদেশের মাটি থেকে, রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে, মনেপ্রাণে ফ্যাসিবাদকেও উচ্ছেদ করেছে। কোনোভাবে যদি আবার সেই পুরনো বন্দোবস্ত ফিরে আসে বা আসার সম্ভাবনা দেখা দেয় রাজপথ আবারো উত্তাল হবে, আবার গণসুনামি দেখা দেবে।
একটি দল কাকের চক্ষুমুদে খাবার লুকানোর মতো চালাকি করছে, ফ্যাসিবাদ প্রসঙ্গ এলেই তারা এমন ভাব করে ফ্যাসিবাদ মানেই হাসিনা বা আওয়ামী লীগ। যেন এদেশের ছাত্র-জনতা বুঝতে পারেনি বর্তমান বন্দোবস্তের মধ্যে অন্য যে কোনো দল ক্ষমতায় গিয়ে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান ব্যবস্থা বহাল থাকলে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে যে কোনো দল বা দলের নেতৃত্ব ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে যে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা রাজনৈতিক দলটি নিকট অতীতে ক্ষমতায় ছিল এবং অনেক ফ্যাসিস্ট আচরণই তারা করেছে। তারাই প্রথম প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থায় ফাটল ধরিয়েছে। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই ফাটল ধরা স্তম্ভটিকে পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে।
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে, দরকষাকষি করে, শতভাগ প্রত্যাশিত না হলেও আকাঙ্ক্ষার কাছাকাছি একটা জুলাই সনদের খসড়া তৈরি করা গেছে। যদিও ৩টি পয়েন্টে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে রেখেছে: ১. সরকার প্রধান এবং দলের প্রধান এক ব্যক্তি থাকবেন না, ২. জাতীয় নির্বাচনে দলসমূহের প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের সদস্য মনোনীত হবে এবং ৩. জুলাই সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না মর্মে ইনডেমনিটি, তা সত্ত্বেও আমি বলব এই জুলাই সনদ বাস্তবায়িত হলে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা বা স্বপ্ন অনেকখানিই পূরণ হবে।
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন একটি বড় সংস্কার, যদিও এটি নতুন কোনো আবিষ্কার নয়, ন্যায়পাল নিয়োগের ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ স্বাধীন করা, বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় করা, সংসদের উচ্চকক্ষ, সর্বোচ্চ ১০ বছরের বেশি কেউ সরকারপ্রধান থাকতে পারবেন না, আর্টিকেল ৭০ এর মতো গণতন্ত্র বিনাশী ধারা সংশোধন, এইসব মোটাদাগে ভালো সংস্কার। এখন কথা হচ্ছে এই খসড়া সনদ, মূলত যা হচ্ছে সংস্কারের প্রস্তাবনা, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব যদি নির্বাচিত সরকারের হাতে অর্পণ করা হয় তাহলে “যেই লাউ সেই কদু” অবস্থা হওয়ার একটা তীব্র সম্ভাবনা আছে। নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় বসবে তখন তারা অতীতের মতো সকল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে এই আশঙ্কা দেশবাসীর মনে প্রবলভাবেই আছে।
এখন কথা হচ্ছে সংসদ ছাড়া কী সংবিধান সংস্কার বা সাংবিধানিক পরিবর্তন বাস্তবায়ন করা সম্ভব? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ সম্ভব। অধ্যাদেশের মাধ্যমে সাংবিধানিক সংস্কার ছাড়া অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্কার করার পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বাস্তবায়নের সম্ভাব্য যেসব ব্যবস্থার কথা বলেছে সে-সবের মধ্যে অধ্যাদেশ, গণভোট, গণপরিষদ নির্বাচন ইত্যাদির কথা আছে। এসবের চেয়েও একটা সহজ এবং কার্যকর প্রস্তাবের কথা বলি। এটিও অধ্যাদেশ তবে একটি ব্যতিক্রমী অধ্যাদেশ। জুলাই অভ্যুত্থানের সকল অংশীজন সনদে স্বাক্ষর করবেন, এই ঐকমত্য হয়েছে এবং যে কোনো সময় রাজনৈতিক দলগুলো সই করতে প্রস্তুত আছে।
সকল রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরের পরে এটি রাজনৈতিক দলগুলোর একটি যৌথ দলিলে পরিণত হবে। এরপর এই মর্মে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হবে যে এই সনদে বর্ণিত সকল সুপারিশ স্বাক্ষরের দিন থেকেই কার্যকর হবে। আসন্ন জাতীয় সংসদে উত্থাপিতব্য জুলাই সনদ বিল দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অগ্রিম অনুমোদিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হলো। যদি সনদে স্বাক্ষরিত সকল রাজনৈতিক দল মিলে সংসদের উভয়কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তাহলে প্রথম অধিবেশনেই প্রি-অ্যাপ্রুভড (অগ্রিম অনুমোদিত) বিলটি অনুমোদিত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। যদি কোনো কারণে স্বাক্ষরিত সকল রাজনৈতিক দল মিলে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তাহলে এই অগ্রিম অনুমোদন বাতিল হয়ে যাবে। তবে জুলাই সনদে স্বাক্ষরিত সকল রাজনৈতিক দল মিলে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যে পাবে এ-বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। আমি মনে করি এটি একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। এই বিষয়ে কোনো দলের অমত করার কোনো কারণ দেখি না। যদি সত্যিই তারা জুলাই সনদের বিষয়ে আন্তরিক হয় তাহলে অবশ্যই এই প্রস্তাবে সকলেই একমত হবেন।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৬ আগস্ট ২০২৫