–জুলাই অভ্যুত্থানের যোদ্ধা লামিয়া ইসলাম এর গল্প
জুলাই ২০২৪, ইতিহাসের পাতায় একটি সাহসী অধ্যায়। এই সময়ের রাজপথে যারা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের একজন লামিয়া ইসলাম। সদ্য বিবাহিত এক তরুণী, হাতে তখনও মেহেদীর রঙ টকটকে লাল—এই অবস্থায়ই মিছিলে প্ল্যাকার্ড হাতে শামিল হয়েছিলেন তিনি।
আজ, এক বছর পর, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বিশেষ আয়োজনে কথা বললেন তিনি—জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, তাঁর অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে।
রাজনীতিতে আসা: স্বপ্ন নয়, দায়বোধ
ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি-সচেতন লামিয়া। কৈশোরেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জটিল বইগুলো পড়ে শেষ করেছেন। আজ তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্রী এবং রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক।
তিনি বলেন, “এই রাষ্ট্রকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। শাসকের নয়, সেবকের রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন নিয়েই আমি রাজনীতিতে এসেছি।”
তিনি যখন রাজনীতির মাঠে নামেন, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল ফ্যাসিবাদী দমন-পীড়নে জর্জরিত। নিজের অধিকারের কথা বলাও যেন অপরাধ। তার ভাষায়, “তখন কেউ কথা বললেই তাকে হেনস্তা করা হতো। আমি জানতাম, ভয় পেলে চলবে না।”
আন্দোলনের ভেতর বিয়ে: সংগ্রাম থেমে থাকেনি
জুলাইয়ের আন্দোলনের সময়ই তাঁর বিয়ে হয়, ১২ জুলাই। তবে মেহেদী শুকাবার আগেই তিনি ফের রাস্তায়। নিজের ভাষায়, “আমি বিয়ের কারণে দুইদিন মাঠে থাকতে পারিনি। কিন্তু তৃতীয় দিনেই রাস্তায় নামি। শ্বশুরবাড়ি থেকে মিথ্যা বলে বের হতাম, হাতে মেহেদী লেগেই ছিল তখনও।”
এই সময়ে পুলিশের তল্লাশি ছিল ভয়ংকর। ছাত্র দেখলেই মোবাইল চেক করা হতো। লামিয়ার মতো অনেকেই বের হওয়ার আগে কাগজে নিজের নাম, মায়ের ও স্বামীর নম্বর লিখে রাখতেন। তাঁর কণ্ঠে বিষণ্নতা:
“জানি না, ফিরতে পারব কিনা। যদি মরেই যাই, অন্তত যেন পরিবার লাশটা পায়।”
‘একতা’ই বড় অস্ত্র
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এ তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণও ছিল সাহসিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত। পূর্বের ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য’-এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এই নতুন প্ল্যাটফর্মে নেতৃত্ব দিয়েছেন সংগঠিতভাবে।
“আন্দোলনটা মানুষ নিজেই নিয়ে নিয়েছে। আমাদের কাজ ছিল শুধু ধৈর্য রেখে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা। মানুষ একে অপরের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিল।”
হৃদয়ে গেঁথে থাকা স্মৃতি
২ আগস্ট শাহবাগের সংঘর্ষের কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে তাঁর। বলেন, “চোখের সামনে দুইজনকে গুলিতে পড়ে যেতে দেখেছি। সেই দৃশ্য এখনও শিউরে তোলে।”
ভবিষ্যতের স্বপ্ন: জনগণের রাষ্ট্র
লামিয়ার ভাষায়, “আমরা এমন একটা রাষ্ট্র চাই যেখানে সরকার জবাবদিহির বাইরে না থাকে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। রাজনীতি থাকবে কিন্তু ক্যাডার নির্ভর হবে না।”
তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রের সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে।”
পরবর্তী বাংলাদেশ: সময় এখনও ফুরায়নি
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতায় কিছুটা হতাশ লামিয়া। তাঁর মতে, “আমরা যে রকম কাঠামোগত পরিবর্তন আশা করেছিলাম, এখনো তেমন কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। তবে সময় এখনও ফুরায়নি।”
তিনি অবিলম্বে জুলাইয়ের আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা, ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা এবং ফ্যাসিবাদী কাঠামো উৎখাতের দাবি জানান।
এই ত্যাগ, এই সংগ্রামই হয়তো একদিন নির্মাণ করবে সত্যিকার অর্থে এক নাগরিকবান্ধব বাংলাদেশ।
বাসস থেকে সংকলিত ও সম্পাদিত