বিশেষ প্রতিবেদন
আজ বিশ্ব বন্ধু দিবস। আগস্টের প্রথম রোববার এই দিনে পালিত হয় ভালোবাসা, সহমর্মিতা আর নির্ভেজাল সম্পর্কের অনন্য উৎসব—বন্ধু দিবস।
২১ জুলাই, রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুহূর্তটিকে অনেকেই এক নতুন বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মো. আরমান হোসেন মোস্তফা যখন আগুনের মধ্যে নিজ সহপাঠীর দিকে ছুটে যাচ্ছিল, তখন যেন বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটাই বদলে যাচ্ছিল। সে জানত না, ভিডিও থেকে নেওয়া তার সেই রক্তাক্ত-অগ্নিদগ্ধ বন্ধুকে জড়িয়ে ধরা ছবিটি ভাইরাল হয়ে যাবে; কিন্তু সে জানত, বন্ধুকে একা ফেলে যাওয়া যায় না। একজন বন্ধু আরেকজনের মুখে হাসি ফেরাতে ছুটে আসে মৃত্যুকূপেও—এই তো বন্ধুত্ব।
বন্ধুত্ব মানে শুধু শব্দ নয় : বন্ধু মানে শুধু আড্ডা, হাসি বা উপহার নয়—বন্ধু মানে পাশে থাকা। ঝিনাইদহের চার যুবক রিপন, তরিকুল, হাশেম ও রাজু বাকপ্রতিবন্ধী, কণ্ঠে কোনো আওয়াজ নেই তাঁদের। কিন্তু চায়ের দোকানে তাঁরা যখন একত্র হন, তাঁদের চোখের ভাষা, মুখের ভঙ্গি, নীরব হাসিই হয়ে ওঠে যোগাযোগের মাধ্যম। কেউ দেরি করলে হাতের নড়াচড়ায় তার কারণ জানতে চান, কেউ মিষ্টি চায়ের তিক্ততায় ঠোঁট উল্টে ক্ষোভ জানান। সমাজ যাকে অক্ষম ভাবে, বন্ধুত্ব তাদের দিয়েছে এক অনন্য ভাষা।
এই নীরব বন্ধুত্বই বলে দেয়—ভালোবাসা প্রকাশে শব্দের প্রয়োজন পড়ে না, হৃদয়ই যথেষ্ট।
রাজপথেও গড়ে উঠেছে বন্ধুত্বের সেতু : ২০২৪ সালের গণআন্দোলন আমাদের শিখিয়েছে—বন্ধুত্ব শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, তা হতে পারে সামষ্টিক শক্তিরও প্রতীক। রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন শিক্ষার্থী, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুজাইফা, আবীর, বাবলু, রতন, শামীম, সুবর্ণা ও কবির—এরা শুধু প্রতিবাদকারী নন, আন্দোলনে তারা হয়ে উঠেছেন একে অপরের ছায়া, ভরসা, বন্ধু।
বুলেটের মুখেও বন্ধুর শরীর আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক যেমন সাহসের প্রতীক, তেমনি দেয়ালে আঁকা সেই বন্ধুর ছবি স্মৃতির রাখাল হয়ে রয়ে গেছে সবার মনে।
বন্ধু দিবস মানেই অনুভবের উৎসব : ঢাকার তন্ময় হালদার আজ বন্ধুদের নিয়ে পাহাড়ে যাচ্ছেন। রফিকুল ইসলাম বন্ধুরা মিলে সংগীতসন্ধ্যার আয়োজন করেছেন। গৃহবধূ সাবিহা নওয়ারা নিজের হাতে কেক বানাচ্ছেন বন্ধুর জন্য। মাজহারুল আবেদিন মারুফ বন্ধুদের পুরোনো ছবিগুলো নিয়ে অ্যালবাম বানাচ্ছেন, যাতে বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত জীবন্ত হয়ে ওঠে।
কেউ ফুল দেন, কেউ বই, কেউবা শুধু একটি হৃদয়ভরা মগ উপহার দেন। তবে সবচেয়ে বড় উপহার—একসঙ্গে কাটানো সময়, স্মৃতির গভীরে জমা হওয়া ভালোবাসা।
বন্ধুত্ব মানেই বৈচিত্র্যের ভেতর ঐক্য : বিশ্ব বন্ধু দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য—”Building Bridges: Celebrating Diversity, Solidarity and a Culture of Peace”—এই কথাটিই তুলে ধরেছে। অর্থাৎ, বন্ধুত্ব এমন এক সেতুবন্ধ, যা জাতি, ধর্ম, ভাষা বা মতবাদের সীমা পেরিয়ে আনে ঐক্য ও শান্তির বার্তা।
ঢাকার তিন বন্ধু হাসিনা আক্তার, মাসুমা জাহান ও তাজমুন নাহার এখন তিন ভিন্ন জীবনযাত্রায়, তবু তারা সময় বের করে মিলিত হন। তাদের মতে, বন্ধুত্ব হলো এমন এক শক্তি, যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের বৈরিতাকে থামাতে পারে।
তাজমুন বলেন, ‘বন্ধুত্ব মানেই সহমর্মিতা, আর এই অনুভবই পারে গাজা বা বিশ্বের অন্য প্রান্তের কান্না থামাতে।’
বন্ধুত্ব চিরন্তন, রূপ বদলায় : সময়ের স্রোতে কেউ হারিয়ে যায়, কেউ থাকে না পাশে। কিন্তু কিছু স্মৃতি, কিছু মুহূর্ত বুকের গভীরে থেকে যায়। সেগুলো কখনো ফেসবুকের ছবিতে ফিরে আসে, কখনো সেই পুরোনো আড্ডার ঠেক ঘুরে এসে হৃদয়ে বাজে এক কান্না-মিশ্রিত হাসির সুরে—‘তুই পাশে ছিলি, আর এটাই সবচেয়ে বড় কথা।’
আজকের দিনটি শুধু একটি তারিখ নয়, একটি অনুভব। একটি সুযোগ, একে অপরকে বলার—”তুই আছিস বলেই সব সহজ লাগে।”
বন্ধু দিবস উদযাপন হোক সব বিভাজন ভুলে, সব মানুষকে আপন করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কারণ, বন্ধুত্ব—এই একটিমাত্র শব্দই পারে শান্তির পৃথিবী গড়তে।