নিজস্ব প্রতিবেদক
আজ ৫ আগস্ট, ‘৩৬ জুলাই’। এক বছর আগে, এই দিনে টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসন শেষে পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। শিক্ষার্থী–জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে যেটি ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ নামে পরিচিতি পেয়েছে—আজ তারই প্রথম বার্ষিকী।
এই দিনটি শুধু একটি সরকার পতনের ঘটনা নয়; এটি একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান এবং একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি: কোটা আন্দোলন থেকে একদফা দাবিতে : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হয় এই আন্দোলনের সূচনা। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে কোটা বাতিল হলেও ২০২৪ সালের ৬ জুন হাইকোর্টের রায়ে তা পুনর্বহাল হয়। এর পর থেকেই সারা দেশের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে রাস্তায় নামেন।
আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও শহরে। সরকারের অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ, ছাত্রলীগ ও পুলিশের হুমকি ও হামলা আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলে। প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্য—যেখানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বংশধর’ হিসেবে ইঙ্গিত করা হয়—তা আন্দোলনকারীদের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম দেয়।
তারা স্লোগান তোলে: “আমরাও রাজাকার, আমরাও রাজাকার”, প্রতিবাদী ভাষ্য হয়ে ওঠে রাজপথজুড়ে।
আন্দোলনের নিষ্ঠুর মোড়: শহীদ আবু সাঈদ ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতা : ১৬ জুলাই, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাঈদের মৃত্যুর দৃশ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জাতি হতভম্ব হয়ে যায়।
শোক থেকে জন্ম নেয় অগ্নিসংযোগ। রাষ্ট্র শুরু করে দমন-পীড়নের ভয়াবহ অভিযান—কারফিউ, সেনা মোতায়েন, হেলিকপ্টার থেকে নজরদারি, টিয়ার গ্যাস, গুলি—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে যুদ্ধাবস্থার মতো।
জনতার ঢল ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগ : ৫ আগস্ট ঘোষিত হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’। কারফিউ ভেঙে ঢাকার পথে নামে লাখো জনতা। শাহবাগ, শহীদ মিনার, সংসদ ভবন—প্রতিটি স্পটে জমায়েত হয় জনসমুদ্র। এদিন রাতেই শেখ হাসিনা পরিবার-পরিজনসহ সামরিক বিমানে দেশ ত্যাগ করেন।
এএফপি’র তথ্য অনুযায়ী, তিনি তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার চেষ্টা করলেও সময় পাননি।
এই মুহূর্তে সরকারপ্রধান পদত্যাগ করেন এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নতুন পথচলার সূচনা হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে।
৮৩৬ শহীদের দিন: শোক ও সংহতির রূপান্তর : সরকারি গেজেট অনুযায়ী, আন্দোলনে শহীদ হন ৮৩৬ জন, যাদের মধ্যে বিএনপির সহযোগী সংগঠনেরই রয়েছে ৪২২ জন। আন্দোলন শেষে পালিত হয় ‘জাতীয় শোক দিবস’। তবে শিক্ষার্থীরা এই শোককে রূপান্তর করে লাল কাপড়ে মুখ ও চোখ বেঁধে প্রতিবাদে—সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে লাখো মানুষ তাদের সঙ্গে সংহতি জানায়।
ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহের চূড়ান্ত রূপ: দ্রোহযাত্রা ও এক দফা ঘোষণা : ২ আগস্ট ‘দ্রোহযাত্রা’ আয়োজন করে গণজাগরণকারীরা। শহীদ মিনারে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। ৩ আগস্ট লাখো জনতা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ সমর্থন করে এক আঙুল তুলে সাড়া দেয়।
এরপর ৫ আগস্ট গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সাধারণ মানুষের দখলে চলে যায়—নির্মিত হয় নতুন ইতিহাস।
জাতীয়ভাবে উদযাপন : এই দিনটিকে স্মরণে রাখতে আজ সরকারি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বিকেল ৫টায় উপস্থাপন করা হবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’, পাঠ করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।
ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও আজ আয়োজিত হবে প্রার্থনা ও মোনাজাত। রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে অনুষ্ঠিত হবে ‘যাত্রাবাড়ি গণহত্যা’ স্মরণানুষ্ঠান। মাসব্যাপী যে অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়েছে ১ জুলাই থেকে, তারই পরিণতি হচ্ছে এই ৩৬ জুলাইয়ের উদযাপন।