শ্রাবণের জলভেজা দিন শেষে আজ পহেলা ভাদ্র—বাংলার প্রকৃতিতে শুরু হলো শরৎকাল। ভাদ্র ও আশ্বিন মাস নিয়ে ঋতুচক্রের তৃতীয় ধাপ গঠিত হয় শরৎ। খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী আগস্টের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয় এই ঋতু। শুভ্রতার ঋতু শরৎ বাঙালির কাছে শুধু একটি ঋতুই নয়, বরং সৌন্দর্যের, উৎসবের এবং কাব্যের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার।
শরতের রূপ
শরৎ মানেই নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, পেঁজা তুলোর মতো ভেসে চলা স্নিগ্ধ মেঘরাজি। সবুজ মাঠে বাতাসে দোলে কাশফুলের শুভ্রতা। ঘাসভরা বনে কিংবা নদীর তীরে ছড়িয়ে থাকে শরতের মায়াবী সৌন্দর্য। শ্রাবণের অবিরাম বৃষ্টি শেষে প্রকৃতি যেন নতুন সাজে সেজে ওঠে এই ঋতুতে। তাই শরৎকে বলা হয় “ঋতুরাণী”।
সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শরৎ
শরৎ আবহমান বাংলার সাহিত্য, গান আর সংস্কৃতিতে অনন্ত অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। মহাকবি কালিদাস তাঁর কাব্যে শরৎকে নববধূরূপে বর্ণনা করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসংখ্য কবিতা ও গানে শরতের শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্যকে অমর করে তুলেছেন। তাঁর ভাষায়— “শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙুলি।”
কবি বিনয় মজুমদারও শরতের আকাশে ভেসে যাওয়া শুভ্র মেঘে খুঁজে পেয়েছেন নির্মলতার দর্শন।
উৎসব ও আনন্দের ঋতু
শরৎ মানেই আবার দুর্গোৎসব। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শরৎকালেই অনুষ্ঠিত হয়। শরতের হাওয়া বইতেই চারদিকে বাজতে শুরু করে ঢাকের আওয়াজ, প্রতিমা সাজানোয় মেতে ওঠে শিল্পীরা। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ভক্তি আর আনন্দে ভরে ওঠে পরিবেশ। তবে বিজয়া দশমীর দিনে আনন্দের সঙ্গে মিশে যায় ব্যথাতুর বিদায়ের সুর।
শরতের আরেক রূপ প্রকৃতির দান—এই সময়ই গাছে গাছে পাকে তাল। সেই তাল দিয়ে তৈরি হয় নানা রকমের পিঠা-পায়েস। ক্ষেতে বেড়ে ওঠে আমন ধানের চারা। শরতের স্নিগ্ধ রাতগুলোতে ভেসে আসে জ্যোৎস্নার বিমোহিত আলো, যা কবি-সাহিত্যিকদের কলমে রূপ পায় অনন্য বর্ণনায়।
হারিয়ে যাওয়া শরৎ বরণ
একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ কিংবা ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে শরৎ বরণের নানা আয়োজন হতো। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শরৎকে বরণ করত গান, কবিতা, নাচ ও নাটকের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে এ আয়োজনের রেওয়াজ কমে এসেছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবার কোনো শরৎবরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে না বললেই চলে। অথচ প্রকৃতি ও মাটির সঙ্গে মানুষের এ যোগসূত্রই একটি জাতিকে সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করে।
শুভ্রতার প্রতীক ঋতুরানি
শরৎ বাঙালির কাছে কেবল ঋতু নয়—এ এক অনুভূতির নাম, সৌন্দর্যের নাম, উৎসবের নাম। শুভ্র কাশফুল, শিউলি ফুলের গন্ধ, ধানক্ষেতের সোনালি স্বপ্ন আর জ্যোৎস্নায় ভেজা রাত—এসব মিলেই গড়ে ওঠে শরতের মহিমা।
আজ পয়লা ভাদ্র, শুভ্রতার ঋতুর প্রথম দিন। প্রকৃতি তার সাদা-সবুজ সাজে আবারও ডাক দিচ্ছে—আমরা কি তবে সেই সাড়া দিতে প্রস্তুত?