মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধ। কিন্তু এর অভিঘাত এতটাই গভীর যে, তা কেবল ইরান-ইসরায়েলের মধ্যকার সামরিক সংঘাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছড়িয়ে পড়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে—প্রভাব ফেলেছে বৈশ্বিক রাজনীতি, তেলবাজার, নিরাপত্তা কাঠামো এবং কূটনৈতিক ভারসাম্যে।
গত ১৩ জুন শুরু হয়ে ২৪ জুন শেষ হওয়া এই সংঘাতে ইরান যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা দুর্বলতার কারণে, তেমনি ইসরায়েলও রেহাই পায়নি ইরানি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত থেকে।
প্রতিরক্ষার ভেতর ফাঁকফোকর
ইরানের সাম্প্রতিক সামরিক মহড়া ‘ইক্তেদার-১৪০৩’-এ বলা হয়েছিল, তেহরান, ইস্পাহান, নাতাঞ্জ ও আরাক শহরসহ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো সুরক্ষিত। কিন্তু বাস্তব যুদ্ধের আঘাতে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়ে।
বিশেষ করে ইসরায়েলের একাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের অভ্যন্তরে ঢুকে হামলা চালানোয় গোয়েন্দা নিরাপত্তা ব্যবস্থার এক গভীর সংকট প্রকাশ পেয়েছে। জানা গেছে, ইরানের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে স্পর্শকাতর তথ্য পাচার ও অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে। ফলে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে বিপ্লবী গার্ডসহ বহু সংস্থায়।
পাল্টা আঘাতে ইরানের বার্তা
প্রতিরক্ষার দুর্বলতা সত্ত্বেও ইরান যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে শক্তভাবে জবাব দিতে শুরু করে। ‘ফাতেহ-১১০ এইচএস’ এবং অন্যান্য হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে একাধিক স্থাপনায় আঘাত হানে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান তার সামরিক সক্ষমতা—বিশেষ করে আক্রমণাত্মক অস্ত্রব্যবহার—এর মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, তারা এখন আর কেবল প্রতিরক্ষামূলক শক্তি নয়, বরং একটি আঞ্চলিক সামরিক শক্তি হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত।
হতাহত ও মানবিক বিপর্যয়
ইরানের সরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা ৬১০ হলেও বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, প্রকৃত সংখ্যা ৯০০ ছাড়িয়ে গেছে। আহত প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। ইসরায়েলেও প্রায় ৩০ জন নিহত ও তিন হাজারের বেশি আহত হয়েছে।
যুদ্ধের সময় ইরানের স্কুল, হাসপাতাল ও এমনকি কারাগারেও হামলা হয়েছে, যার মধ্যে ‘এভিন’ কারাগারের ঘটনা বিশেষ উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
অর্থনৈতিক ধাক্কা ও বৈদেশিক সংকট
যুদ্ধের প্রভাব অর্থনীতিতেও স্পষ্ট। ইরানের তেল রপ্তানি হঠাৎ করে কমে যাওয়ায় রাজস্বে বড় ধাক্কা লাগে। ক্ষতির পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বলে একাধিক সংস্থা অনুমান করেছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের পুনর্গঠন খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। ফলে উভয় দেশের বাজেট ঘাটতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ দৃঢ়তা না ভাঙা ‘ঐক্য’
অনেকে ধারণা করেছিলেন, এই যুদ্ধ ইরানে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক পতনের সূচনা ঘটাতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, কুর্দি, বেলুচি, আরব বা আজেরিদের মধ্যে কোনো বড় ধরনের বিদ্রোহ হয়নি। বরং বাইরের আক্রমণের মুখে ইরানি সমাজ একপ্রকার জাতীয় ঐক্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
ইরানের সামনে তিনটি সম্ভাব্য পথ
১. আন্তর্জাতিক সংলাপে ফিরে আসা: যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়ে নতুন আলোচনা।
২. কঠোর অবস্থান বজায় রাখা: প্রতিরোধ নীতি জোরদার করে পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়া।
৩. কৌশলগত নমনীয়তা: দমন ও আলোচনার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে আঞ্চলিক অবস্থান ধরে রাখা।
বর্তমানে ইরান এই তিন পথের দোলাচলে আছে, যদিও অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলো দ্বিতীয় পথকেই বেশি সমর্থন করছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
এই ১২ দিনের যুদ্ধ ইরানের সামনে এক কঠিন সত্য উন্মোচন করেছে—তাদের সামরিক কাঠামোতে ফাঁক আছে, গোয়েন্দা নিরাপত্তা দুর্বল, কিন্তু জনগণের ঐক্য ও সামরিক প্রতিক্রিয়া এখনো অনেক শক্তিশালী।
এখন ইরানের নেতৃত্বের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে, তারা সংস্কারের পথে যাবে, না কি আপসহীন প্রতিরোধের দিকে। তাদের সেই সিদ্ধান্ত শুধু তেহরানের নয়—সারাবিশ্বের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যসূত্র : বিবিসি, আলজাজিরা, সিএনএন