মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে বড় ধরনের সামরিক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। শনিবার প্রথম প্রহরে ইরান সরাসরি ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। এর আগে শুক্রবার রাতে ইসরায়েলের চালানো হামলায় তেহরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়, নিহত হন দেশটির শীর্ষ সামরিক ও পরমাণু বিজ্ঞানীরা।
ইরানি হামলায় ইসরায়েলে ক্ষয়ক্ষতি
ইসরায়েলের তেল আবিব, জেরুজালেমসহ একাধিক শহরে একাধিকবার বিমান হামলার সাইরেন বেজে উঠেছে। তেল আবিবের আকাশে কালো ধোঁয়া দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিওতে শহরের একটি আবাসিক ভবনে আগুন এবং ধ্বংসস্তূপের ছবি দেখা গেছে। ইসরায়েলের সরকারি সূত্র বলছে, হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন, একজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন।
আইডিএফের মুখপাত্র আভিচায় আদ্রাই দাবি করেছেন, “ইরান থেকে ছোড়া অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করা হয়েছে। কিছু ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ কিছু ভবনে আঘাত করেছে।” হামলার পর দেশজুড়ে জরুরি সতর্কতা জারি করা হয় এবং লোকজনকে সুরক্ষিত বাংকারে আশ্রয় নিতে বলা হয়।
তেহরানের বিমানবন্দরে আগুন, বিস্ফোরণের শব্দ
অন্যদিকে, তেহরানের মেহরাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিস্ফোরণের পর ব্যাপক আগুন ও ধোঁয়া দেখা গেছে। বার্তা সংস্থা এএফপি এবং ইরানি সংবাদমাধ্যম ‘মেহর’ বিস্ফোরণের খবর নিশ্চিত করেছে। তবে তা ইসরায়েলি হামলার অংশ ছিল কি না— তা এখনও স্পষ্ট নয়। ইরান সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত দেয়নি।
ইরানের পাল্টা প্রতিশোধ ও যুদ্ধের হুঁশিয়ারি
শুক্রবার রাতের ইসরায়েলি হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, রেভ্যুলেশনারি গার্ড প্রধান হোসেইন সালামি এবং ছয়জন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হন বলে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম নুর নিউজ। নিহতের সংখ্যা ৭৮ এবং আহত ৩২৯ জন বলেও ওই প্রতিবেদন জানায়।
এই ঘটনার জবাবেই ইরান শনিবার ইসরায়েলের ভেতরে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, “যারা আমাদের ভূখণ্ডে হামলা চালাবে, তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ধৈর্য ধরার আহ্বান এখন অযৌক্তিক।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: শান্তি আহ্বান ও উদ্বেগ
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস ইরান ও ইসরায়েলের প্রতি দ্রুত উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে চীন এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, “ইরানের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও ভূখণ্ডগত সংহতি লঙ্ঘিত হয়েছে।” চীনের জাতিসংঘ প্রতিনিধি ফু কং বলেন, “পারমাণবিক জ্বালানির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের অধিকার ইরানের আছে। এই পরিস্থিতি পারমাণবিক আলোচনাকে আরও জটিল করে তুলবে।”
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে ‘পারমাণবিক কর্মসূচি চুক্তিতে’ ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “তা না হলে আরও ভয়াবহ হামলার মুখে পড়তে হতে পারে।”
সামরিক ভারসাম্য ও সম্ভাব্য পরিণতি
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান ও ইসরায়েল উভয়ই সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী। ইসরায়েলের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন ‘ডোম’ থাকলেও, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতাও বড় বাস্তবতা।
এই উত্তেজনা শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়— পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে, পারস্য উপসাগর ও সৌদি-ইরান সম্পর্ক, সিরিয়া-লেবাননে সংঘাতের ধরণ এবং আমেরিকা-চীন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রেও এই সংঘর্ষ একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করছে।
পরিস্থিতি এখনও উত্তপ্ত। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা এখন বাস্তব এবং এর পরিণতি শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়— গোটা বিশ্বকেই নাড়া দিতে পারে।