অনেক দিন পর আজ পাভেল ভাইয়ের সাথে দেখা!
সন্ধ্যার ঠিক পরপর রামপুরা কাঁচাবাজারের কাছে পাভেল ভাইকে দেখি হাঁটছেন একা একা। পিঠে ঝোলানো কালো রঙের একটা ব্যাগ। হাতে যথারীতি জ্বলন্ত সিগারেট। কেমন ক্লান্ত পায়ে হাঁটছেন তিনি। যতদিন পাভেল ভাইকে চিনি কখনো তাকে সিগারেট ছাড়া দেখিনি! একদিন ইয়ার্কি করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই আপনি কি ঘুমের মধ্যেও সিগারেট খান নাকি?
আরে কী যা তা বলিছস! ভাই বাসায় ভাবির সামনে সিগারেট খেতে পারে না তো, তাই বাইরে একটু বেশি খায়।
আমাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফাজিল হিসেবে পরিচিত রাব্বি কথাটা বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসছিল। আর ভাই রাগে কটমট করে তাকিয়েছিলেন তার দিকে। সেসব কতদিন আগের কথা! এরপর সময় কেটেছে দ্রুত। মনে পড়ে পাভেল ভাই প্রায়ই বলতেন, সময় একটা পাগলা ঘোড়া। পাভেল ভাইয়ের কথা মতো পাগলা ঘোড়ায় চড়ে সময় চলে গেছে দূরে বহু দূরে । পাভেল ভাইও চলে গেছেন আমাদের থেকে অনেক দূরে। আদতে পাভেল ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, নাকি আমরাই তাকে সরিয়ে দিয়েছি, এই প্রশ্নের মীমাংসা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তবে অনেক দিন পর পাভেল ভাইকে দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি পেছন থেকে আস্তে করে ডাকি, ভাই? পাভেল ভাই! রাস্তায় গাড়ির তীব্র শব্দ, মানুষের কোলাহল তার ওপর কাছে কোথাও মাইকে নিয়মিত ওয়াসার বিল পরিশোধের কথা চেঁচিয়ে ঘোষণা করছে কেউ। ফলে আমার ক্ষীণস্বরের ডাক পাভেল ভাইয়ের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। আমি আবার ডাকি, গলা ফাটিয়ে। আশপাশের লোকজন অবাক চোখে আমার দিকে তাকায়। পাভেল ভাই নির্বিকারভাবে রাস্তা পার হতে থাকেন। আমিও দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে ধরে ফেলি তাকে।
ভাই কেমন আছেন? কতক্ষণ ধরে ডাকছি আপনাকে। শোনেনই না!
আরে রোহান যে! কেমন আছিস তুই? ডাকিছিলি, আমি শুনি নাই রে! এদিকে কী করছিস?
একসাথে অনেকগুলো কথা বলেন ভাই। আর দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে এসে আমি তখন হাঁপাচ্ছি।
চল কোথাও বসি।
হ্যাঁ, ভাই চলেন।
পাশেই একটা ছোট কফিশপে বসি আমরা দুজন। ছোট হলেও কফিশপটা শান্ত নিরিবিলি। দুই কাপ কফি অর্ডার করে পাভেল ভাই আমাকে বলেন, তারপর কেমন আছিস তুই?
আপনি কেমন আছেন ভাই?
আছি রে, ভালো আছি!
এখন কী করছেন ভাই?
রাহাত ভাইকে তো চিনিস! ওই যে ছায়ানীড়ে কাজ করতেন রাহাত ভাই। তিনি একটা নতুন প্রজেক্ট করেছেন। রাহাত ভাইয়ের অফিসে বসি। তুই তো এখনো সৃজনীতেই আছিস।
জি ভাই।
নীলিমা কেমন আছে রে?
আছে ভাই ভালোই।
এখনো কি তোর সাথে আগের মতো ঝগড়া করে?
কথাটা বলেই পাভেল ভাই শরীর দুলিয়ে হাসতে থাকেন, তার সেই বিখ্যাত হাসি!
এরপর পাভেল ভাইয়ের সঙ্গে নানা বিষয়ে এলোমেলো অনেক কথা হয়। অনেক স্মৃতিচারণ, অনেক প্রয়োজনের কথা অপ্রয়োজনের কথা। অনেক দিন পর পাভেল ভাইয়ের সাথে প্রাণখুলে হাসি। মনে হয় যেন আমরা সেই পুরনো উচ্ছল দিনগুলোতে ফিরে গেছি। কফিশপ থেকে বের হয়ে আমরা এসে ফুটপাতে দাঁড়াই। পাভেল ভাই সিগারেট টানতে থাকেন একটার পর একটা। আর কথার তুবড়ি ছোটাতে থাকেন। আমার মনে পড়ে পাভেল ভাই মানেই বল্গাহীন গল্পের ঝাঁপি। ফুটপাতের টং দোকানে বসি আমরা। সময় গড়াতে থাকে। সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া আমদের আড্ডা রাত দশটা পেরিয়ে যায়, কিন্তু আমাদের কারোরই উঠতে ইচ্ছে করে না। এক পর্যায়ে আমিই বলি, পাভেল ভাই আজকে তাহলে উঠি।
আরে এখনই যাবি কি! কত দিন পর তোর সাথে দেখা, থাক আরো কিছুক্ষণ!
পাভেল ভাইেয়র কথা ফেলতে পারি না। তাছাড়া পাভেল ভাইেয়র সঙ্গে থাকা মানে আনন্দে ভেসে যাওয়া। কিছু মানুষ আছে যাদের উপস্থিতি নির্মল বাতাসের মতো, খররোদের পর সজল বৃষ্টির মতো, তীব্র শীতে ওম ওম গরম কাপড়ের মতো, ভরা পূর্ণিমায় ভেসে যাওয়া খোলা প্রান্তরের মতো, পাভেল ভাই তেমন একজন মানুষ। সুতরাং পাভেল ভাইয়ের সাথে বসে থাকি আমি।
নভেম্বর মাস। ঢাকায় এখনো শীতের কোনো বালাই নেই। সারাদিনই ভ্যাপসা গরমে নাকাল হতে হয়েছে। এখন প্রায় মাঝরাত ছোঁয়া সময়ে একটু যেন হিম হিম লাগতে শুরু করে। যে চায়ের দোকানে আমরা বসে ছিলাম সেটিও প্রায় ফাঁকা।
রাত হলো রে অনেক। চল উঠি। তোকে অনেক দেরি করিয়ে দিলাম। পাভেল ভাই যেন কৈফিয়ত দিচ্ছেন আমাকে।
ভাই সুষমাদি কেমন আছেন?
জানি না রে! যোগাযোগ নাই অনেক দিন।
এরপর আরো প্রায় আধঘণ্টা পর বিদায় নিই পাভেল ভাইয়ের কাছ থেকে। পাভেল ভাই একটা রিকশা ডেকে মালিবাগের দিকে চলে যান। আর আমি হেঁটে হেঁটে উলন রোডের বাসায় ফিরি। দরজা খুলে দিয়ে নীরবে শোয়ার ঘরের দিকে চলে যায় নীলিমা। গত তিনদিন ধরে আমার সাথে কথা বন্ধ রেখেছে সে। এমন প্রায়ই হয়। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে কথা বন্ধ করে দেয় নীলিমা। একদিন দুইদিন আমার কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু এরপর থেকেই দমবন্ধ লাগতে শুরু করে। এবার ঠিক করেছি যত দমবন্ধই লাগুক নীলিমার সাথে আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলতে যাব না।
টেবিলে খাবার ঢাকা দেয়া আছে। হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসি আমি। শোয়ার ঘরের বাতি নেভানো। তবে আমি জানি নীলিমা জেগে আছে। অন্য সময় হলে নীলিমা পাশে এসে বসত। টুকটাক নানান কথা জিজ্ঞেস করত। কিন্তু এখন এসবের কিছুই করবে না। যতো জরুরি কথাই আমি বলি না কেন নীলিমা কোনো উত্তর দেবে না। একা একা খেতে খেতে অজান্তেই বলে ফেলি, আজ পাভেল ভাইয়ের সাথে দেখা হইসিলো! অনেক কথাবার্তা হলো দীর্ঘদিন পর। ওপাশে নীলিমা যথারীতি চুপ। আমিও আর কথা বলি না। খাওয়া শেষ করে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরাই। আমাকে অবাক করে দিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায় নীলিমা।
কোথায় পেলে পাভেল ভাইকে?
রামপুরা বাজারের এখানে, হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।
বাসায় নিয়ে আসতে?
নীলিমার কথা শুনে মনে হয়, তাইতো পাভেল ভাইকে বাসায় আসার কথা বলা উচিত ছিল। এই যে ক্ষণে ক্ষণে নীলিমার সাথ ঝগড়া করি। মান অভিমান করি। ভালোবাসা বাসি করি। পাভেল ভাই না থাকলে কি এটা কখনো সম্ভব হতো! পাভেল ভাই না থাকলে কি নীলিমাকে আমার পাওয়া হতো একান্ত করে? নীলিমা তো নীল আকাশে মিলিয়ে যেত কবেই সেদিন যদি পাভেল ভাই ভরসা হয়ে না দাঁড়াতেন!
পাভেল ভাই ছিলেন আমার বস। পাভেল ভাইয়ের অধীনে কাজ করতাম আমরা একঝাঁক তারুণ্য ঝলমল ছেলে মেয়ে। সেই দলে আরো অনেকের সাথে ছিলাম নীলিমা এবং আমি। পাভেল ভাই যতটা না ছিলেন বস তারচেয়ে অনেক বেশি ছিলেন বন্ধু। কাজপাগল মানুষ পাভেল ভাই ফাঁকি দেয়া একেবারেই পছন্দ করতেন না। আর ছিলেন ভীষণ রাগী। রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকত না তার। যা মুখে আসে বলে যেতেন সমানে। কে কী মনে করল তা নিয়ে মোটেও ভাবতেন না। আবার পরক্ষণেই ঠাণ্ডা হয়ে যেতেন। যাকে একটু আগে বকাঝকা করেছেন তাকে ডেকে নিয়ে চা খেতেন। অনেক সময় নিয়ে আড্ডা দিতেন। কিন্তু এসব করতে গিয়ে নিজের অনেক শত্রু তৈরি করে ফেলেছিলন পাভেল ভাই। পাভেল ভাই সৃষ্টিশীল মেধাবী মানুষ, এ নিয়ে দ্বিমত করবে না কেউ। তিনি যেকোনো কাজে হাত দিলে সেটি ফুল হয়ে ফুটতে বাধ্য, এটা পাভেল ভাইয়ের ঘোরতর শত্রুও স্বীকার করে। কিন্তু ওই যে তার একরোখা মনোভাব, তীব্র আবেগ আর মানুষের জন্য অপার ভালোবাসা সেটিই এক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। কোনো এক ঘটনায় আমাদের অফিসে মালিকদের দুইপক্ষের মধ্যে ব্যাপক ঝামেলা দেখা দেয়। সেই দ্বন্দ্ব আদালতে মামলা পর্যন্ত গড়ায়। আর সেই দ্বন্দ্বে মালিকপেক্ষর একজন অফিস ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। আর সেই দ্বন্দ্বের প্রথম বলি হন পাভেল ভাই আর সুষমাদি। না, মালিকদের কেউ না পাভেল ভাই আর সুষমাদির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। যাদেরকে পাভেল ভাই নিজের হাতে মানুষ করেছেন। যাদেরকে পাভেল ভাই বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। তারাই পাভেল ভাই আর সুষমাদির বিরোধিতা করেছিলাম! বিষয়টা আরেকটু খুলে বলা যাক। মালিকানার দ্বন্দ্বে একপক্ষ হেরে গেল। মূলত অফিস পরিচালনার দায়িত্বে ছিল যে পক্ষটা হেরে গেলেন তারাই। অফিস ছাড়তে বাধ্য হলেন তারা। আর তখন কতিপয় হিজড়া পণ্ডিত আর মূর্খ নেতা দায়িত্বে এলেন অফিস পরিচালনার। আমাদের কিছু সহকর্মী আদাজল খেয়ে লাগল পাভেল ভাই আর সুষমাদির বিরুদ্ধে। কেন? তাদের কিসের এত ক্ষোভ পাভেল ভাইদের বিরুদ্ধে? তারা নাকি পাভেল ভাইয়ে কারণে বঞ্চনার শিকার! পাভেল ভাই নাকি তাদের সাথে বৈষম্য করেছন! আর আমাদের হিজড়া পণ্ডিতেরা নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখার খায়েশে এক পাক্ষিক কথা শুনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন! কি হাস্যকর আচরণ। কিন্তু তারচেয়েও হাস্যকর এবং অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ করেছি আমরা। আমরা একবারের জন্যও মুখ ফুটে বলিনি অন্যায় হচ্ছে পাভেল ভাইয়ের সঙ্গে। আমরা একবারও বলিনি গত পনেরো বছর ধরে এই অফিসের ক্রম উন্নতির পেছনে পাভেল ভাই এবং সুষমাদির শ্রম ঘাম ত্যাগের অনেক গল্প আছে। আমরা বলিনি দিনের মধ্যে ১৭/১৮ ঘণ্টা সময় অফিসের জন্য দিয়েছেন পাভেল ভাই প্রতিদিন। আমাদের কিসের ভয় ছিল এত! পাভেল ভাই কিংবা সুষমাদির পক্ষ নিয়ে কিছু বললে আমাদের কি চাকরি চলে যেত? নিশ্চয় না। তাহলে কেন বললাম না আমরা? আসলে মানুষ খুব অদ্ভূত প্রাণী। অথবা সবাই তো আর পাভেল ভাই বা সুষমাদির মতো হতে পারে না। সহকর্মীর জন্য মালিকপক্ষের সাথে শিনা টানটান করে, গলার রগ ফুলিয়ে তর্ক করার সাহস এবং ইচ্ছা সবার থাকে না। কত সহকর্মীর জন্য যে পাভেল ভাই ঝগড়া করেছেন, সুবিধা অসুবিধার জন্য তুমুল তর্ক করেছন সেই হিসাব লেখা নাই কোথাও। সে সবের সাক্ষী শুধু আমরা, যারা পাভেল ভাই কিংবা সুষমাদির কলিগ ছিলাম। কিন্তু তাদের বিপদের সময় আমরা সবাই সাক্ষী গোপাল হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের মুখ থেকে একটি কথাও বের হয়নি তখন।
কেমন দেখলে পাভেল ভাইকে?
নীলিমার কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে আমার।
আছেন আগের মতোই। সেই একই রকম আড্ডাবাজ। মমতাময় স্নেহশীল।
আমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন কিছু?
জানতে চেয়েছেন তুমি আগের মতোই ঝগড়া করো কি না!
এত কিছু থাকতে পাভেল ভাই তোমাকে এইটা জিজ্ঞেস করেছে? চাপামারার আর জায়গা পাও না!
নীলিমা তোমার মনে আছে অফিস থেকে ফেরার পথে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম।
হুম। পাভেল ভাই সেদিন খুব অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।
একদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে আমার বুকে ভীষণ ব্যথা হয়। অফিসের ড্রপের গাড়িতে আরো কয়েকজন কলিগ ছিলেন আমার সাথে। তখন থাকতাম মিরপুরে। কলিগরা আমাকে নিয়ে যায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানে ইসিজি টিসিজি আরো কী পরীক্ষা নীরিক্ষা হয়। বুকের ব্যথা দেখে কলিগদের ধারণা হয় আমার হার্টে ব্লক বা বড় কোনো অসুখ হয়েছে। যথারীতি খবর চলে যায় পাভেল ভাইয়ের কাছে। সেই মধ্যরাতে পাভেল ভাই এসে হাজির। ভাই যে আসবেন এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম। ফলে অবাক হইনি মোটেও। আমাকে তখন রাখা হয়েছে সিসিইউতে। সেখানে ভিজিটর ঢুকতে বারণ। আনসার সদস্যরা আটকে দেয় পাভেল ভাইকে। প্রথমে ঠাণ্ডা মাথায় তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন পাভেল ভাই। তাতে কাজ না হলে নিজের অভ্যাস মতো রেগে যান পাভেল ভাই। আনসার সদস্যেক ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়েন সিসিইউতে। আর পাভেল ভাইকে দেখে আমার বুকের ব্যথা চলে যায়। ব্যথার শূন্যস্থানে বুকজুড়ে ভর করে প্রবল অভিমান। কেন এই অভিমান? কার প্রতি অভিমান, কিছুই বুঝি না। শুধু বুক ভেঙে কান্না আসে আমার। শোয়া থেকে উঠে বসি আমি। আমাকে জড়িয়ে ধরেন পাভেল ভাই। আমার মনেহয় হয়তো আমি আর বাঁচব না। আসলে একটু অসুখ বিসুখ হলেই খুব ভেঙে পড়া আমার পুরনো অভ্যাস। কাঁদতে কাঁদতে আমি বলি, পাভেল ভাই আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান প্লিজ। আমি মনে হয় আর বাঁচব না।
ধুর পাগল, কী যা তা বলছিস! বাঁচবি না কেন? এসব কোনো কথা। আমি আছি না! কিচ্ছু হয়নি তোর। দেখি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি।
পাভেল ভাইয়ের এক কথাতেই সব ভয় দূর হয়ে যায় আমার। পাভেল ভাইয়ের সাথে যখন থেকে পরিচয় তারপর থেকে যেকোনো বিপদ আপদ, সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনায় সব সময় সবার আগে তার কথাই মনে পড়ে কেন জানি। অথচ বাবা মা ভাই বোন আত্মীয় বন্ধুসহ কত কত আপনজন আছে। সবাইকে ছাপিয়ে কেন জানি পাভেল ভাইয়ের মুখটা চোখের সামনে ভাসে সবার আগে। মাঝে মাঝে ভাবতাম পাভেল ভাই কি জাদু জানেন? কোন মায়ায় মানুষকে এমন মোহাচ্ছন্ন করে রাখেন তিনি! আসলে এসব কিছুই না, আশপাশের মানুষের জন্য প্রবল মায়া পাভেল ভাইয়ের। আমরা তো আমরা অফিসের সামনের রাস্তার উল্টোদিকে চা সিগারেটের টং দোকানি রাইসুল কিংবা মোকসেদের জন্যও ভাইয়ের একই রকম। তারাও দেখি পাভেল ভাই বলতে জান কোরবান। একটা মানুষ কিভাবে পারেন সবাইকে এমন আগলে রাখতে!
তো, সে রাতে টেস্টের রিপোর্ট আসলে দেখা যায় তেমন কিছুই হয়নি আমার। গ্যাস্ট্রিকের কারণে প্রবল বুকে ব্যথা হয়েছিল বলে জানান ইমার্জেন্সির তরুণ ডাক্তার। আমরা বাসার দিকে রওনা দিই আর ঠিক তখন পাভেল ভাইকে ফোন করে নীলিমা।
হ্যাঁ তুমি চিন্তা কইরো না। আমরা কাছাকাছি আছি। আমিও আসতেসি তোমাদের বাসায়। … হ্যাঁ … না রাতে খাব না। তুমি এত ব্যস্ত হইয়ো না।
ফোন রেখে দেন পাভেল ভাই।
বুঝলি রোহান তোর বউ ফোন দিসিলো। তোরে যখন হাসপাতালে নেয়ার খবর পাইলাম তখনই আমি নীলিমারে ফোন কইরা কইসিলাম তোরে ফোনটোন না দিতে। তুই আমার লগে একটা জরুরি কাজে আছিস।
কথাটা বলেই পাভেল ভাই হাসতে শুরু করেছিলেন তার সেই বিখ্যাত শরীর দোলানো হাসি।
ভাই আপনি পারেনও! পাশ থেকে বলেছিল রাব্বী।
আরে বেটা তোরা বুঝবি কি! একজন হাসপাতালে কানতাসে আরেকজনরে বাসায় কান্দাইয়া লাভ আছে? তারচেয়ে বইলা দিসি আমার লগে আছে। টেনশন ফ্রি থাকল মেয়েটা। এইটা ভালো হইল না!
এরপর অনেক রাতে আমাকে নিয়ে বাসায় ঢুকেছিলেন পাভেল ভাই। রাতে খেয়ে যেতে অনেক সেধেছিলো নীলিমা। কিন্ত পাভেল ভাই বসেননি আর।
কী ভাবছো অত?
নীলিমা তোমার মনে আছে একবার অফিস থেকে ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। পাভেল ভাই আমাকে নিয়ে ভীষণ দৌড়াদৌড়ি করলেন!
হুম, মনে আছে। একটু আগেই না বললে!
আসলে জানো নীলিমা, পাভেল ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের এত এত স্মৃতি, কিন্তু সব ছাপিয়ে সে রাতের হাসপাতালের কথটাই মনে পড়ে খুব বেশি।
এরপর আমরা দুজনেই চুপ করে থাকি। আমি একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকি। নীলিমা আজ কিছুই বলে না। অথচ বাসায় সিগারেট খেলে সব সময় চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে নীলিমা।
রোহান, পাভেল ভাই না থাকলে তুমি কিন্তু আমাকে পেতে না।
হুম, হয়তো তাই। পাভেল ভাইয়ের কাছে আমার অনেক ঋণ।
কিন্তু পাভেল ভাইয়ের চরম দুর্দিনে তুমি তার পাশে দাঁড়াওনি। শুধু দাঁড়াওনি তাই না, তুমি পাভেল ভাইয়ের বিরোধিতা করেছিলে।
নীলিমার শেষ কথাটা শুনে আমি চুপ করে থাকি। সত্যি কথাই বলেছে নীলিমা। পাভেল ভাইয়ের চরম দুর্দিনে হয়তো তার জন্য কিছু করতে পারতাম না আমি। কিন্তু যদি অন্তত তার পাশে সহমর্মী হয়ে দাঁড়াতাম তাহলে হয়তো এতটা অপরাধ বোধে পুড়তাম না ।
আমার চোখের সামনে ভাসে অফিস ছেড়ে, চাকরি হারা পাভেল ভাইয়ের চলে যাওয়ার দৃশ্যটা। কালো ব্যাগটা পিঠের মধ্যে ফেলে সটান হেঁটে যাচ্ছেন পাভেল ভাই। চোখে চোখ পড়তেই ভাই ম্লান হাসলেন। তারপর স্পষ্ট গলায় বললেন, যাই রে। ভালো থাকিস তোরা সবাই। আমি কিংবা আমরা যারা পাভেল ভাইয়ের ছায়ায় মায়ায় ছিলাম দীর্ঘ বছর তারা কেউ না গেলেও পাভেল ভাইয়ের পিছু পিছু সেদিন গিয়েছিল আমাদের অফিসের পিয়ন সুজন। আজ এত বছর পর মনে হয় সুজনের যতটুকু সাহস আমার তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। কেন জানি আমার খুব কান্না পায়। চোখের জল লুকাতে আমি ওপরের দিকে তাকাই। আকাশে বিশাল একটা চাঁদ। তবে সেই চাঁদটাকে আমার খুব ঝাপসা লাগে।
নীলিমা শান্ত গলায় বলে তোমার মনে আছে রোহান, পাভেল ভাই খুব জোছনা ভালোবাসতেন?
হুম, মনে আছে। আমার গলাট কেমন ভাঙা ভাঙা লাগে।
কাঁদো, মন খুলে কাঁদো রোহান। পাভেল ভাই আমাদের উজাড় করে ভালোবেসেছেন। তার জন্য গোপনে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলাতেও আনন্দ আছে।
নীলিমার গলাটা কেমন ভাঙা ভাঙা শোনায়। সেও কি তবে কাঁদছে?
রাত গভীরের নির্জনে দুজন তরুণ তরুণী এক বোহেমিয়ান মানুষের জন্য ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। এটা হয়তো মানুষটার প্রাপ্য ছিল। সব সময় অন্যকে ভালোবাসা পাভেল ভাই জানুক বা না জানুক এই জোছনা রাত সাক্ষী থাকল অঝোর কান্নার।
পাভেল ভাই আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।