যুদ্ধ এখন হাসপাতালে
রাজধানীর উত্তরা। দুপুর ১টা। শিশুদের মুখে বিদায়ের হাসি, কেউ কোচিংয়ে, কেউ বাসায় ফেরার অপেক্ষায়। ঠিক তখনই আকাশ ফাটিয়ে নেমে আসে মৃত্যু। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাইমারি সেকশনের একটি ভবনে। শ্রেণিকক্ষ চূর্ণবিচূর্ণ, মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে ভবনটিকে। ধোঁয়া, চিৎকার, কান্না আর আতঙ্কে পরিণত হয় প্রিয় শিক্ষাঙ্গনটি এক বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরীতে।
সেই আগুন আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক নারী তখন ইতিহাস লিখে যাচ্ছিলেন নিঃশব্দে— শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী। নিজের দগ্ধ শরীর নিয়ে বাঁচিয়ে ফেলেন অন্তত ২০টি শিশুর প্রাণ। আর তারপর তিনি নিজেই চলে যান না–ফেরার দেশে।
স্বপ্ন ভেঙে দেওয়া আগুন
বেলা ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার এ কে খন্দকার বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করা চীনের তৈরি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটি মাত্র ১২ মিনিটের মাথায় ছুটে আসে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল প্রাঙ্গণে। বিমানটি প্রথমে মাঠে আছড়ে পড়ে, তারপর কয়েক গজ এগিয়ে গিয়ে দোতলা ভবনের নিচতলার শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়ে। মুহূর্তেই আগুনে পুড়ে যায় ক্লাসরুম, খেলাঘর, স্বপ্ন।
ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীরা ছুটে এলে শুরু হয় উদ্ধারকাজ। চারপাশে তখন পুড়ে যাওয়া শরীর, ছেঁড়া জামা, এবং আহাজারি।
আত্মত্যাগের গল্প: শিক্ষিকা মাহেরীন
সবাই যখন প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি করছিল, তখন শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরী বিপরীত পথে হাঁটছিলেন—অর্থাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি। প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, বিমানের আগুনে যখন ভবনের ভেতর দগ্ধ হয়ে পড়ছিল শিশুরা, তখন এই সাহসী শিক্ষিকা একের পর এক শিশুদের টেনে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আতঙ্কিত, আগুনে ঘেরা পরিবেশে বারবার ফিরে গেছেন ভবনের ভেতর।
তারই কারণে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী প্রাণে বেঁচে যায়— কেউ অক্ষত, কেউ সামান্য আহত। কিন্তু এই ত্যাগী যাত্রায় শেষবারের মতো যখন তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন আর ফিরে আসা হয়নি। আগুন আর ধোঁয়ার দেয়াল তাকে আটকে দেয় চিরদিনের জন্য। রাতেই বার্ন ইনস্টিটিউটে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন ডা. শাওন বিন রহমান।
এক অভিভাবক বলেন, “ম্যাডাম আমাদের বাচ্চাদের বুক দিয়ে আগুন থেকে আগলে রেখেছিলেন। সেনাবাহিনীও বলেছে, ওনার জন্যই আজ ২০টা পরিবার সন্তান ফিরে পেয়েছে।”

প্রাণ গেল ২২ জনের, যুদ্ধ এখন হাসপাতালে
ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। আহত হয়েছেন ১৭১ জন, যাদের মধ্যে ৫০ জনের বেশি দগ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন বার্ন ইনস্টিটিউটে। গুরুতর আহতদের অনেকের অবস্থা এখনও সংকটাপন্ন।
শিশুদের পোড়া শরীর দেখে চেনা যাচ্ছে না কারও মুখ। অনেকের পরিচয় শনাক্তে প্রয়োজন হচ্ছে ডিএনএ পরীক্ষা। স্বজনরা হাসপাতালের করিডরে ছবিহাতে ছুটছেন বিছানা থেকে বিছানায়।
নিহত বৈমানিকের শেষ যাত্রা
প্রশিক্ষণ বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম ছিলেন একা। এই ছিল তার প্রথম একক ফ্লাইট। যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ার পর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন বিমানটি জনবসতি থেকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি গিয়ে পড়েছিল শিশুদের স্কুলে।
তাকেও বাঁচানো যায়নি। দুর্ঘটনার আগেই প্যারাসুটে বেরিয়ে আসেন তিনি, কিন্তু ততক্ষণে মৃত্যুর থাবা ছিল অনিবার্য।
রাষ্ট্রীয় শোক এবং প্রশ্ন
ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সরকার ২২ জুলাই এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত, কিন্তু শোকের ভার অনেক ভারী।
নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নও জেগেছে নতুন করে। প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান ঘনবসতি অঞ্চলের মাথার ওপর দিয়ে উড়বে কেন? একই ধরনের বিমান এর আগেও দুর্ঘটনায় পড়েছে ২০১৮ ও ২০২১ সালে। ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন?
উদ্ধার অভিযানে সমবেদনার ঢল
সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, আনসার, স্কাউট, ফায়ার সার্ভিস—সবার সমন্বয়ে উদ্ধারকাজ শেষ হয় রাত সাড়ে আটটায়। স্বেচ্ছাসেবীরা রক্ত দিয়েছেন, পানি-পথ্য দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ শিশুর জন্য জামাকাপড় নিয়ে এসেছেন।
বিমান বিধ্বস্ত হওয়া এলাকায় সাধারণ মানুষের ঢল সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। কিন্তু মানুষের চোখে চোখে ছিল একই প্রশ্ন—”এমন আর কত?”
যে প্রশ্ন জ্বলে গেল, রেখে গেল ছাই
একজন পাইলট, একজন শিক্ষিকা, এবং আরও ২০টি নিষ্পাপ শিশু—এরা কি এমন মৃত্যুর যোগ্য ছিল? নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি, যুদ্ধবিমান ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, জনবহুল এলাকার ওপর প্রশিক্ষণ—এই সব প্রশ্ন শুধু রিপোর্টে থাকবে না, জ্বলবে মানুষের হৃদয়ে।
এই জাতির কাছে মাহেরীন চৌধুরী এখন কেবল শিক্ষিকা নন, এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি—ত্যাগ ও সাহসের। তাঁর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যিকারের নায়িকা কেবল বইয়ের পাতায় নয়, আগুনের মধ্যেও উঠে আসেন।