বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ বিভাগ ও ফোকাল পয়েন্ট গঠন
বাংলাদেশের পাঁচটি আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে একটি শক্তিশালী ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ‘ব্যাংক রেজুলিউশন বিভাগ’ নামে একটি বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। একইসঙ্গে এসব ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহে প্রতিটি ব্যাংকে একজন করে ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা মনোনীত করা হয়েছে।
মার্জারের পেছনে দুর্নীতির ছায়া
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপ ও নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ একাধিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্যে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ইসলামিক ব্যাংক কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক-এর আর্থিক অবস্থা চরম দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক চিত্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (AQR) রিপোর্ট বলছে, এ সব ব্যাংকে অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ, আমানতের তুলনায় বিপুল খেলাপি ঋণ এবং মূলধন ঘাটতির কারণে তাদের আর্থিক স্বাস্থ্য প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। উদাহরণস্বরূপ:
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
মোট ৬০,৯১৫ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৫৮,১৮২ কোটি টাকা (৯৫%) খেলাপি।
লোকসান: ৪০৫ কোটি টাকা
শাখা: ২০৬টি
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক
১৪,৪২৭ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ১৩,৫৬৯ কোটি (৯৪%) খেলাপি।
লোকসান: ২১৪ কোটি টাকা
শাখা: ১০৪টি
ইউনিয়ন ব্যাংক
২৮,২৭৯ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ২৬,৪৯১ কোটি (৯৪%) খেলাপি।
লোকসান: ৮০ কোটি টাকা
শাখা: ১১৪টি
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)
৩৫,২২০ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ২৩,৫৭৫ কোটি (৬৭%) খেলাপি।
লোকসান: ৫৩ কোটি টাকা
শাখা: ১৮১টি
এক্সিম ব্যাংক (প্রাথমিক তালিকায় থাকলেও এখন বাদ)
মোট ঋণের ৫২% খেলাপি এবং প্রভিশন ঘাটতি প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকা।
গ্রাহক আস্থা হারাচ্ছে ব্যাংকগুলো
ব্যাংকারদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই ব্যাংকগুলোতে নতুন আমানত আসা তো দূরের কথা, গ্রাহকরা প্রতিদিনই ভিড় করছেন অর্থ তুলে নিতে। অনেক শাখায় কর্মীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঋণ পরিশোধ না হওয়া এবং আমানতের চাপ সামলাতে না পারায় অধিকাংশ ব্যাংক দিশেহারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ ও পরিকল্পনা
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় তদন্ত, আর্থিক বিশ্লেষণ ও পুনর্মূল্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করছে। ব্যাংক রেজুলিউশন বিভাগ এসব কার্যক্রম তদারকি করছে। এর আগে ২০২৫ সালে “ব্যাংক রেজুলিউশন অর্ডিন্যান্স” জারি করা হয়, যাতে দুর্বল ব্যাংক পুনর্গঠন ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়।
কর্মীদের জন্য আশ্বাস
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, একীভূত ব্যাংক গঠন হলেও কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা চাকরি হারাবেন না। তবে শাখা কাঠামোয় কিছু রদবদল হতে পারে। শহরভিত্তিক শাখা গ্রামীণ অঞ্চলে স্থানান্তর করা হতে পারে।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও একীভূতকরণ কার্যক্রম চূড়ান্ত করতে এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, আর্থিক সংকটে জর্জরিত ব্যাংকগুলোকে পুনর্জীবিত করতে এটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।