হার্ট অ্যাটাক বা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আমাদের আশেপাশে প্রায়ই শোনা যায়। অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতেই পারেন না যে তিনি হার্ট অ্যাটাকের শিকার হচ্ছেন, কারণ উপসর্গগুলো সবসময় খুব স্পষ্ট হয় না। এমনকি শারীরিকভাবে সুস্থ ও নিয়মিত জীবনযাপনকারী ব্যক্তিও হার্ট অ্যাটাকের শিকার হতে পারেন। তাই কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। চিকিৎসকরা বলে থাকেন, হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে সময়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—প্রতিটি মিনিট জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান তৈরি করতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হিমেল সাহা বলেন, হার্ট অ্যাটাকের প্রথম এবং সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে বুকের মাঝ বরাবর তীব্র ব্যথা। এই ব্যথা ডান বা বাম পাশে নয়, বরং একেবারে বুকে কেন্দ্রভাগে অনুভূত হয়, যাকে চিকিৎসকেরা বলেন “সেন্ট্রাল চেস্ট পেইন”। এটি ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং এমন অনুভূতি হতে পারে যেন বুকের ভেতরে কিছু ছুরি দিয়ে আঘাত করছে বা একটি হাতি বুকের উপর পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
এই ব্যথা শুধু বুকে সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক সময় এটি ছড়িয়ে পড়ে বাম হাত, ঘাড়, চোয়াল বা পিঠেও। ঘাড়ে ব্যথা ছড়িয়ে পড়লে মনে হতে পারে যেন গলার মাংস কেউ চেপে ধরছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীরা এই ব্যথা ঠিকঠাক বুঝতে পারেন না, কারণ তাদের ব্যথা অনুভবের ক্ষমতা কম থাকে। তাই তাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক ‘নীরব ঘাতক’ হয়ে উঠতে পারে।
আরেকটি সাধারণ কিন্তু বিভ্রান্তিকর উপসর্গ হলো পেটে তীব্র ব্যথা। অনেক সময় এই ব্যথা এতটাই জ্বালাপোড়া ও তীব্র হয় যে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা বলে ভুল হয়। যাদের আগে থেকেই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে, তারা প্রায়ই বিষয়টি এড়িয়ে যান, যার ফলে দেরিতে চিকিৎসা নেওয়া হয়।
হার্ট অ্যাটাকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো শ্বাসকষ্ট। যদি হার্ট ফেইল করতে শুরু করে, তাহলে তা প্রথমে ফুসফুসে প্রভাব ফেলে, ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং অনেক সময় কাশি শুরু হয়। এই উপসর্গটিও অনেকেই ফুসফুসের সাধারণ সমস্যা বলে মনে করে অবহেলা করেন।
হার্ট অ্যাটাকের সময় শরীর অতিরিক্ত ঘামতে থাকে। কিন্তু এই ঘাম সাধারণ ঘামের মতো নয়। শরীরচর্চা না করেও, এমনকি শীতের মধ্যেও যদি হঠাৎ করেই প্রচণ্ড ঘামতে থাকেন, তাহলে সেটি হতে পারে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ। সঙ্গে অস্বস্তি, অস্থিরতা ও বুক ধড়ফড় করতে পারে।
অপর একটি লক্ষণ হলো হঠাৎ করে মাথা ঘুরে যাওয়া বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। এই অবস্থাও হার্ট অ্যাটাকের পূর্বাভাস হতে পারে। কখনো কখনো এই উপসর্গটিই প্রথম ও একমাত্র লক্ষণ হতে পারে।
বমি বমি ভাব বা বমি এবং চরম ক্লান্তিও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে, বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে। যদি হঠাৎ করেই শরীর খুব দুর্বল লাগে, বুকে চাপ অনুভূত হয় বা গলায় কিছু আটকে থাকার মতো অনুভব হয়, তাহলে তা অবহেলা করা উচিত নয়।
এছাড়া অনেক সময় হার্ট অ্যাটাক একদমই নিরবভাবে ঘটে যায়, যাকে বলা হয় “সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক।” এতে সাধারণ লক্ষণগুলো স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় না, কিন্তু রক্তনালী বন্ধ হয়ে হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এমন লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. হিমেল সাহা। তিনি বলেন, হার্ট অ্যাটাক হয় মূলত হার্টে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে। এই জমাট রক্ত ধমনী বন্ধ করে দেয়, ফলে হার্ট পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না এবং এর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তাই দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে রক্ত পাতলা করার ও ধমনী প্রসারিত করার ওষুধ দেওয়া হয়, যা রোগীর জীবন বাঁচাতে পারে।
সবশেষে, যত তাড়াতাড়ি লক্ষণগুলো শনাক্ত করা যাবে এবং চিকিৎসা শুরু করা যাবে, তত বেশি সম্ভাবনা থাকবে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার। হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গগুলো কখনও অবহেলা করা উচিত নয়—এগুলো শরীরের দেওয়া সতর্ক সংকেত, যা সময়মতো বুঝতে পারা মানে হতে পারে জীবন রক্ষা। সূত্র : বিবিসি বাংলা।