রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে প্রকাশ্য দিবালোকে ছিনতাইকারী চাপাতি হাতে ছিনতাই করে চলে যাচ্ছে, অথচ আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক পুলিশ নির্বিকার। এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
শুধু রাজধানী নয়—সারা দেশেই খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ বাড়ছে। অথচ অপরাধ দমনে চলছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ ও নতুন করে শুরু হওয়া ‘চিরুনি অভিযান’। তবুও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং জনগণের মধ্যে আতঙ্ক আরও গভীর হচ্ছে।
খুনের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই খুনের মামলা হয়েছে ১,৯৩৩টি। যেখানে জানুয়ারিতে ছিল ২৯৪টি, জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪৪টিতে। সবচেয়ে বেশি খুন হয়েছে ঢাকা মহানগর, ঢাকা রেঞ্জ ও চট্টগ্রাম রেঞ্জে। অনেক খুনের পেছনে রয়েছে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই।
ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ভয়াবহতা
ছিনতাই এখন শুধু রাতের ভয়ের নাম নয়, দিনে-দুপুরেও রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে ছিনতাই হচ্ছে পুলিশের সামনেই। একই সঙ্গে বাড়ছে চাঁদাবাজি, অপহরণ, নারী ও শিশু নির্যাতন। যদিও পরিসংখ্যানে ডাকাতির মামলা কিছুটা কমেছে, তবু অপরাধের প্রকৃত চিত্র এতে প্রতিফলিত হয় না, কারণ অনেক ভুক্তভোগী থানায় যান না বা মামলা করতে ভয় পান।
পুলিশের মনোবলে ভাঙন
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩২৯টি, যা আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি। অনেকেই মনে করছেন, ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অভ্যুত্থানের ঘটনায় পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছে।
সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা বলেন, “পরিস্থিতি কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। পুলিশের মনোবল ফিরে না এলে অপরাধ রোধ সম্ভব নয়।” তিনি আরও বলেন, “উচ্চপর্যায়ে স্বীকার করার মানসিকতা দরকার। গোপালগঞ্জের সংঘর্ষে গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল, কিন্তু কেউ দায় নিচ্ছে না।”
পরিসংখ্যানের বাইরে অপরাধ
২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত প্রতি ছয় মাসে খুনের গড় সংখ্যা ছিল ১,৬১৩টি। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে তা বেড়ে হয়েছে ১,৯৩৩টি। অপহরণের মামলাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে ছয় মাসেই হয়েছে ৫১৭টি।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের দেওয়া পরিসংখ্যানে শুধু রিপোর্ট হওয়া মামলাগুলোর হিসাব থাকে, যা প্রকৃত অপরাধচিত্র তুলে ধরে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, “ডেভিল হান্টে ৫ হাজার অপরাধী গ্রেফতার হওয়ার পরও অপরাধ কেন বাড়ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সমন্বয়হীনভাবে অভিযান চালালে ফলাফল আসবে না।”
সরকার ও পুলিশের আস্থা সংকট
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন, “আইনশৃঙ্খলার দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে।” কিন্তু বাস্তবচিত্র বলছে ভিন্ন কথা। দিনে-দুপুরে ছিনতাই, হত্যাকাণ্ড ও পুলিশকে ঘিরে জনআস্থার সংকট প্রমাণ করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, “জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে সরকারকে নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং রাজনৈতিক ইন্ধন দমন করতে হবে।”
নামমাত্র অভিযান, রাজনৈতিক প্রভাব, পুলিশের মনোবল ভাঙন এবং দায় স্বীকার না করার প্রবণতা মিলিয়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কেবল অপরাধের সংখ্যা নয়, সরকার ও পুলিশের বিশ্বাসযোগ্যতাও সংকটে পড়েছে।