বিশেষ প্রতিবেদক
আগামীকাল (৫ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত সমাবেশে ঘোষিত হতে যাচ্ছে বহু প্রতীক্ষিত ও আলোচিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। এটি পাঠ করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এই ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সচেতন নাগরিক সমাজেও ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, ঘোষণাপত্রের পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ও উন্মোচন করতে পারেন প্রধান উপদেষ্টা। ফলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের স্বৈরাচার পতন ও পালানোর বর্ষপূর্তির এই দিনে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ের দিকেই রয়েছে দেশের সকল মহলের দৃষ্টি।
বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি দল এই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচন প্রশ্নে সক্রিয় রয়েছে এবং জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
সংলাপ ও মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত : সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনার পর এবং কয়েক দফা চিঠিপত্র বিনিময়ের মাধ্যমে এই ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রস্তুত করে। দলগুলোকে সেই খসড়া পাঠিয়ে তাদের মতামত গ্রহণ করা হয়। সংশোধিত মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র প্রস্তুত হয়েছে বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল সূত্র।
বিএনপি ঘোষণাপত্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দফায় সংশোধনী প্রস্তাব দেয়, যা দলীয়ভাবে চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে পাঠানো হয়।
সংবিধানে সংযুক্তির বিষয়ে মতপার্থক্য : ঘোষণাপত্র সংবিধানের প্রস্তাবনা ও তফসিলে যুক্ত করার প্রস্তাব খসড়ায় থাকলেও এতে বিএনপি পূর্ণ সমর্থন দেয়নি। দলটি শুধুমাত্র সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি সন্নিবেশের পক্ষে মত দিয়েছে।
কী কী পরিবর্তন চেয়েছে বিএনপি? : সরকারের খসড়ায় ইতিহাস বর্ণনার অংশে উল্লেখ ছিল—
“এই ভূখণ্ডের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।”
বিএনপি এতে ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে’ শব্দগুচ্ছ যুক্ত করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এ বিষয়ে বলেন, “জাতির সূচনা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকেই। কিন্তু খসড়ায় তা যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়নি। আমরা তা সংশোধন করে পাঠিয়েছি।”
একইভাবে সরকারের খসড়ার ৪র্থ দফায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাকশাল প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও, বিএনপি সেখানে নামটি বাদ দিয়ে শুধু ‘একদলীয় শাসনব্যবস্থা’ উল্লেখ করেছে এবং ১৯৭৯ সালের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের বিষয়টি যুক্ত করেছে।
৮ম দফায় পিলখানা ট্র্যাজেডি ও শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ থাকলেও, বিএনপি তাদের সংস্করণে এ দুটি বিষয় বর্জন করেছে।
১৭তম দফায় গণ–অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা সরকার ‘প্রায় দুই সহস্র’ উল্লেখ করলেও, বিএনপি তা ‘দুই সহস্রাধিক’ হিসেবে লিখেছে। ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিষয়ে কিছু বক্তব্যও বিএনপির সংস্করণে বাদ দেওয়া হয়।
সরকারের খসড়ার ১৯তম দফায় বলা হয়েছে— “ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করে এবং তাঁর মন্ত্রিসভা ও অন্যান্য সাংসদদের নিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন।”
বিএনপি এই অংশে শুধুমাত্র শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের বিষয়টি রেখেছে, তাঁর মন্ত্রিপরিষদ বা স্পিকারের কথা বাদ দিয়েছে।
‘সংবিধানে স্বীকৃতি না পেলে ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে’ সালাহউদ্দিন আহমদ জানান,
“আমরা চাই জুলাই ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক এবং তা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করা হোক। কেননা এ সরকারের ভিত্তি ওই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই গঠিত হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “ঘোষণাপত্রে যদি কোনো অসামঞ্জস্য থাকে, আমরা তখন প্রতিক্রিয়া জানাব।”
ঘোষণাপত্রের পেছনের প্রেক্ষাপট : জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবি আসে প্রথমবার ২০২৪ সালের শেষ দিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে। এরপর ফেব্রুয়ারিতে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একে কেন্দ্র করে সক্রিয় প্রচারণা চালায়। দুই দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েও সরকার ঘোষণা দিতে পারেনি। অবশেষে বর্ষপূর্তির দিনেই সেটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘোষণাপত্র মূলত জুলাই অভ্যুত্থানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দলিল, যা ভবিষ্যতে সংবিধানে যুক্ত হতে পারে। এর মাধ্যমে আন্দোলনের আইনি বৈধতা প্রতিষ্ঠা পাবে এবং এর অংশগ্রহণকারীদের ভবিষ্যতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ থেকে রক্ষা করা যাবে।