রিজওয়ান-উল-আলম
উত্তরার আকাশে কালো ধোঁয়া। আতঙ্কিত মানুষের চিৎকার, প্রাণপণ উদ্ধার চেষ্টা আর শোকাহত পরিবারগুলোর বুকফাটা কান্না—এই দৃশ্য সোমবারের ট্র্যাজেডিকে জাতীয় শোকের রূপ দেয়। একটি প্রশিক্ষণ বিমান স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হলে মুহূর্তেই থমকে যায় চারপাশ। কিন্তু দুঃসময়ে থেমে থাকলে চলে না—তৎপর হতে হয়, তথ্য দিতে হয়, সহানুভূতির সঙ্গে দায়িত্ব নিতে হয়। অথচ, এই দুর্ঘটনায় আবারও স্পষ্ট হলো—সংকট মোকাবিলায় আমরা কতটা অপ্রস্তুত, কতটা পেছনে পড়ে আছি।
ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিভ্রান্তিকর তথ্য, বানোয়াট গল্প আর বিভৎস ছবি। কেউ বলল ‘পাইলট আত্মহত্যা করেছে’, কেউ বলল ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’, আবার কারও পোস্টে দেখা গেল মৃত শিশুদের রক্তাক্ত মুখ। এমনকি কিছু টিকটক-ইউটিউবার ঘটনাস্থলকে পরিণত করল কন্টেন্ট তৈরির মঞ্চে—বেদনার ছবিকে ভাইরাল করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। আর এভাবে, শোকের মুহূর্তও হয়ে উঠল ‘ভিউ’ আর ‘রিচ’-এর খেলার ময়দান।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সরকারি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সময়মতো নির্ভরযোগ্য তথ্য না আসায় গুজবের বিস্তার সহজ হয়েছে। যখন নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না, তখন মানুষের মধ্যে ভর করে ভয়, সন্দেহ আর আবেগ। অথচ এই যুগে, যেখানে একটি এক্স (টুইট) পোস্ট মুহূর্তেই লাখো মানুষের মাঝে পৌঁছে যায়, সেখানে আমাদের এখনো সংকট মোকাবিলায় আগের যুগের ধ্যান-ধারণা থেকে বের হতে পারিনি।
এই ব্যর্থতা শুধু সরকারের নয়, আমাদের সবার। সংবাদমাধ্যমগুলোও অনেক ক্ষেত্রে যাচাই না করেই ‘এক্সক্লুসিভ’ তাড়নায় বিভ্রান্তিকর খবর ছড়িয়েছে। শোকাহত পরিবারের বাড়ি থেকে সরাসরি সম্প্রচার, অনুমাননির্ভর রিপোর্ট আর বিপরীতধর্মী তথ্য পরিবেশন শুধু জনমনে বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে।
এরপর প্রশ্ন ওঠে—তাহলে আমরা কী করব?
আমাদের প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে একটি কৌশলগত যোগাযোগ ব্যবস্থা (Strategic Communication Framework)। এমন একটি ইউনিট, যারা যেকোনো দুর্যোগের সময় দ্রুত, স্পষ্ট এবং মানবিক উপায়ে তথ্য জানাবে। একটি লাইভ তথ্য বোর্ড থাকবে, যেখানে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় নিয়মিত আপডেট দেওয়া হবে। প্রশিক্ষিত মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ে গুজব বন্ধে তৎপরতা চালানো হবে।
শুধু সরকার নয়, নাগরিকরাও এই দায়িত্ব থেকে মুক্ত নয়। আমাদের প্রত্যেকের উচিত—শেয়ার করার আগে ভাবা:
* এটি কি সত্য?
* এটি কি কাউকে সাহায্য করবে?
* এটি কারও সম্মান ক্ষুণ্ন করছে কি না?
* যদি এই ছবি আমার পরিবারকে ঘিরে হতো, আমি কি এটি শেয়ার করতাম?
যা ঘটেছে, তা আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি না। কিন্তু আমাদের প্রতিক্রিয়ায় ভবিষ্যতের দিক নির্ধারিত হয়।
এখন সময়, আমরা যেন—
- স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্রে ডিজিটাল নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা শেখাই
- সাংবাদিকদের গুজব নিরসন ও ট্র্যাজেডি কাভার করার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিই
- শিশুদের ছবি ব্যবহারে ইউনিসেফের নীতিমালা মেনে চলি
- আবাসিক এলাকায় বিমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ঝুঁকি পুনর্মূল্যায়ন করি
- সাধারণ মানুষকে দুর্যোগকালীন সঠিক আচরণ শেখাই
আমরা চাই না, আবারও এমন ট্র্যাজেডি আমাদের বিপর্যস্ত করুক। চাই, যেন ভবিষ্যতে প্রতিটি বিপদের সময় আমরা একসঙ্গে, দায়িত্বশীলভাবে এবং সহানুভূতির সঙ্গে এগিয়ে আসতে পারি।
এই লেখাটি কোনো অভিযোগ নয়। এটি একটি জাতীয় অনুরোধ—যেন শোককে সচেতনতায় রূপান্তর করা যায়, বিশৃঙ্খল প্রতিক্রিয়াকে পরিণত করা যায় সংগঠিত প্রস্তুতিতে। একটি জাতিকে তার দুর্ঘটনা নয়, বরং সেই দুর্ঘটনায় তার প্রতিক্রিয়া চেনায়।
চলুন, সম্মান, সংহতি ও সত্য—এই তিনের ভিত্তিতে গড়ে তুলি আমাদের ডিজিটাল ও নাগরিক আচরণের নতুন মানদণ্ড। যেন আমাদের আকাশ আর না কাঁপে, আর কোনো অজানা সাইরেনের শব্দে।