নীরবে-সরবে কত রকম বাণী শ্রবণ করে এসেছেন মাহবুব আলম, সব মনে পড়ে না এখন। শৈশবের প্রথম বাণীটা মনের পর্দায় ঘাই মারে— ‘সদা সত্য কথা বলিবে’। অথচ বাণীটা হওয়া দরকার ছিল ‘সদা মিথ্যা বলিব’। ছোটবেলা থেকে যে মিথ্যা বলা শুরু করে মানুষ, শেষ বয়সে এসেও ছাড়তে পারে না। এর মধ্যে প্রাত্যহিক মিথ্যাটা হচ্ছে— কুশল বিনিময় সময়ে বলা ‘ভালো আছি’! আদতেই কি ভালো থাকতে পারছে মানুষ? ভালো থাকলে সর্বৈব মিথ্যাচর্চা হতো না; নতুন বাণীও আসত না ক্ষণে ক্ষণে। সত্য বলা যে বিপজ্জনক শৈশবের একটি ঘটনা থেকেই স্পষ্ট মাহবুব আলমের কাছে। স্কুলের সবচেয়ে বদরাগি হেমায়েত স্যার শ্রেণিকক্ষে দাঁড় করালেন তাকে— ‘গতকাল আসিসনি কেন?’
দ্বিধাহীন চিত্তে মাহবুব বললেন, ‘পরশু রাতে যাত্রাপালা দেখতে গিয়েছিলাম, স্যার। কাল সকালে তাই ঘুম থেকে উঠতে পারিনি।’
‘তোর বাপে দেখেছে কোনোদিন ওইসব যাত্রা-ফাত্রা?’
‘দেখেছেন স্যার। রহিম বাদশা রূপবান কন্যা। আব্বা প্রতি মাসে যাত্রাবাড়ি যান। ওখানে চাচার বাড়ি।’
সত্য বলার অপরাধে স্যার মাহবুবের পিঠে আস্ত একটা বেত ভাঙলেন। তাতেও রাগ থামেনি; গজরাতে গজরাতে বললেন, ‘হাঁদারাম মুখে মুখে তর্কও করে!’
মাহবুব বুঝে গেলেন সব সময় সত্য বলতে নেই। সত্যচর্চায় পিঠের ছাল থাকে না; হাঁদারাম উপাধি পেতে হয়। তারপর কত অসত্য কত জায়গায় বলেছেন— ইয়ত্তা নেই। মানুষের বয়স যত বাড়ে, মিথ্যাচর্চাও বাড়ে পাল্লা দিয়ে। চিরন্তনী বাণীচর্চাও। পত্রপত্রিকায় বাণী, লোকাল বাসে বাণী, দোকানদারের র্যাকে বাণী, চোরের মুখে সাধুর বাণী, ঘরোয়া বাণী— ফুরোনোর নয়। কোনো কোনো বাণীর অর্থ খুঁজে পান না মাহবুব। সেদিন অফিস থেকে ফিরতি পথে চোখে পড়ল একটি বাড়ির সামনে লেখা— ‘আপনার পরিচয় দিন’। তিনি বাড়ির ভেতরে ঢুকলে জিজ্ঞাসু এগিয়ে এল নিরাপত্তারক্ষী— ‘কাকে চান?’
‘আমি মাহবুব আলম, বদরে হাসান সিকিউরিটিজে চাকরি করি। গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর পলাশে…।’
নিরাপত্তারক্ষী থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কার কাছে এসেছেন?’
‘কারও কাছে আসিনি।’
‘তাহলে?’
‘সাইনবোর্ডে লিখে পরিচয় জানতে চেয়েছেন আপনারা!’
‘সবার পরিচয় লাগে না। আপনি যান।’
‘যাচ্ছি। আপনাদের কুকুরটা কই?’
‘কোন কুকুর?’
‘সামনেই তো লেখা আছে— কুকুর হইতে সাবধান। আমি সাবধানেই আছি। কুকুরটাকেও বলে যাই, সাবধানে থাকতে। দিনকাল ভালো না। রাতকাল আরও খারাপ!’
নিরাপত্তারক্ষী হাসল এবার— ‘এই বাড়িতে কুকুর-বেড়াল কিছু নেই, ভয় দেখানোর জন্যই লেখা হয়েছে।’
‘ও, আচ্ছা! ওখানে যে লেখা— অতিথির গাড়ি বাইরে রাখুন। এটাও কি ভয় দেখানোর জন্য?’
‘না। এটা সত্য। যারা একসময় ডালে-ভাতে বাঙালি ছিল এদের অনেকেই এখন গাড়িতে-বাড়িতে বাঙালি। সুযোগ পেলেই অন্যদের নিজের গাড়িটা দেখাতে চায়। তাই সতর্কসঙ্কেত দিয়ে রাখতে হয়।’
এই কথার সূত্রে মাহবুব মনে করতে পারেন সকালের ঘটনা। ৬৭ নম্বর বাসে চড়ে প্রতিদিন অফিসে যান। আজকের বাসটাতে লেখা ছিল— ‘এই বাস সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আপনার সকল কর্মকাণ্ড রেকর্ড হচ্ছে।’
চলন্ত বাস কীভাবে, কেনইবা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন থাকে একজন যাত্রী পেঁচিয়ে ধরে প্রশ্ন করল। তখন ছোকরা কন্ডাক্টর বলতে বাধ্য হলো— ভাড়া নিয়ে যারা ক্যাচাল করে তাদের ভয় দেখানোর জন্যই এমন মিথ্যাচার! যাত্রী পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তোরা যে বাসের গায়ে বাণী লিখে রেখেছিস “রাজনৈতিক আলাপ নিষেধ”। তেল-গ্যাসের রাজনীতিটা তো নিজেরাই করছিস!’
কন্ডাক্টর জ্ঞানী জ্ঞানী গলায় বলল, ‘মাঝে মধ্যে রাজনীতি করা ভালো।’
‘ওই কোনায় লিখিয়েছিস “ব্যবহারে বংশের পরিচয়”। তোদের বংশ কী?’
‘আমরা মিয়া বংশ। আমার নাম আলাউদ্দিন মিয়া।’
‘যাত্রীরা কোন বংশের, হদিস পাইছস?’
‘সব যাত্রীই ভাড়া কম দেওন্যা বংশের!’
এমন কথায় অনেকেই তেড়ে এলে কন্ডাক্টর বাতচিত করল না আর। গাড়ি থেকে ভাড়ার চার্ট উধাও হয়ে গেলেও ‘তেলচালিত গাড়ি’ ঘোষণা এখনো চকচকে।
বাস থেকে নেমে কিছুটা পথ হেঁটে বাসায় যেতে হয়। এই বাড়িতে নিজের পরিচয় দিয়ে দেরি হলো অনেক। কথায় কথায় ভাব জমে গেলে নিরাপত্তারক্ষী সোলেমান হোসেন তাকে ফুটপাত থেকে চা কিনে এনে খাওয়াল।
মহল্লার স্থায়ী বাসিন্দা নেড়ি কুকুরটা বরাবরই চুপচাপ থাকে। আজ কী মনে করে বাণী দিল— ঘেউ ঘেউ ঘেউ…। এটার অনুবাদ হয়তো এমন— এখানে কী চাস?
মাহবুব বললেন, ‘হুদাই চিল্লাস ক্যান! কুকুর হইতে সাবধান আছি।’
আরেকটু এগিয়ে হোসেন উদ্দিনের দোকানের সামনে দাঁড়ালেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘হোসেন ভাই, আমি দেখেছি আপনার দোকানে স্টিকারে লেখা আছে “বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না”। এইদিকে আমি পাঁচ মাস যাবত বেতন পাই না। এখন আপনাকে লজ্জা দিতে চাই। কিছু চাল-ডাল লাগবে বাকিতে।’
হোসেন উদ্দিন বাক্যব্যয় করলেন না। অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন আরেকটা স্টিকার-বাণীতে— ‘আজ নগদ কাল বাকি’!
অপমানিত মাহবুব বললেন, ‘তাহলে কাল সকালে আসি?’
দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে দোকানদার বলল, ‘আগামীকাইল কি আপনের লাইগা নতুন স্টিকার আইব নিহি? লেখা তো এইডাই!’
এতক্ষণে রহস্যটা ধরতে পারলেন তিনি। শুভঙ্করের ফাঁকি, শেষ পর্যন্ত দেয় না বাকি!
সভয়ে বাসায় প্রবেশ করলেন মাহবুব। যা ভেবেছেন ঠিক তাই; রণচণ্ডিনী রূপে বসে আছে তার বউ রানি। খালি হাত দেখে প্রশ্ন করল, ‘আজও ভিক্ষুকের বেশে এসেছ!’
‘কী করব বউ, বেতন হচ্ছে না। কোম্পানির অবস্থা খারাপ!’
‘হাজার হাজার মানুষ বেতন পায়, ঘুষ পায় আর তুমি মাত্র বাইশ হাজার টাকা বাসায় আনতে পারো না! এত কম মুরোদ…!’
‘এই মাসে না পেলেও সামনের মাসে বেতন পাব। তখন তেলের দামও কমে যাবে!’
এবার রানি দিল পুরনো সেই বাণী— ‘আমি দেখেই তোমার সংসার করছি, অন্য কোনো মহিলা হলে কত আগেই লাত্থি মেরে চলে যেত!’
পেটে খেলে পিঠে সয়। কিন্তু মাহবুব পেটেও সয়ে যান, পিঠেও। তার সব কূলই অন্ধকার থইথই। এভাবে শাক-নুন খেয়ে আর কতদিন চালানো যায়! সাহস করে বসের রুমে ঢুকে গেলেন। দেখতে পেলেন সাঁটানো বাণী— ‘কাজকে ভালোবাসুন, বসকে নয়। অফিসকে ভালোবাসুন, অফিসারকে নয়।’ বাণীর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে না পারলেও মাথা ঘামালেন না। বিনয়ী গলায় বসকে বললেন, ‘স্যার, আমার সংসার চলছে না আর। বউ শুধু ঘ্যানঘ্যান করে!’
‘চিন্তা করবেন না। আগামীতে আমরা নতুন নিয়ম করব। এই অফিসে চাকরির সুযোগ পাবে কেবল অবিবাহিতরাই।’
‘সেটা করতেই পারেন। এখন যে আমরা মারা যাচ্ছি খেতে না পেয়ে!’
‘আপনি কি চান না লাখপতি হতে, কোটিপতি বনতে!’
‘সেটা কে না চায়!’
‘হিসাব করেন তো, আপনার পাঁচ মাসের বেতন কত টাকা হয়?’
‘এক লাখ দশ হাজার!’
‘তাহলে তো লাখপতি হয়েই গেছেন। এবার কোটিপতি হতে চান না?’
আনন্দে ঝলমল করে ওঠে মাহবুবের মুখ—‘চাই স্যার, অবশ্যই চাই। আমি কোটিপতি হলে বংশের মান-মর্যাদা বাড়বে।’
‘তাহলে বেতনের চিন্তা করবেন না। কাজের চিন্তা করেন বেশি। আপনার কোটিপতি হওয়া ঠেকায় কে!’
ভাবতে ভালো লাগছে মাহবুবের, নিজের অজান্তেই ইতোমধ্যে লাখপতি বনে গেছেন। এখন কোটিপতি হওয়ার অপেক্ষায়। সে পর্যন্ত তাকে আরও অনেক রসের বাণী, বশের বাণী, বেফাঁস বাণী সহ্য করে যেতে হবে; বউয়ের গালমন্দ শুনতে হবে। সবই সইবেন কিন্তু কোটিপতি অফার হাতছাড়া করবেন না মোটেও!
মিরপুর, ঢাকা থেকে
বাণী নিরন্তর : শফিক হাসান
31