ডাক্তার শাহরিয়ার যে ওয়ার্ডের রোগীদের দায়িত্বে আছে, সে ওয়ার্ডের এক রোগী তাকে দেখলেই ‘ব্যথা’ ‘ব্যথা’ বলে কঁকিয়ে ওঠে। অমনি শাহরিয়ার রোগীর কাছে হাজির হয়ে ব্যথার অবস্থা বুঝে হয় ডুস নয়তো ব্যথার ইনজেকশন দেওয়ার নির্দেশ দেয় নার্সকে। কিন্তু কীসে কী! শাহরিয়ারকে দেখলেই রোগী কঁকিয়ে ওঠে!
নার্স বলল, ‘স্যার, ওই রোগী আপনাকে দেখলেই ‘ব্যথা’ ‘ব্যথা’ বলে। শুধু তাই না, অন্য বিভাগের ডাক্তারদের দেখলেও অমন করে। কিন্তু এমনিতে তো পাশের বেডের রোগীর সঙ্গে গল্প করে!’
‘তাই নাকি!’
নার্সের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস হলো না শাহরিয়ারের। সে ভাবে— ব্যথা না থাকলে শুধু শুধু কি আর রোগী বলে! কিন্তু তিনদিন ধরে ব্যথার ইনজেকশন দেওয়ার পরেও ব্যথা কি মোটেও কমবে না?
আরেক রোগীর সমস্যার কথা শুনে ওয়ার্ডে এলো শাহরিয়ার। এসে মাত্র এক রোগীর সমস্যা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে, অমনি ওই রোগী ‘ব্যথা’ ‘ব্যথা’ করে পুরো ওয়ার্ড প্রায় মাথায় তোলার অবস্থা!
এই রোগী বলল, ‘স্যার, ও আপনাকে দেখলেই ওরকম করে।’
নার্সের কথার সঙ্গে এই রোগীর কথারও মিল পাওয়া গেল।
ডাক্তার শাহরিয়ার ভাবল— তার প্রফেসর যখন রাউন্ডে আসবেন, তখন এই রোগীর কথা বিশেষভাবে বলবে।
শাহরিয়ার আর কখন বলবে? প্রফেসর ওয়ার্ডে আসতেই ওই রোগী কাই-কুই করে উঠল। প্রফেসর সাহেবও অন্য রোগী দেখা বাদ দিয়ে সোজা এই রোগীর কাছে এলেন।
শাহরিয়ার বলল, ‘স্যার, এই রোগী সেই ভর্তির দিন থেকে ‘ব্যথা’ ‘ব্যথা’ করে আসছে। ব্যথার ইনজেকশন পাচ্ছে তবু তার ব্যথা কমছে না।’
‘দেখি তো কী ওষুধ পাচ্ছে।’
শাহরিয়ার নার্সের হাত থেকে ফাইল নিয়ে ওষুধের অর্ডার দেখাল প্রফেসর সাহেবকে।
প্রফেসর ওষুধের অর্ডার পড়ে একটুক্ষণ কী যেন ভাবলেন! তারপর রোগীর পেটে অপারেশনের জায়গা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে ব্যথা আছে।’
‘আছে ছার!’
প্রফেসর এবার রোগীর বুকে তর্জনী ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে ব্যথা আছে?’
‘হ, আছে ছার!’
তারপর একে একে পিঠ, ঘার, মাজা-কোমরসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ দেখিয়ে ব্যথার কথা জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর। শরীরের কোনো স্থানেই ব্যথা সম্পর্কে না বলল না রোগী।
প্রফেসর সাহেব ঠাট্টার সুরে বললেন, ‘বুঝলে হে শাহরিয়ার, তোমার এই রোগীর সর্বাঙ্গে ব্যথা!’
হয়তো কোনো জটিল সমস্যা— এই ভেবে কৌতূহলী চোখে প্রফেসরের মুখের দিকে তাকাল শাহরিয়ার। তার তাকানোর ধরন দেখে প্রফেসর বুঝলেন—শাহরিয়ার এখনো রোগীর সমস্যা আন্দাজ করতে পারেনি! তাই রহস্য মেশানো সুরে প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন—‘কী, এখনো বুঝলে না? সর্বাঙ্গে ব্যথার চিকিৎসা দিতে হবে।’
শাহরিয়ার ভাবল— প্রফেসরের কাছ থেকে এবার রোগীর সর্বাঙ্গে ব্যথার চিকিৎসা শিখে নেবে। এই ভেবে আনন্দ লাগছে তার—যাক, ভবিষ্যতে এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা সেও দিতে পারবে।
নার্সকে নির্দেশ দিলেন প্রফেসর— ‘নার্স, এক অ্যাম্পুল ডিডাব্লিউ আর একটা সিরিঞ্জ নিয়ে এসো।’
শাহরিয়ার অবাক চোখে প্রফেসরের দিকে তাকাল। প্রফেসর নার্সকে যা আনতে বললেন তা দিয়ে…
শাহরিয়ারের অবস্থা দেখে প্রফেসর মুচকি হাসলেন। তিনি দু’রকম মজা পাচ্ছেন—একদিকে ব্যথার রোগী, অন্যদিকে তরুণ চিকিৎসক শাহরিয়ারকে নিয়ে!
নার্স ডিডাব্লিউ আর সিরিঞ্জ নিয়ে এলো।
প্রফেসর সাহেব সবটুকু ডিডাব্লিউ সিরিঞ্জে নিয়ে রোগীর শিরায় পুশ করলেন।
পাঁচ মিনিট পর রোগীকে জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর— ‘কী, ব্যথা কমতে শুরু করেছে?’
‘হ, স্যার। কমতাছে।’ রোগীর বলার ঢংটা এমন, যেন তার এতদিনের ব্যথা এক নিমেষে দূর হয়েছে!
রাউন্ড শেষে ওয়ার্ড থেকে বেরোতে বেরোতে প্রফেসর বললেন, ‘তুমি এখনো ডিডাব্লিউর ঘোরে আছ, তাই না?’
শাহরিয়ার অকপটে স্বীকার করল—‘জি স্যার। স্রেফ ডিস্টিল ওয়াটার দিয়ে কীভাবে ব্যথা কমানো সম্ভব?’
‘আচ্ছা, আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমার কি মনে হয় ওই রোগীর আসলে ততটা ব্যথা ছিল?’
শাহরিয়ার চুপ করে রইল।
প্রফেসর বুঝলেন— শিষ্যকে যা বোঝানোর তাকেই বোঝাতে হবে। বললেন, ‘আসলে ডাক্তার দেখলেই অনেকের রোগ বেড়ে যায়। ওই রোগীর অবস্থা আসলে তেমন। তাই রোগীকে আইওয়াশ স্বরূপ শিরায় ডিডাব্লিউ থেরাপি দিলাম। রোগী ভাবল— তাকে ব্যথা নিবারণের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আসলে তো দেওয়া হয়েছে জীবাণুমুক্ত জল! দেখো ও আর ব্যথার কথা বলবে না! এটা এক ধরনের সাইকোথেরাপিও।’
রোগীর অবস্থা, নার্সের কথা, পাশের বেডের রোগী এবং সবশেষে প্রফেসরের কথা মেলাল শাহরিয়ার। শেষে রোগীর অবস্থা আর ডিডাব্লিউ থেরাপির কথা ভেবে তার বেশ হাসি পেল।
ডিডাব্লিউ থেরাপি :: শাহনেওয়াজ চৌধুরী
69