পূর্ব লন্ডনের ব্যস্ত রাস্তায় নিরীহ দেখতে কিছু দোকান—যেগুলোর পাশে হয়তো মানি ট্রান্সফার শপ, কিংবা ভিক্টোরিয়ান যুগের পুরনো কোনো বাড়ি। এসব দোকান কিংবা বাড়ির দরজা খুললেই চোখে পড়ে এক ভিন্ন জগৎ—যেখানে ভেসে আসে গোলাপি সালফারের হালকা গন্ধ, শোনা যায় মৃদু সুরের সংগীত। ভেতরে নারীরা নিপুণ হাতে তৈরি করছেন জটিল নকশার বোনা চুল—এক শিল্প যা যতটা নান্দনিক, ততটাই রাজনৈতিক।
এই দৃশ্যটি কেবল বিউটি পার্লারের নয়। এটি একটি নেটওয়ার্ক, একটি আশ্রয়, এমনকি অনেক নারীর জন্য এক প্রকার আত্মরক্ষার ঘর। ফিনানশিয়াল টাইমসের (FT) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই ছোট ছোট চুলের সেলুনগুলোর সম্মিলিত বাজারমূল্য ২০২৩ সালে ছাড়িয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলার—অর্থাৎ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০৩৩ সালের মধ্যে এই বাজার ১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। তবে বাস্তব পরিসংখ্যান সম্ভবত আরও বড়। যেমন যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটির নারী জনসংখ্যার মাত্র ৪.২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ হলেও, তারা হেয়ার কেয়ারে ব্যয় করেন মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশেরও বেশি।
সমাজের চাপে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা
এই ব্যয়ের পেছনে শুধু রূপচর্চা নয়, রয়েছে সাংস্কৃতিক চাপ ও আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত নারীদের জন্য চুল শুধুই চুল নয়—এটি আত্মমর্যাদা, পেশাগত স্বীকৃতি ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার প্রতীক।
বহু বছর ধরে আফ্রো-ধাঁচের প্রাকৃতিক চুলকে ‘অপেশাদার’, ‘অগোছালো’ বা ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মনে করা হয়েছে। বিদ্যালয় হোক বা কর্মক্ষেত্র—চুলের ধরন হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈষম্যের নীরব অস্ত্র। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করছে “দ্য হ্যালো কালেকটিভ” নামে একটি সংস্থা। এর সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টেফানি কোহেন বলেন, “অনেকেই বুঝতে পারেন না, এই চুল-বৈষম্য আসলে কাঠামোগত বিদ্বেষেরই অংশ।”
এক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের করপোরেট সংস্কৃতিতে প্রাকৃতিক চুলের স্টাইলকে কম গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। এমনকি, যদি কোনো কৃষ্ণাঙ্গ নারী চুল সোজা করেন, তবে তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ২০% পর্যন্ত বেড়ে যায়।
বিলাসিতা, সেবা, ও চুলের অধিকার
এই বাস্তবতায় গড়ে উঠেছে এক নতুন ইকোসিস্টেম—যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের জন্য চুলের সেলুন কেবল রূপচর্চার কেন্দ্র নয়, বরং আত্মবিশ্বাস, পরিচয় এবং সম্মানের ক্ষেত্র।
লন্ডনে জন্ম নেওয়া, বর্তমানে লস অ্যাঞ্জেলেসে কর্মরত হেয়ার স্টাইলিস্ট ভারনন ফ্রঁসোয়া বলেন, “লন্ডনে খুব কম হেয়ারড্রেসারই আছে, যারা আফ্রিকান ধাঁচের চুলকে সত্যিকারের বিলাসবহুল স্পেসে সেবা দিতে পারে। আমি চেয়েছি সেই শূন্যতা পূরণ করতে।”
তার মতোই কথা বলেন চার্লট মেনসাহ—ব্রিটিশ-ঘানাইয়ান হেয়ারস্টাইলিস্ট, যিনি ব্রিটিশ হেয়ারড্রেসিং অ্যাওয়ার্ডসের হল অব ফেমে জায়গা পাওয়া প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী। তার ভাষায়, “কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা শুধু কার্যকরী ফর্মুলা নয়, চাইতেন সম্মান, আভিজাত্য এবং সৌন্দর্যের স্বীকৃতি।”
আজ বিলাসবহুল আফ্রো হেয়ার প্রডাক্ট বড় বড় দোকানে আসছে, ক্রেতারা খুঁজছেন প্রিমিয়াম গন্ধ, আধুনিক প্যাকেজিং, এবং কার্যকর উপাদান। তাতে বদলাচ্ছে বাজারের চিত্র—তবে পুরোপুরি নয়।
বড় কোম্পানি বনাম ব্যক্তিগত যত্ন
বুক্লেম নামে কার্লি হেয়ার প্রডাক্ট কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মিশেল স্কট-লিঞ্চ বলেন, “কালো চুলের ব্যবসা অনেক দূর এগিয়েছে, কিন্তু এখনও অনেক পথ বাকি।” তার আশঙ্কা—যখন এই ব্র্যান্ডগুলো করপোরেট জায়ান্টদের হাতে চলে যায়, তখন ব্যক্তিগত যত্নের সেই স্পর্শ কি টিকে থাকে?