শনিবার, ২০২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কারুর জেলায় ঘটে যায় এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। জনপ্রিয় তামিল অভিনেতা ও সদ্য রাজনীতিতে আসা বিজয় থালাপতির রাজনৈতিক সমাবেশে অংশ নিতে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। সকাল থেকেই মানুষ আসতে শুরু করে, আর সময় যত গড়িয়েছে, ভিড় তত বেড়েছে। বিজয় থালাপতির একনজর দেখার আশায় গ্রামের পর গ্রাম থেকে মানুষ হেঁটে, গাড়িতে, বাসে করে সমাবেশস্থলে এসে হাজির হয়েছিলেন।
স্থানীয় বাসিন্দা দুর্গাদেবী, যিনি সেই ভিড়ের মধ্যেই ছিলেন, জানিয়েছেন যে সকাল থেকে যারা সমাবেশস্থলে ঢুকেছিল, কেউ আর বের হতে পারেনি। দোকানপাট ও খাবারের জায়গা বন্ধ থাকায়, মানুষ পানির অভাবে কষ্ট পেয়েছে। অনেকেই প্রচণ্ড গরম ও বিশৃঙ্খল পরিবেশে অসুস্থ হয়ে পড়েন, বিশেষ করে শিশুরা ও বৃদ্ধরা। দুর্গাদেবী বলেন, তিনি নিজ চোখে দেখেছেন ছোট ছোট বাচ্চারা গরম ও ভিড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তিনি নিজেও ভিড়ে আটকে পড়েছিলেন এবং অল্প কয়েকজন তরুণের সহায়তায় পাশের একটি ভবনের ওপর দিয়ে উঠে কোনোমতে বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে অব্যবস্থাপনার চিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে লক্ষী নামে আরেক প্রত্যক্ষদর্শীর কথায়। তিনি জানান, শুরুতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সময়ের সাথে সাথে ভিড় এমন মাত্রায় পৌঁছায় যে কেউই আর পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। ভেতরে ঢুকে পড়া মানুষ আর বের হতে পারছিল না, আর বিজয় থালাপতির আগমনের অপেক্ষায় সবাই ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলেন। বিজয় যেহেতু নির্ধারিত সময় দুপুর ১২টায় না এসে সন্ধ্যায় পৌঁছান, ততক্ষণে মানুষের ধৈর্য ও নিরাপত্তা—দুটোই ভেঙে পড়ে। বিজয় মঞ্চে উঠতেই হাজার হাজার মানুষ একসাথে সামনে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে। ঠিক তখনই ঘটে ভয়াবহ পদদলনের ঘটনা।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৯ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে রাজ্য সরকার। বহু মানুষ এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গর্ভবতী নারী, শিশু, বৃদ্ধ—সবাই এই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। আনন্দকুমার নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা প্রশ্ন তোলেন, কীভাবে এত অনিরাপদ পরিবেশে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের সমাবেশে আনা হয়েছিল?
এ ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে বিজয় থালাপতির দল তামিলাগা ভেট্ট্রি কাজাগাম (টিএমকে)-এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে তারা পুলিশের দেওয়া শর্ত ও সময়সীমা লঙ্ঘন করেছে। বিজয়ের অনুমতি ছিল দুপুর সাড়ে তিনটা পর্যন্ত, কিন্তু তিনি সন্ধ্যায় এসে ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়া শুরু করেন। ডিএমকে পার্টির মুখপাত্র টিএমকের অব্যবস্থাপনাকে এই বিপর্যয়ের জন্য সরাসরি দায়ী করেছেন।
তবে, এখনই বিজয় থালাপতিকে গ্রেফতারের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন জানিয়েছেন, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। একইসাথে তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে, কাউকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়রানি করা হবে না।
নিহতদের পরিবারকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ রুপি এবং আহতদের ১ লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। বিজয় থালাপতি নিজেও সামাজিক মাধ্যমে শোক প্রকাশ করে নিহতদের পরিবারকে ২০ লাখ এবং আহতদের ২ লাখ রুপি করে সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বিজয় থালাপতির জনপ্রিয়তা তামিলনাড়ুতে নতুন কিছু নয়। তিনি শুধু একজন অভিনেতাই নন, বরং ভক্তদের কাছে একপ্রকার ‘নায়কতুল্য’ মানুষ। তার রাজনৈতিক দল গঠন এবং অভিনয় ছাড়ার ঘোষণার পর থেকেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে ভক্তদের মাঝে নতুন আগ্রহ তৈরি করেন। তবে এই মর্মান্তিক ঘটনায় সেই জনপ্রিয়তা কতটা প্রভাবিত হবে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। আপাতত রাজ্যজুড়ে শোক ও ক্ষোভ একসাথে বিরাজ করছে।