নিজস্ব প্রতিবেদন
২১ জুলাইয়ের দুপুরে উত্তরার দিয়াবাড়ির আকাশে হঠাৎ ছুটে আসা গর্জন থামিয়ে দিয়েছিল সবকিছু—আলোর ঝলক, বিকট বিস্ফোরণ, ধোঁয়ার কুন্ডলি আর তারপর নিস্তব্ধতা। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংলগ্ন এলাকায়। মুহূর্তেই আগুনে ঝলসে গিয়েছিল মানুষের শরীর, পুড়েছিল ভবন, গলেছিল স্বপ্ন। প্রাণ হারিয়েছিল অন্তত ৩৪ জন, যাদের মধ্যে ছিল শিশুও।
আজ, ১৫ দিন পর, ৬ আগস্ট বুধবার, সেই মাইলস্টোন কলেজের শ্রেণিকক্ষে আবারও বই খুলেছে শিক্ষার্থীরা। ইউনিফর্ম পরে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, চোখে আশঙ্কা আর মনে একরাশ শূন্যতা নিয়ে তারা ফিরে এসেছে সেই প্রিয় ক্যাম্পাসে—যেখানে কিছুদিন আগেও আগুনের হলকা আর মানুষের কান্না ভেসে এসেছিল।
শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসা, যেন ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবনের আর্তি : সকাল সাড়ে আটটা। মাইলস্টোন কলেজের ফটক দিয়ে প্রবেশ করছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। বাইরের হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ের ছায়া। অনেকের চোখে কালি, নিদ্রাহীন রাতের সাক্ষ্য দেয়।
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিহা বলছিল, “যখন সেই দিন প্লেনটা পড়েছিল, আমি আমাদের ভবনের বারান্দা থেকে দেখেছিলাম। আগুনের মধ্যে মানুষ ছুটছিল। আজ ক্লাসে এসেছি, কিন্তু সবকিছু অন্যরকম লাগছে।”
ক্লাস চলছে, কিন্তু মন ফিরছে না : যদিও পাঠদান শুরু হয়েছে, তবু শিক্ষকরা জানেন—এই শ্রেণিকক্ষে এখনো বইয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে মন। ক্লাসরুমে হয়তো গণিত, পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের চোখ দেখেই বুঝতে পারছেন—তারা এখনো ২১ জুলাইয়ের সেই দুপুরে আটকে আছে।
কলেজের গণিত শিক্ষক মোহাম্মদ আখতার বলেন, “শুধু ছাত্ররা নয়, আমরাও স্বাভাবিক হতে পারিনি। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে হঠাৎই মনের মধ্যে দৃশ্যগুলো ঘুরে ফিরে আসে।”
স্মৃতিচারণ, দোয়া ও কান্না: শিক্ষার্থীদের প্রথম ফিরে আসা : এর আগে ৪ আগস্ট রোববার শিক্ষার্থীরা প্রথমবার ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছিল। সেদিন ক্লাস হয়নি, হয়েছিল শোক ও দোয়ার আয়োজন। নিহতদের আত্মার মাগফিরাত এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে পাঠানো হয়েছিল হাজারো প্রার্থনা।
দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাবির বলছিল, “সেদিন শুধু দোয়া করিনি, কেঁদেছি। আমাদের এক ক্লাসমেটও আহত হয়েছিল। এখনও হাসপাতালে।”
কাউন্সেলিং সেন্টার: ট্রমার অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার চেষ্টা : মাইলস্টোন কলেজ কর্তৃপক্ষ সময় নষ্ট করেনি। ক্যাম্পাসেই স্থাপন করা হয়েছে একটি কাউন্সেলিং সেন্টার, যেখানে মনোবিজ্ঞানীরা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মানসিকভাবে সুস্থ করে তোলার কাজ করছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল জানান, “ছাত্ররা কেউ কেউ রাতে ঘুমাতে পারে না। কোনো শব্দে আঁতকে ওঠে। কাউন্সেলিং-এ তাদের ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টা চলছে।”
কাউন্সেলিং নিচ্ছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরাও। কারণ শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, অনেক শিক্ষকও সেইদিনের বিভীষিকার সাক্ষী ছিলেন। কিছু অভিভাবক এখনো সন্তানকে ক্যাম্পাসে পাঠাতে ভয় পান।
জীবন থেমে থাকে না, ফিরে আসতে হয়। একজন শিক্ষিকার ভাষায়— “যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে ঠিক, কিন্তু আমরা চাচ্ছি আমাদের ভবিষ্যত যেন বিধ্বস্ত না হয়।”
মাইলস্টোনের দেয়াল এখনো বয়ে বেড়ায় সেই আগুনের আঁচ, জানালাগুলো এখনো শীতল হয়নি। কিন্তু তারপরও শিক্ষার্থীরা ক্লাসে এসেছে। তাদের আসা মানে শুধু ক্লাসে ফেরা নয়, বরং জীবনের কাছে ফিরে আসা।
এই ফিরে আসা আমাদের শেখায়—জীবন যতই আঘাত করুক, তাকে জয় করে আবারও দাঁড়াতে হয়।