নিশ্ছিদ্র নজরদারি, ফাঁস হওয়া ফোনালাপ ও বিদায়
দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী কোটা সংস্কার আন্দোলন যেভাবে রূপ নেয় ‘পদত্যাগের আন্দোলনে’, সেই উত্তাল সময়ের পর্দার অন্তরালের ঘটনা প্রকাশ্যে এনেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। ‘আলজাজিরা ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট’-এর (আই-ইউনিট) ৫০ মিনিটের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একাধিক ফোনালাপ, যা তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিল বলে দাবি করছে আলজাজিরা। এসব ফোনালাপের ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে প্রমাণিত হয়েছে, সেগুলো এআই-জেনারেটেড নয় বরং আসল এবং রেকর্ডকৃত।
ঘুমহীন রাত, শঙ্কিত নেতৃত্ব
২০২৪ সালের জুলাইয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন ঢেউ তুলেছিল দেশের শিক্ষাঙ্গনে, তখনই আলজাজিরার তথ্য মতে, ঘুমাতে পারছিলেন না তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি বলেন, “সেদিন সারারাতই জাগা, কালকেও তো… দক্ষিণে আমি বলে দিয়েছি, যখন যা দরকার তাই করতে।”
এই বক্তব্য থেকে উঠে আসে সরকারের মধ্যে বিরাজমান আতঙ্ক, বিভ্রান্তি ও দমননীতি ব্যবহারের প্রস্তুতির ইঙ্গিত।
“প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করো”—ঘোষণা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর
জাতীয় টেলিযোগাযোগ নজরদারি কেন্দ্র (NTMC) কর্তৃক রেকর্ডকৃত একটি ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, “আমি সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ্যে আদেশ দিয়েছি। এখন তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে, যেখানেই পাবে গুলি চালাবে।”
এই ভয়ংকর নির্দেশনার ফলে দেশজুড়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর শুরু হয় দমন-পীড়নের নতুন মাত্রা। প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, নিরাপত্তা বাহিনী হেলিকপ্টার থেকেও গুলি চালিয়েছে।
চিকিৎসকের চোখে বিভীষিকা
পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. শাবির শরীফ বলেন, “আমরা এমন অনেক ছাত্র পেয়েছি যাদের শরীরে গুলি ঢুকে থেকে গেছে। এক্স-রে করে হতবাক হয়েছিলাম। এগুলো কোনো সাধারণ গুলির ক্ষত নয়।”
“আমি জানি, রেকর্ড হচ্ছে”—অহংকারী আত্মবিশ্বাস?
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, শেখ হাসিনা নিজেই জানতেন যে তার কথোপকথন নজরদারির আওতায় রয়েছে। তবু তিনি কোনো সংবেদনশীল বিষয়েও ফোনে আলোচনা করতে পিছপা হতেন না। তার বক্তব্য ছিল, “আমি জানি, রেকর্ড হচ্ছে, কোনো সমস্যা নেই।”
একনায়কতন্ত্রের পতন: রক্ত, মৃত্যু আর নির্বাসন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তথ্যমতে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে গুলি ও সহিংসতায় নিহত হয় প্রায় ১,৪০০ জন, আহত হন ২০,০০০-এরও বেশি। এই রক্তক্ষয়ের পর, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন ও ভারত পালিয়ে যান।
আইসিটি ইতোমধ্যে শেখ হাসিনা, তার ঘনিষ্ঠ দুই কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করেছে। আগস্ট ২০২৫-এ শুরু হতে যাচ্ছে এই ঐতিহাসিক বিচার।
“নিজ হাতে গর্ত খুঁড়েছিলেন, আজ নিজেই তাতে পতিত”
প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলছেন, “তিনি (হাসিনা) অন্যদের জন্য গভীর গর্ত খুঁড়েছিলেন। এখন সেই গর্তে তিনি নিজেই পড়ে গেছেন।”