বিশেষ প্রতিবেদক
বাংলা একাডেমির সাম্প্রতিক প্রকাশনা ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কবিতা’ সংকলনকে ঘিরে সাহিত্যাঙ্গনে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই সংকলনে জুলাইয়ের চেতনা বিরোধী কবিদের স্থান দেওয়ার অভিযোগে ২৪ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় বাংলা একাডেমির সামনে ‘জুলাইয়ের কবি-সাহিত্যিকগণ’ এর ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদসভা ও কবিতা পাঠ কর্মসূচি।
প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী কবি-সাহিত্যিকদের অভিযোগ, এই সংকলনের মাধ্যমে বাংলা একাডেমি এক ধরনের ‘সাহিত্যিক পক্ষপাতিত্ব’ ও ‘চেতনার বিকৃতি’র আশ্রয় নিয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ও জুলাই চেতনায় সক্রিয় কবিদের বঞ্চিত করে এমন কিছু কবিকে জায়গা দেওয়া হয়েছে যারা অতীতে ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন বা নীরব ছিলেন।
প্রতিবাদ সভার বক্তব্য ও দাবি
সভায় কবিরা বলেন, “চব্বিশে জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসকের পতনের পর আমরা আশা করেছিলাম ফ্যাসিবাদ চিরতরে নির্মূল হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যারা ফ্যাসিবাদকে রক্ষা করেছে, যারা তার পক্ষে সাহিত্যিক বয়ান তৈরি করেছে—তাদেরই এখন বাংলা একাডেমি স্বীকৃতি দিচ্ছে। এটি শুধু দুঃখজনক নয়, জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও বটে।”
তারা বাংলা একাডেমিকে ‘ফ্যাসিবাদমুক্ত’ করতে এবং প্রতিষ্ঠানটিকে প্রকৃত জাতীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ৯ দফা দাবি পেশ করেন মহাপরিচালকের কাছে। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
- সংকলনে জুলাইবিরোধীদের অন্তর্ভুক্তির সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি
- সংকলন প্রত্যাহার করে নতুনভাবে সম্পাদনার আহ্বান
- বাংলা একাডেমির সকল কার্যক্রমে দলনিরপেক্ষতা ও বৈষম্যহীনতা নিশ্চিত
- সাহিত্যকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করার উদ্যোগ
- তরুণ লেখক প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
- আমলাতন্ত্রমুক্ত সংস্কার কমিশন গঠন
- বাংলা একাডেমিকে শতভাগ বাংলাদেশপন্থী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তর
উপস্থিত বিশিষ্টজন ও সংগঠনের অংশগ্রহণ
এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি শান্তা মারিয়া, এবিএম সোহেল রশিদ, মাহবুব মুকুল, তাসনিম মাহমুদ, এমদাদুল হক চৌধুরী, তাজ ইসলাম, মামুন সারওয়ার, আমিনুল ইসলাম মামুন, হাসনাইন ইকবাল, কবি ফাহিম, এবি জুবায়ের, ইবরাহিম নিরব, নোমান সাদিক, লোকমান হোসেন জীবন, আরিফ সবুজ, তাহমিনা বিনতে নূরসহ অনেকেই।
সংকলন নিয়ে বিতর্ক ও বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতিক্রিয়া
২৩ জুলাই সংকলনের সূচিপত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই শুরু হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। সাহিত্যিক ও পাঠকমহল অভিযোগ তোলে—এটি ‘জুলাই বিপ্লবের চেতনা’-কে অবমাননা করেছে।
জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন বলেন, “বাংলা একাডেমি জনগণের টাকায় পরিচালিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। পক্ষপাতদুষ্টভাবে এমন সংকলন প্রকাশ করা চরম দুঃখজনক।”
জাতীয়তাবাদী লেখক ফোরামের সভাপতি কবি শাহীন রেজা বলেন, “এই সংকলনের প্রথম কবিতাটিই একজন পরিচিত ফ্যাসিস্ট সহযোগীর। বাংলা একাডেমি ঘেরাও করে এর জবাব আদায় করা হবে।”
সম্পাদকের বক্তব্য ও প্রশ্ন
সংকলনের সহ-সম্পাদক হাসান রোবায়েত অবশ্য আগেই ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েছিলেন—
“২৪-এর অভ্যুত্থান নিয়ে কবিতা লিখেছেন, এমন যে কেউ যেন কবিতা পাঠান বা মন্তব্যে নাম মেনশন করেন। আমি চেষ্টা করব ভালো কবিতা যেন বাদ না যায়।”
কিন্তু এখন অনেকে প্রশ্ন তুলছেন—এই উদ্যোগ কতটা স্বচ্ছভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে? সংকলনের মূল সম্পাদক মোহাম্মদ আজম এবং আরেক সহ-সম্পাদক রওশন আরা মুক্তা এখনো এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য দেননি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের পক্ষ থেকেও এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি।
আগামী কর্মসূচি ও পরিস্থিতির উত্তেজনা
‘জুলাই চেতনার বিকৃতি’র বিরুদ্ধে কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিবাদ এখানেই থেমে নেই। ২৭ জুলাই ‘বাংলা একাডেমি ঘেরাও’ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে জাতীয়তাবাদী লেখক ফোরাম। একই দিন অনুষ্ঠিত হবে ‘লাল জুলাইয়ের কবিতা পাঠ’। বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনও তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে।
সংকলন নয়, চেতনার জয় চাই
এই বিতর্ক আরেকবার প্রমাণ করে, সাহিত্য শুধুমাত্র নান্দনিকতার বিষয় নয়—এটি রাজনৈতিক চেতনা ও নৈতিক অবস্থানেরও বাহক। সংকলন ঘিরে তৈরি হওয়া উত্তেজনা এখন আর শুধু একটি বইকে ঘিরে নয়—এটি হয়ে উঠেছে সংস্কৃতি-রাজনীতির শুদ্ধিকরণের প্রশ্নে একটি জাতীয় আন্দোলনের সূচনা।
সাহিত্য শুধু শব্দের বিন্যাস নয়, এটি সময়ের সাক্ষ্য। তাই সংকলন নয়, সত্যিকারের চেতনার জয় হোক—এটাই আজকের কবিতা জগতের স্পষ্ট দাবি।