আবেগ ও বুদ্ধিমত্তার ভারসাম্য
আবেগ এবং বুদ্ধিমত্তার সর্বোচ্চ ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় স্ফুলিঙ্গের মতো কিছু শব্দ কবির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে, সেই শব্দগুচ্ছের সর্বোত্তম বিন্যাস হচ্ছে কবিতা। বিন্যাস তৈরির ক্ষেত্রে কবি কিছু ব্যাকরণ অনুসরণ করেন, ছন্দ তার অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি।
কেউ কেউ ছন্দকে কবিতার মেরুদণ্ড হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। আমাদের সত্তরের দশকের কবি আতাহার খান কবিতা রচনার সময় ছন্দ শুদ্ধতার ওপর খুব জোর দেন, রফিক আজাদও শুদ্ধ ছন্দে কবিতা লিখতে পছন্দ করতেন। আতাহার খান আমাকে বলেছেন, ছন্দের মধ্যে থাকলে কবিতার অনাকাঙ্খিত মেদগুলো এমনিতেই ঝরে যায়, ছন্দই সেইসব দূর করে দেয়। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ছন্দ অনেক সময় কবিতাকে কবির নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়, তবে একথা ঠিক যে ছন্দের মধ্যে থাকলে শেষ পর্যন্ত যে কোনো বিষয়ই কবিতা হয়ে ওঠে।
ছন্দ যেমন কবিতার চালিকা শক্তি, আবার তা নিয়ন্ত্রকও।
আদি, মধ্য, অন্ত্যানুপ্রাস, উপমা, রহস্যময়তা, বৈচিত্রপূর্ণ রসের সমাহার, প্রতীকী চিত্ররূপ ইত্যাদি শিক্ষিত কবিরা বিবেচনায় রাখেন। কখনো তা সচেতনভাবে কবিতায় সন্নিবেশ করেন, কখনো তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কবিতায় নিষিক্ত হয়। কবিতাটি রচনার পরে, কবিতার ব্যাকরণ-জ্ঞান সমৃদ্ধ কবি, যখন নিজের কবিতাটি পড়েন তখন তিনি কোথাও ব্যাকরণগত ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা পূরণের চেষ্টা করেন। এই কাজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই প্রচুর করেছেন। রবীন্দ্র-উত্তর প্রধান কবিদের প্রায় সকলেই নিজের কবিতা সম্পাদনা করেছেন।
ত্রিশের দশকের কবিরা হৃদয়ের চেয়ে মস্তিস্ককে বেশি গুরুত্ব দেবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে মরমিয়া ধারার একটি গীতল স্রোত বাহিত হয়েছে বাংলা কবিতায়। ত্রিশের কবিদের এই মাতুব্বরি থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্তি দিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি প্রেম ও প্রকৃতিকে উপজীব্য করে পয়ার নির্মাণের মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিশের কবিদের দ্বন্দ্ব মিটিয়েছেন। পরবর্তীতে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমূখ কবি এই ধারাতেই লিখে নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণের দক্ষতা দেখিয়েছেন।
ওয়াল্ট হুইটম্যানের প্রভাবে বাংলা কবিতা ছন্দমুক্তির প্রয়াসে ব্রতী হয় ত্রিশের দশকে। পরবর্তীতে আরেক মার্কিন কবি এজরা পাউন্ডের প্রভাবে চিত্রকল্পের মধ্যেই বুদ্ধি ও আবেগের ভারসাম্য নির্ণয়ের এক অপার সম্ভাবনা খোঁজেন বাঙালি কবিরা।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪