কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, গীতিকার, সাংবাদিক ও কলেজ শিক্ষক আব্দুল খালেক ফারুক। দীর্ঘ দিন থেকে লেখালেখি করে আসছেন স্থানীয় ও জাতীয় পত্রপত্রিকায়। কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তিনি। এছাড়াও নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন দিশারী পাঠাগার। লেখালেখি ও সাংবাদিকতার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছেন ছাত্রাবস্থা থেকেই। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি, গল্পকার ও সংগঠক নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান : আপনার শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে জানতে চাই। বড় হয়ে কী হবেন বলে ভেবেছিলেন তখন বা ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য কী ছিল?
আব্দুল খালেক ফারুক : সত্যি বলতে কী খুব ছোটবেলা থেকেই আমি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। প্রতিষ্ঠিত একজন সাংবাদিক-লেখক হতে চেয়েছি। অন্যকিছু ভাবনায় ছিল না। জানতাম স্বপ্নটাকে সফল করতে হলে ঢাকায় যেতে হবে। তাই কারমাইকেল কলেজে ইতিহাসে অনার্স পড়ার সময়ই ঢাকায় গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসএস-এ পাস কোর্সে ভর্তি হই। প্রায় খালি হাতে গিয়ে পত্রিকায় কাজ খুঁজতে থাকি। কুড়িগ্রামের সাপ্তাহিক গণকথার ঢাকা প্রতিনিধি ও ঢাকার সাপ্তাহিক স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করে টিকে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু আর্থিক সংকট, কঠিন পরিশ্রম, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার কারণে টিকে থাকতে পারিনি। কয়েক মাস পরে এলাকায় চলে এসে আগের মতোই সাপ্তাহিক ধরলার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার শিক্ষাজীবন তখন চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।

নুসরাত জাহান : লেখালেখির একেবারে শুরুর জার্নি সম্পর্কে জানতে চাই!
আব্দুল খালেক ফারুক : অন্য সবার মতো আমারও শুরুটা হয়েছিল ছড়া, কবিতা দিয়ে। পরে নাটক ও গান লিখতে থাকি। নাটকে নির্দেশনাও দিতে থাকি। স্থানীয় ও আঞ্চলিক পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা হওয়ায় উৎসাহ বেড়ে যায়। তবে বই প্রকাশিত হয় অনেক পরে ২০১৫ সালে। বলা যায় অনেক বিলম্বে প্রথম বই প্রকাশিত হয়। এখন পর্যন্ত আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৩।
নুসরাত জাহান : আপনার পরিবারে কি কেউ সাহিত্যচর্চা করত, যাকে দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন?
আব্দুল খালেক ফারুক : না। সে রকম কেউ ছিল না। লেখালেখিটা ছিল সহজাত। সেই সঙ্গে পাঠ্যবই ও বাইরের প্রচুর বই ও পত্রপত্রিকার সাহিত্যপাতা পড়েই মূলত প্রেরণা পেয়েছি।
নুসরাত জাহান : প্রথম লেখা বা লেখা প্রকাশের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলবেন?
আব্দুল খালেক ফারুক : প্রথম লেখা কোথায় প্রকাশিত হয়, এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি না। তবে রেডিওতে প্রথম একটা ছড়া প্রচারিত হয়। আর পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই আমি হাতে লিখে পত্রিকা প্রকাশ করতাম। প্যারোডি খবর ও রম্য রচনা কিংবা নাটক লিখে স্ক্রিপ্ট জমানো শুরু করি।
নুসরাত জাহান : বই করার চিন্তা কবে মাথায় এলো? এবং প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা?

আব্দুল খালেক ফারুক : লেখালেখির এক পর্যায়ে মনে হলো, এবার বই প্রকাশ করা দরকার। কিন্তু প্রকাশ করার মাধ্যম পাচ্ছিলাম না। ঢাকার এক সাংবাদিক সহকর্মীর মাধ্যমে শব্দশৈলী প্রকাশনা সংস্থার ইফতেখার ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় ও কথাবার্তা হয়। তারপর বেশ কিছু বই ক্রয় করার শর্তে একটি নাটক ও একটি গল্পের বই প্রকাশ করি। এরপর বাবুই ও চমন প্রকাশ থেকে বই প্রকাশ করি বেশ কয়েকটি।
নুসরাত জাহান : জীবনে কোন লেখকের লেখার মাধ্যমে সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন বলে মনে করেন?
আব্দুল খালেক ফারুক : আমি অনেক লেখকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। নাটকে মমতাজ উদ্দিন আহমদ, মামুনুর রশিদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন; উপন্যাস ও গল্পে হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, আনিসুল হক, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, কবিতায় শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, জীবনানন্দ দাশ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বারা দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
নুসরাত জাহান : আপনার অধিকাংশ লেখাই ব্যঙ্গাত্মক ছলে লেখা। এই ধরনটা বেছে নেওয়ার কারণ কী?
আব্দুল খালেক ফারুক : আসলে শৈশব থেকে রম্য রচনার প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ ছিল। যত বেশি সম্ভব রম্যরচনা পাঠ করার চেষ্টা করেছি। শৈশব থেকে গ্রাম, সংগঠন ও সমাজে রম্যচর্চা করার সুযোগ পেয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা, সমাজের অসঙ্গতি; যেগুলো আমাকে কষ্ট দেয়— সেগুলো প্রকাশ করার জন্য রমভঙ্গির কোনো বিকল্প নেই।
নুসরাত জাহান : ‘লেখকের বিড়ম্বনা’ এবং ‘নেতার বিড়ম্বনা’ নামে আপনার দুটো গল্পগ্রন্থ আছে। ব্যক্তি জীবনে একজন লেখক হিসেবে আপনি কি কোনো বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়েছেন? সেগুলো কী কী?
আব্দুল খালেক ফারুক : পারিবারিকভাবে খুব বেশি বিড়ম্বনার শিকার হইনি। তবে সামাজিকভাবে তো সব সময় হই। সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা, আমি যখন মনে করি আমার এই লেখাটা পড়ে আনন্দ পাওয়া যাবে; দুঃখজনক হলেও সত্য— পাঠক তা পড়ে দেখে না। ফলে তারা কিছু মেসেজ প্রাপ্তি ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। এখন তো বই ফ্রি দিলেও কেউ পড়তে চায় না। তারপরও লিখি। নিজের আনন্দের জন্য লিখি। আর আঞ্চলিক ভাষার প্রতি আমার একটা কমিটমেন্ট আছে। কেউ পছন্দ না করলেও আমি এই ভাষা চর্চা করে যাব।
নুসরাত জাহান : লেখার রসদ সংগ্রহ করেন কোথা থেকে?
আব্দুল খালেক ফারুক : সমাজ থেকে। চারপাশের মানুষের কাছ থেকে। সমাজে বিচিত্র সব চরিত্র দেখি। তাদের কাজ কর্ম ও গতিবিধি ফলো করি। এরপর মনের আনন্দে লিখে ফেলি নাটক, গল্প, উপন্যাস।
নুসরাত জাহান : লেখালেখি, নাট্য নির্দেশনা ইত্যাদির পাশাপাশি আপনি একজন গীতিকার। এই গীতিকার হয়ে উঠবার গল্পটা যদি বলতেন?
আব্দুল খালেক ফারুক : আমি তো ছোটবেলা থেকেই গান লিখি। গানের মানুষের সঙ্গে চলি। রেডিও, ক্যাসেটে গান শুনে বড় হয়েছি। ভাওয়াইয়া শিল্পী শফিকুল ইসলামের অনুপ্রেরণায় ভাওয়াইয়ার অ্যালবাম ‘নাইয়রী’ এর জন্য ৫টি গান লিখি। গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। তারপর কুড়িগ্রাম জেলার ব্র্যান্ডিং সং লিখি। ‘আইসেন বন্ধু হামার কুড়িগ্রাম’। গানটি শ্রোতারা পছন্দ করেন, বিশেষ করে প্রবাসীরা অনেকেই আবেগে আপ্লুত হয়েছেন।

নুসরাত জাহান : পেশাগত জীবনে আপনি একজন শিক্ষক এবং সাংবাদিক। সেইসাথে একজন লেখক। পুরো বিষয়টি কীভাবে সামাল দেন?
আব্দুল খালেক ফারুক : অনেকেই এ নিয়ে প্রশ্ন করে। মৃদু হেসে ছোট করে উত্তর দেই। সাংবাদিকতা ও লেখালেখিটা একই ধরনের কাজ মনে হয়। আমার লেখার মধ্যে সেই তালমিলটা অনেকেই খুঁজে পান। যেমন আমি প্রচুর ফিচার লিখি। অফিসও আমাকে তাগিদ দেয় ফিচার লিখতে। সাহিত্যজ্ঞান না থাকলে তার হাতে ফিচারটা ঠিক জমে না। আর শিক্ষকতা করছি জীবিকার জন্য। শিক্ষার্থীদের পাশে সব সময় থাকি। তারাও আমাকে ভালোবাসে। কখনও কখনও আমার বই কিনে পড়ে। নিজের প্রতিষ্ঠিত দিশারী পাঠাগারে তাদেরকে সম্পৃক্ত করে পাঠক তৈরির চেষ্টা সব সময় জারি রাখি।
নুসরাত জাহান : বর্তমান সময়কার লেখক এবং সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই?
আব্দুল খালেক ফারুক : নবীন ও প্রতিষ্ঠিত লেখকরা লিখছেন প্রচুর। বইও বের হচ্ছে। তকে পাঠক কমে গেছে। সাহিত্যপাতাও অনেক লেখা ছাপা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে কিছু লেখা পড়ে ভালো লাগে। আসলে প্রযুক্তির কারণে পড়ার অভ্যাস কমে গেছে। তবে বিশ্বাস করি এক সময় আবার মুদ্রিত লেখার কদর বাড়বে।
নুসরাত জাহান : জীবনের পঞ্চাশতম বছরে এসে ‘নানা রঙের দিনগুলি’ শিরোনামে আত্মজীবনী লিখে ফিরে দেখার চেষ্টা করছেন ফেলে আসা দিনগুলি। পাঠকের সাথে ভাগাভাগি করেছেন নিজের জীবনের রোমাঞ্চকর যাত্রা। কিন্তু পঞ্চাশ পরবর্তী জীবনের কথা অর্থাৎ পরবর্তীতে এরকম অভিজ্ঞতার কথা আরো আসছে কি?
আব্দুল খালেক ফারুক : অভিজ্ঞতার ভান্ডার তো সব সময় সমৃদ্ধ হয়। জমিয়ে রাখছি। কখনও প্রকাশ করব। তবে এই মুহূর্তে মনে করছি লেখকের লেখার স্বাধীনতা পুরোপুরি নেই। স্বাধীনতাটা কোনো একটি পক্ষের ওপর নির্ভরশীল। লেখার কারণে আমাকে প্রচুর হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
নুসরাত জাহান : লেখক হয়ে উঠবার পুরো যাত্রায় পরিবার বা প্রিয়জনের সাপোর্ট কতটুকু পেয়েছেন?
আব্দুল খালেক ফারুক : যতটুকু পেয়েছি, কম না। তবে আরেকটু বেশি হলে ক্ষতি হতো না।
নুসরাত জাহান : জীবনে লোমহর্ষক কোনো অভিজ্ঞতার কথা, যা পাঠকের সাথে শেয়ার করতে চান?
আব্দুল খালেক ফারুক : এই মুহূর্তে বলতে চাই না। সময় হলে বলব।
নুসরাত জাহান : জীবন নিয়ে পরবর্তী ভাবনা কী?
আব্দুল খালেক ফারুক : আমার সব ভাবনাই লেখালেখিকে ঘিরে। জীবনের শেষ পর্যন্ত লিখতে চাই। মৃত্যুর পরেও যেন এই পরিচয় থাকে।