ইতিহাস, ইসলামি সংস্কৃতি ও পরিবারকেন্দ্রিক কাহিনির মিশেলে তুর্কি ধারাবাহিকের জয়রথ
বাংলাদেশের বিনোদন জগতে এক সময় রাজত্ব করত দেশীয় বাংলা নাটক। আশির দশক থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিটিভির একক আধিপত্যে নির্মিত হত দর্শকপ্রিয় একের পর এক নাটক। কিন্তু নব্বইয়ের শেষ দিকে এসে শুরু হয় ভারতীয় সিরিয়ালের আগ্রাসন। ‘কসৌটি জিন্দেগি কি’, ‘কাহানি ঘর ঘর কি’ বা ‘কুমকুম’—এসব ধারাবাহিক এক দশকের বেশি সময় ধরে মাতিয়ে রাখে দেশের ঘরে ঘরে।
তবে সেই দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে ২০১৫ সাল থেকে। তখন দীপ্ত টিভি ‘সুলতান সুলেমান’ নামের তুর্কি ঐতিহাসিক সিরিয়াল বাংলায় ডাবিং করে প্রচার শুরু করে। রাতারাতি এই সিরিয়াল হয়ে ওঠে সাড়া জাগানো। এরপর থেকে বাংলাদেশের টেলিভিশন পর্দা ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে শুরু হয় তুর্কি ধারাবাহিকের রাজত্ব। ভারতীয় সিরিয়ালকে পেছনে ফেলে দর্শকের মন জয় করে নেয় ইতিহাস-ভিত্তিক, ইসলামি ভাবধারায় নির্মিত তুর্কি সিরিজগুলো।
কেন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তুর্কি ধারাবাহিক?
বিশ্লেষকদের মতে, তুর্কি সিরিয়ালের প্রতি এই আকর্ষণের পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, এ সিরিজগুলোর গল্প বিন্যাস, দৃশ্যায়ন, অভিনয়, সাউন্ড ডিজাইন, পোশাক ও সেট ডিজাইন—সব কিছুতেই থাকে আন্তর্জাতিক মানের ছোঁয়া। সিরিজগুলোর বেশিরভাগই নির্মিত হয় বড় বাজেট ও বিশ্বমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
দ্বিতীয়ত, এসব সিরিয়ালে ইসলামি ইতিহাস, তুর্কি সংস্কৃতি ও মুসলিম শাসকদের কাহিনি অত্যন্ত জীবন্তভাবে তুলে ধরা হয়। যেমন: ‘দিরিলিস আরতুঘরুল’, ‘কুরুলুস উসমান’, ‘সুলতান সুলেমান’, ‘কোসেম সুলতান’—সবগুলোই দর্শককে নিয়ে যায় এক ঐতিহাসিক গৌরবগাথায়। ইসলামের ইতিহাস ও মুসলিম সভ্যতার উত্থান-পতনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হওয়ায় দর্শকের সঙ্গে তৈরি হয় আত্মিক সংযোগ।
তৃতীয়ত, এসব সিরিয়াল পরিবার নিয়ে বসে দেখার মতো। যেখানে রয়েছে নৈতিক শিক্ষা, পারিবারিক বন্ধন, নেতৃত্ব, ন্যায়বিচার, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের বার্তা। ভারতীয় সিরিয়ালের অতিনাটকীয়তা, অতিরঞ্জিত কাহিনি ও সম্পর্ক নিয়ে জটিলতা অনেক দর্শককে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সেখানে তুর্কি সিরিয়ালে রয়েছে একধরনের ভারসাম্য ও আবেগঘন বাস্তবতা।
টিভি থেকে ওটিটি—সবখানে তুর্কি ধারাবাহিকের দাপট
বাংলাদেশে তুর্কি সিরিজ সম্প্রচারে সবচেয়ে এগিয়ে দীপ্ত টিভি। এই চ্যানেলে ‘সুলতান সুলেমান’ ছাড়াও প্রচারিত হয়েছে—
* ‘তুমি আছ সবখানে’ (Har Yerde Sen)
* ‘সূর্যকন্যা’ (Güneşin Kızları)
* ‘ভালোবাসা ফিরে এলো’ (Aşk Yeniden)*
‘গুড ডক্টর’ (Mucize Doktor)—একজন অটিজম ও স্যাভান্ট সিনড্রোমে আক্রান্ত চিকিৎসকের গল্প
* ‘দিরিলিস: আরতুগ্রুল’
* ‘সুলতান সুলেমান: কোসেম’
* `ফাতমাগুল’, ‘ফেরিহা’, ‘জননী জন্মভূমি’ ইত্যাদি
এনটিভিতে চলছে ‘কুরুলুস: উসমান গাজী’, যা ‘দিরিলিস আরতুঘরুল’-এর পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে বিশেষভাবে জনপ্রিয়।

অন্যদিকে, মাছরাঙা টেলিভিশনে সম্প্রচারে রয়েছে ‘বড় ভাই’ (Kardeşlerim)—একটি হৃদয়ছোঁয়া পারিবারিক নাটক, যেখানে চার ভাইবোনের সংগ্রামী জীবনের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে।
ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও তুর্কি কনটেন্টের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ইউটিউব, আইফ্লিক্স, বিঞ্জসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত মুক্তি পাচ্ছে বাংলায় ডাবিংকৃত তুর্কি সিরিজ।
ধর্ম, ইতিহাস আর পরিচয়ের সন্ধানে দর্শক
তুর্কি সিরিয়ালের মূল আকর্ষণ এখানেই যে, এটি শুধু বিনোদন নয়—এটি পরিচয়ের এক খোঁজ। মুসলিম ইতিহাস, খেলাফতের গৌরব, ধর্মীয় মূল্যবোধ, এবং আত্মত্যাগ ও আদর্শের গল্প—এসব বিষয় দর্শকদের মনে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার বোধ তৈরি করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমা আধিপত্যবাদী বা হিন্দি সিরিয়ালের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে তুর্কি ধারাবাহিক যেন এক ‘সফট পাওয়ার’ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।