বিশেষ প্রতিবেদন
২০১১ সালের জানুয়ারির শুরুর দিনগুলো। উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় তরুণ সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ বুয়াজিজি জীবিকার তীব্র সংকটে আত্মাহুতির পথ বেছে নেন। তাঁর শরীরে আগুন লাগানোই পরিণত হয় বিশ্বরাজনীতির এক বড় মোড় ঘোরানো ঘটনায়। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে আরবজুড়ে— জন্ম নেয় আরব বসন্ত। দেশ থেকে দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে যায়, পতন হয় একের পর এক স্বৈরশাসকের। আর এই বিক্ষোভের মূল শক্তি ছিলেন তরুণরা।
এক দশক পরে দক্ষিণ এশিয়ায় যেন একই ধারার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। যদিও রূপ কিছুটা ভিন্ন, তবে মিলগুলো স্পষ্ট— দুর্নীতি, বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি, অর্থপাচার ও দমননীতির বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের অগ্নিগর্ভ প্রতিরোধ।
দক্ষিণ এশিয়ায় একের পর এক বিস্ফোরণ
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও সর্বশেষ নেপাল— তিন দেশেই দেখা গেছে জেনারেশন জি-এর নেতৃত্বে জনঅভ্যুত্থান। বয়স ১৪ থেকে ২৪-এর মধ্যে থাকা এই তরুণরাই এক নতুন ধারা তৈরি করছে। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় নয়, বরং সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসছে।
নেপালের বিস্ফোরণ
২০২৪ সালের জুলাইয়ে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসা নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তরুণদের তীব্র বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার) ও ইনস্টাগ্রামসহ সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া ছিল স্ফুলিঙ্গ, কিন্তু এর পেছনে জমা হয়ে ছিল বছরের পর বছর ধরে ক্ষোভের আগ্নেয়গিরি।
অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব ও শিক্ষা ব্যয়ের বোঝায় বিপর্যস্ত নেপালি তরুণদের অভিযোগ— রাজনীতিক ও তাদের পরিবাররা বিলাসী জীবনে মত্ত, অথচ সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে।
নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি ও বলপ্রয়োগে অন্তত ২১ জন নিহত হন। কিন্তু ভয় দেখানোর এই কৌশল উল্টো বিক্ষোভকে আরও তীব্র করে তোলে। আন্দোলনকারীরা মন্ত্রীদের বাড়িঘরে হামলা চালায়, সরকারি স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সেনারা হেলিকপ্টার ব্যবহার করে মন্ত্রীদের পরিবারকে উদ্ধার করে।
কাঠমান্ডুর এক তরুণ শিক্ষার্থী আয়ুশ বাসিয়াল জানান,
“এটা অভূতপূর্ব। স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা কোনো দলের সঙ্গে না থেকেও রাস্তায় নেমেছে। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার আন্দোলন আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।”
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে তরুণদের নেতৃত্বেই সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চূড়ান্ত রূপ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে রাস্তায় নামে। প্রাণ হারান দেড় হাজার মানুষ, আহত হয়ে পঙ্গু হন অন্তত ১০ হাজার। অবশেষে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
অভিযোগগুলো ছিল নেপালের মতোই— দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থপাচার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।
শ্রীলঙ্কার অনুপ্রেরণা
এরও আগে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক পতনের মধ্যে জ্বালানি ও খাদ্যসংকটে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। তখনও নেতৃত্ব দেয় তরুণরা। ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
জেন-জির বৈশিষ্ট্য
এই প্রজন্মকে শাসকশ্রেণি এখনও বোঝেনি—
এরা অনমনীয় ও দৃঢ়চেতা।
আবেগপ্রবণ হলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অটল।
ভয় দেখানো, হত্যা-খুন কিংবা দমননীতি— কোনো কিছুকেই এরা দীর্ঘদিন মানিয়ে নেয় না।
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে— গুলি, কারফিউ বা সেনা নামিয়েও তরুণদের প্রতিরোধ ঠেকানো যায় না।
ভারতের ছায়া
দক্ষিণ এশিয়ার এই পরিবর্তনগুলো ঘটছে ভারতের চারপাশে। কিন্তু ভারত নিজেও অস্থিরতার মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বাড়ছে।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার টানা এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়। কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দুর্বল ফলাফল ও ভোট কারচুপির অভিযোগে তার জনপ্রিয়তা তীব্রভাবে কমেছে।
ভারতে বেকারত্ব বাড়ছে, রুপির দরপতন অব্যাহত। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভারতের রপ্তানিপণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়লে মোদি সরকারের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
সামনে কী?
শ্রীলঙ্কা: দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের পতন ও নতুন সূচনা।
বাংলাদেশ: দীর্ঘ শাসনের অবসান, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের পথে।
নেপাল: তরুণদের আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে।