রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু আর বিভীষিকার মাঝেও জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছে দুটি নাম—মাহেরীন চৌধুরী ও মাসুকা বেগম।
তারা ছিলেন শিক্ষক, কিন্তু শুধু পাঠ্যবই পড়ানো নয়—এই দুই মহীয়সী নারী প্রমাণ করে গেছেন, শিক্ষকতা মানেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, আর মমতার চূড়ান্ত রূপ।
আগুনের লেলিহান শিখায় জীবন নয়, বেছে নিলেন দায়িত্ব
সোমবার দুপুরে ঘটে যাওয়া সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়েছে স্কুলের ‘স্কাই’ নামের একটি শ্রেণিকক্ষ। বিমানটি সরাসরি সেই কক্ষেই আছড়ে পড়ে। মুহূর্তেই চারপাশ ঢেকে যায় কালো ধোঁয়ায়, ছড়িয়ে পড়ে দাউদাউ আগুন। আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা চিৎকার করে ওঠে—‘বাঁচাও, বাঁচাও’।
তখন অনেকেই পালিয়ে যায় নিজের প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকেন দুই নারী—মাহেরীন ও মাসুকা। তাঁরা পেছনে তাকাননি, সামনে আগুন দেখেও থামেননি। শিশুদের একে একে কোলে তুলে, কাঁধে চাপিয়ে বের করে আনতে থাকেন।
তৃতীয় শ্রেণির কো-অর্ডিনেটর মাহেরীন অন্তত ২০টি শিশুকে আগুনের ভেতর থেকে বের করে আনেন। দ্বিতীয় বিস্ফোরণের সময় আগুনে তার শরীর দগ্ধ হয়। তারপরও থেমে যাননি। কিন্তু এক সময় আগুন তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় তাকে নেওয়া হয় শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে। মৃত্যুর আগে স্বামী মনসুর হেলালকে তিনি বলেছিলেন, “তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমারও তো দুটো সন্তান আছে, কিন্তু ওরাও তো আমার সন্তান। আমি ওদের রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলাম।”
মাহেরীনের এ কথাগুলো যেন যুগের কাছে হয়ে রইল এক মহাকাব্যিক অঙ্গীকার। এক বীরের বিদায়ী সনদ।
“তোমরা ভয় পেও না, আমি আছি”—মাসুকা ছিলেন শেষ অবলম্বন
মাসুকা বেগম ছিলেন ইংরেজি শিক্ষিকা। কোনো দিন বিয়ে করেননি। শিক্ষার্থীরাই ছিলেন তার সন্তান। দুর্ঘটনার সময় ক্লাসে ছিলেন তিনি। আগুন দেখে ভয়ভীত শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, “তোমরা ভয় পেও না, আমি আছি।”
তারপর একে একে সবাইকে বের করে আনেন। শেষ মুহূর্তে তিনি নিজেই আগুনে আটকা পড়ে যান। তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তিনিও প্রাণ হারান বার্ন ইনস্টিটিউটে।
মাসুকার বাবা বলেন, “সে বিয়ে করেনি, সংসার করিনি, কারণ আমাদের সবাইকে নিয়ে সে ভাবত। মাসে মাসে টাকা পাঠাতো। আমাদের দেখাশোনাই ছিল তার সংসার।”
রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, কিন্তু জাতির চোখে তাঁরা চিরকালের বীর এই দুই শিক্ষিকার আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্র তাদের জাতীয় বীরের মর্যাদা দিতে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম পর্যন্ত মাহেরীনের সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তাদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
শেষ বিদায়, কেবল দেহের
মাহেরীনের লাশ তার গ্রামের বাড়ি নীলফামারীতে বাবা-মায়ের কবরের পাশে শায়িত করা হয়। মাসুকার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে দাফন করা হয় তার বড় বোনের শ্বশুরবাড়ি আশুগঞ্জের সোহাগপুরে।
গ্রামের আকাশ-বাতাস, কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল তাদের চলে যাওয়ার দিন। কিন্তু তারা চিরতরে হারিয়ে যাননি। তারা বেঁচে থাকবেন প্রতিটি বেঁচে যাওয়া শিশুর মুখে, চোখে, প্রাণে।